নিখিল মানখিন: ময়মনসিংহের মুক্তাগাছা থানার নালিখালী গ্রামের বাসিন্দা নিফলা মমিন (৪৬)। অকেজো দুটি কিডনি নিয়ে মৃত্যুর সঙ্গে লড়েছেন সাড়ে চার বছর। ডায়ালাইসিসের পেছনে সহায়-সম্বল হারিয়ে চিকিৎসা চালাতে না পেরে এ মাসেই মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়েন তিনি। শুধু নিফলা মমিন নন, প্রতি বছর শত শত কিডনি বিকল রোগী চিকিৎসার অভাবে মারা যাচ্ছেন। ব্যয়বহুল চিকিৎসা এবং চিকিৎসাকেন্দ্র ও চিকিৎসক সংকট এমন পরিস্থিতির জন্য দায়ী বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা।
সম্প্রতি চট্টগ্রামে ডায়ালাইসিস ফি কমানোর দাবিকে কেন্দ্র করে সৃষ্ট নানা অনাকাক্সিক্ষত ঘটনা কিডনি চিকিৎসায় দেশের চিকিৎসা সেক্টরের সীমাবদ্ধতা সামনে চলে আসে।
বিশেষজ্ঞরা বলেছেন, আন্তর্জাতিক মানদন্ড অনুযায়ী ৫০ হাজার জনগোষ্ঠীর জন্য একজন নেফ্রোলজিস্ট থাকা দরকার। দেশ নেফ্রোলজিস্ট আছেন মাত্র ১৭০ জন। দেশের জনসংখ্যা ১৭ কোটি ধরা হলে ১০ লাখ মানুষের জন্য একজন করে নেফ্রোলজিস্ট আছেন।
বিশেষজ্ঞরা আরো বলছেন, ডায়াবেটিস, উচ্চ রক্তচাপ, কিডনিতে প্রদাহ ও আরো কিছু কারণে মানুষ দীর্ঘস্থায়ী রোগে ভুগতে থাকে। এ পরিস্থিতিতে চিকিৎসা হিসেবে ডায়ালাইসিস ও কিডনি প্রতিস্থাপনকেই প্রধান বিকল্প হিসেবে বেছে নেন চিকিৎসকরা। ডায়ালাইসিস দরকার, এমন রোগীর তালিকায় প্রতিবছর আনুমানিক ৩৫ হাজার মানুষ যুক্ত হয়। কিন্তু দেশে ডায়ালাইসিসের সুযোগ খুব কম মানুষ পায়।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তর জানায়, দেশে সরকারি-বেসরকারি ৪৩টি হাসপাতাল ও ক্লিনিকে ডায়ালাইসিস সেবা দেয়া হয়। এসব প্রতিষ্ঠানের ডায়ালাইসিস শয্যা আছে ৫৭০টি। বাংলাদেশ রেনাল অ্যাসোসিয়েশন বলছে, প্রতিষ্ঠান ও শয্যার সংখ্যা এর দ্বিগুণের কিছু বেশি।বাংলাদেশ রেনাল অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি অধ্যাপক মুহম্মদ রফিকুল আলম ভোরের আকাশকে বলেন, দেশে ২৫ হাজার মানুষ ডায়ালাইসিস করতে পারে।
প্রতিবছর এর জন্য খরচ হয় দু-তিন লাখ টাকা। ব্যয় বেশি হওয়ায় দেশের ৯০ শতাংশ রোগী ডায়ালাইসিস করাতে পারে না। ডায়ালাইসিস শুরুর এক বছরের মধ্যে ৭০ শতাংশ রোগী তা ছেড়ে দেয়। ডায়ালাইসিস একবার শুরু করলে আজীবন তা অব্যাহত রাখতে হয়। ডায়ালাইসিসের বিকল্প হচ্ছে কিডনি প্রতিস্থাপন। কিডনিবিষয়ক আলোচনায় সা¤প্রতিক সময়ে কিডনি প্রতিস্থাপনের বিষয়টি সামনে চলে আসছে।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, দেশে বিপুলসংখ্যক কিডনি রোগীর তুলনায় ডায়ালাইসিস সেন্টার খুবই কম। মাত্র ৯৬ এবং ১৮ হাজার রোগী এসব সেন্টারে সপ্তাহে দু’বার করে ডায়ালাইসিস করাতে পারেন। বেসরকারি সেন্টারগুলোয় সাড়ে তিন হাজার থেকে পাঁচ হাজার টাকা পর্যন্ত ডায়ালাইসিসের মূল্য রাখা হয়। সপ্তাহে প্রতি রোগীকে দুই থেকে তিনবার ডায়ালাইসিস করাতে ৬ থেকে ১০ হাজার টাকা খরচ করতে হয়। সাউথ এশিয়াতে মোট কিডনি রোগীর তুলনায় মাত্র ১৫ শতাংশ রোগী ডায়ালাইসিসের সুযোগ পায়।
বাকি বিপুলসংখ্যক রোগী অর্থাভাবে ডায়ালাইসিস নিতে পারে না। এ সুযোগে কিডনি বিকল রোগীদের কাছ থেকে নানা কৌশলে অর্থ হাতিয়ে নেয় একটি চক্র। মফস্বল থেকে আগত রোগীরাই এমন ফাঁদে বেশি পড়ছে। বাংলাদেশ রেনাল অ্যাসোসিয়েশন সূত্র জানায়, দেশে প্রায় ২ কোটি লোক কোনো না কোনো ধরনের কিডনি রোগে ভুগছে। আক্রান্তের শতকরা ৭৫ ভাগ রোগী কিডনি নষ্ট হওয়ার আগে এ মরণব্যাধির অস্তিত্ব ধরতে পারে না।
কিডনি বিকল রোগীর চিকিৎসা এত ব্যয়বহুল যে, মাত্র শতকরা ৭ থেকে ১০ ভাগ লোকের পক্ষে চিকিৎসা চালিয়ে যাওয়া সম্ভব। দেশে প্রতি বছর ২৫ হাজার লোকের কিডনি নানা কারণে হঠাৎ অকেজো হয়ে যায়। প্রতি বছর কিডনি রোগে প্রায় ৪০ হাজার লোক মারা যায়। দেশে কিডনি বিকল রোগীদের জন্য কিডনিদাতার সংকট প্রকট। কিডনি প্রতিস্থাপনের জন্য অপেক্ষমাণ মোট রোগীর মাত্র শতকরা ২ ভাগের পক্ষে কিডনি প্রতিস্থাপন করানো সম্ভব হয়। অন্যরা নিজেদের মতো চেষ্টা করে রোগী নিয়ে বিদেশে পাড়ি জমায়। বাকিরা ডায়ালাইসিস দিয়ে বাঁচার চেষ্টা করে থাকে।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, টাকা দিয়েও কিডনি সংগ্রহ করা সম্ভব হচ্ছে না। কিডনি দেয়ার পর ফলোআপ চিকিৎসা ও বিভিন্ন কারণে নানা শারীরিক সমস্যায় ভুগছেন জীবিত কিডনিদাতারা। পাশাপাশি রয়েছে কিডনি সার্জনের সংকট, আইনি জটিলতাসহ নানা অনাকাক্সিক্ষত ঘটনা। দেশে কিডনি রোগ চিকিৎসার ব্যবস্থা থাকলেও খুবই ব্যয়বহুল। প্রতিস্থাপন কার্যক্রম চালু থাকলেও সাফল্যের হার খুব বেশি সন্তোষজনক নয়। দেশের সব চিকিৎসা প্রতিষ্ঠানে কিডনি প্রতিস্থাপনের ব্যবস্থা নেই। সীমিত চিকিৎসা প্রতিষ্ঠানে ডায়ালাইসিস ও প্রতিস্থাপন কার্যক্রম চালু রয়েছে।
কিডনি রোগ বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক এম এ ওহাব দেশে প্রথম কিডনি প্রতিস্থাপন উদ্যোগের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। তিনি ভোরের আকাশকে বলেন, দেশে কিডনি প্রতিস্থাপন অব্যাহত রাখতে হবে। কিন্তু দেশে কিডনিদাতার সংকট প্রকট হয়ে উঠেছে। কিডনিদাতা ও গ্রহীতার ওষুধের মূল্য হ্রাস এবং মস্তিষ্কের মৃত্যুর (ব্রেন ডেথ) পর তার বিভিন্ন অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ অসুস্থ ব্যক্তির দেহে সংযোজনের সুযোগ রেখে আইন তৈরি করা দরকার।
কিডনি বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক ডা. এম এ সামাদ বলেন, বিশ্বব্যাপী কিডনি রোগের হার অত্যন্ত ব্যাপক। বাংলাদেশে প্রায় ২ কোটি লোক কোনো না কোনোভাবে কিডনি রোগে আক্রান্ত। কিডনি বিকলের চিকিৎসা অত্যন্ত ব্যয়বহুল, এ কারণে এদেশের শতকরা ১০ ভাগ রোগীও চিকিৎসা চালিয়ে যেতে পারে না। অর্থাভাবে অকালে প্রাণ হারায় বেশিরভাগ।
পক্ষান্তরে, একটু সচেতন হলে ৫০ থেকে ৬০ ভাগ ক্ষেত্রে কিডনি বিকল প্রতিরোধ সম্ভব। এজন্য প্রয়োজন প্রাথমিক অবস্থায় কিডনি রোগের উপস্থিতি ও এর কারণ শনাক্ত করে তার চিকিৎসা।
কিডনি ফাউন্ডেশন হাসপাতাল ও রিসার্চ ইনস্টিটিউটের সভাপতি অধ্যাপক হারুন আর রশিদ ভোরের আকাশকে বলেন, পরিস্থিতি পরিবর্তনের জন্য চিকিৎসাকেন্দ্র ও চিকিৎসকের সংখ্যা বৃদ্ধির ওপর জোর দিতে হবে। কিডনি বিকল রোগীদের নিয়ে কিছুসংখ্যক অসাধু ব্যবসায়ী নিম্ন মানের ডায়ালাইসিস ব্যবসা চালিয়ে যাচ্ছে। দেশে বিপুুলসংখ্যক কিডনি রোগীর তুলনায় ডায়ালাইসিস সেন্টার খুবই কম, মাত্র ৯৬ এবং ১৮ হাজার রোগী এসব সেন্টারে সপ্তাহে দুই বার করে ডায়ালাইসিস পায়।
বেসরকারি সেন্টারগুলোয় সাড়ে তিন থেকে পাঁচ হাজার টাকা পর্যন্ত ডায়ালাইসিসের মূল্য বাবদ রাখা হয়। তিনি বলেন, সাউথ এশিয়ায় মোট কিডনি রোগীর মাত্র ১৫ শতাংশ রোগী ডায়ালাইসিসের সুযোগ পায়, বাকি বিপুলসংখ্যক রোগী অর্থাভাবে ডায়ালাইসিস নিতে পারে না। এজন্য বাংলাদেশে ডায়ালাইসিস খরচ কমাতে সরকারি- বেসরকারি বাস্তব উদ্যোগ নিতে হবে।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালক অধ্যাপক ডা. আবুল বাশার মোহাম্মদ খুরশীদ আলম ভোরের আকাশকে বলেন, আমাদের প্রতিষ্ঠিত কমিউনিটি ক্লিনিকগুলোর মাধ্যমে প্রাথমিক পর্যায়ে কিডনি রোগ শনাক্ত করা সম্ভব। এর ফলে দীর্ঘমেয়াদি কিডনি রোগ ও কিডনি বিকল হওয়ার ঝুঁকি হ্রাস পাবে। কিডনি রোগের সব আধুনিক চিকিৎসা এখন আমাদের দেশেই সফলভাবে সম্পন্ন হচ্ছে।
আমাদের সরকার জাতীয় কিডনি রোগ ইনস্টিটিউটে শয্যা সংখ্যা বৃদ্ধি করেছে এবং নতুন ভবন নির্মাণ করেছে। দেশের সব মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ৫০ শয্যাবিশিষ্ট ও জেলা সদর হাসপাতালে ১০ শয্যাবিশিষ্ট ডায়ালাইসিস সেন্টার স্থাপনের কাজ চলমান রয়েছে।
ভোরের আকাশ/নি
মন্তব্য