-->
শিরোনাম
বিশ্ব শিশু ক্যানসার দিবস আজ

ক্যান্সারে আক্রান্ত ৯০% শিশু চিকিৎসার আওতায় আসে না

নিখিল মানখিন
ক্যান্সারে আক্রান্ত ৯০% শিশু চিকিৎসার আওতায় আসে না

নিখিল মানখিন: দেশে যে হারে ক্যানসার আক্রান্ত শিশুর সংখ্যা বাড়ছে, তার মাত্র ১০ শতাংশেরও কম রোগী চিকিৎসার আওতায় আসছে। বাকি ৯০ শতাংশ ক্যানসার আক্রান্ত শিশু যথাযথ চিকিৎসার বাইরে থেকে যাচ্ছে বলে জানিয়েছেন ক্যানসার বিশেষজ্ঞরা। তারা বলছেন, প্রাপ্তবয়স্ক ক্যানসার রোগীদের তুলনায় শিশু ক্যানসার রোগীদের চিকিৎসা প্রদানের ক্ষেত্রে বাড়তি সাবধানতা অবলম্বন করতে হয়।

 

অনেক ক্ষেত্রে পাল্টাতে হয় চিকিৎসা পদ্ধতি। কিন্তু সে অনুযায়ী শিশু ক্যানসার রোগীদের জন্য দেশে প্রয়োজনীয় চিকিৎসক ও অবকাঠামো সংকট রয়ে গেছে। প্রাথমিক পর্যায়ে ধরা পড়লে শিশু ক্যানসারের ৭৫ শতাংশ নিরাময় করা সম্ভব বলে জানিয়েছেন চিকিৎসকরা। এমন অবস্থার মধ্যে আজ বুধবার পালিত হচ্ছে বিশ্ব শিশু ক্যানসার দিবস।

 

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের পেডিয়াট্রিক হেমাটোলজি অ্যান্ড অনকোলজি বিভাগের অধ্যাপক ডা. আফিকুল ইসলাম ভোরের আকাশকে বলেন, ২০১২ সালের আগে দেশে কতসংখ্যক ক্যানসার আক্রান্ত শিশু রয়েছে, তার কোনো তথ্য ছিল না। ২০১২ সালে আন্তর্জাতিক স্বাস্থ্য সংস্থার উদ্যোগে আমেরিকা ও কানাডা ইউনিভার্সিটি কলেজ হাসপাতালের সহায়তায় বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ে আলাদাভাবে ক্যানসার আক্রান্ত শিশুদের জন্য বিভাগ চালু হয়।

 

সেই থেকে ওই দুই কলেজ হাসপাতাল থেকে শিশু ক্যানসার বিশেষজ্ঞ ডাক্তার ও নার্স নানা সময়ে বাংলাদেশে এসে সংশ্লিষ্ট ডাক্তার ও নার্সদের প্রশিক্ষণ দিয়ে আসছে। অধ্যাপক ডা. আফিকুল ইসলাম বলেন, শিশুদের মধ্যে সবচেয়ে বেশি প্রবণতা ব্লাড ক্যানসারের, এরপরে রয়েছে ব্রেন টিউমার, বোন টিউমার ইত্যাদি। চিকিৎসায় ৫৮ শতাংশ রোগী সুস্থ হলেও বাকি ৪২ শতাংশ রোগীকে সুস্থ করা সম্ভব হয়নি। যদিও আশার বিষয়, শিশু ক্যানসারের ৭৫ শতাংশ নিরাময় করা সম্ভব।

 

পেডিয়াট্রিক হেমাটোলজি অ্যান্ড অনকোলজি বিভাগের চিকিৎসক সূত্রে জানা গেছে, বিভিন্ন সমীক্ষায় যেটা দেখা যাচ্ছে, সেটা বেশ আশ্চর্যজনক। ক্যানসার আক্রান্ত শিশুদের মাত্র ৫ শতাংশ বংশগত সূত্রে জিন মারফত ক্যান্সারে আক্রান্ত হয়। বাকি প্রায় ৯৫ শতাংশ কিন্তু জন্ম-পরবর্তীকালে পারিপার্শ্বিক কারণে ক্যান্সারে আক্রান্ত হচ্ছে।

 

শিশুদের মধ্যে সবচেয়ে বেশি প্রবণতা ব্লাড ক্যানসারের, যা শতকরা ৬০ শতাংশেরও ওপরে। অধিকাংশ ক্ষেত্রে চিকিৎসকরা ক্যানসার ধরতেই পারছেন না। এর কারণ শিশু ক্যানসারের আলাদা লক্ষণ, কখনো বা জ্বর, কখনো দেহে বিশেষ চিহ্ন বা মাড়ি থেকে রক্ত পড়া ইত্যাদি আলাদা উপসর্গ থেকে ক্যানসার দেখা দিচ্ছে।

 

জাতীয় ক্যানসার গবেষণা ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালের সাবেক পরিচালক অধ্যাপক ডা. মো. মোয়াররফ হোসেন ভোরের আকাশকে বলেন, ক্যানসার একটি জটিল রোগ, যার কোনো নির্দিষ্ট বয়সসীমা নাই। এখনো অনেকে মনে করেন, ক্যানসার বয়স্কদের রোগ, শিশুদের ক্যানসার হয় না, যা একটা ভুল ধারণা। এটি শুধু বয়স্কদের জন্য নয়, বরং শিশু-কিশোর থেকে শুরু করে যে কোনো বয়সেই হতে পারে।

 

বাংলাদেশের জনসংখ্যার প্রায় ৪৯ শতাংশই ১৮ বছরের নিচে শিশু-কিশোর। ক্যানসারের মতো জটিল রোগে তারাও আক্রান্ত হচ্ছে এবং প্রতি বছর দেশে অনেক সম্ভাবনাময় জীবন অকালে ঝরে পড়ছে। সঠিক চিকিৎসায় শিশুদের অনেক ক্যানসার সম্পূর্ণ নিরাময় যোগ্য। আমাদের দেশসহ পৃথিবীর অনেক দেশে সংক্রামক রোগে শিশুমৃত্যুর হার কম। দেশে যে হারে ক্যানসার আক্রান্ত শিশুর সংখ্যা বাড়ছে, তার মাত্র ১০ শতাংশেরও কম রোগী চিকিৎসার আওতায় আসছে। বাকি ৯০ শতাংশ ক্যানসার আক্রান্ত শিশু যথাযথ চিকিৎসার বাইরে থেকে যাচ্ছে।

 

এদিকে, ওয়ার্ল্ড চাইল্ড ক্যানসারের হিসাব অনুযায়ী বর্তমানে বাংলাদেশে প্রায় ১২ লাখ ক্যানসার রোগী রয়েছে। এর মধ্যে প্রতি বছর শনাক্ত হচ্ছে প্রায় ১৩ হাজার নতুন শিশু ক্যানসার রোগী। দেশে ক্যানসার রোগীর তুলনায় বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক, নার্স ও টেকনোলজিস্টের সংখ্যাও কম। চিকিৎসাও খুব ব্যয়বহুল। ফলে সব ক্যানসার রোগীকে চিকিৎসা দেয়া সম্ভব হয় না।

 

বাংলাদেশ ক্যানসার সোসাইটির সভাপতি অধ্যাপক ডা. মোল্লা ওবায়েদুল্লাহ বাকী ভোরের আকাশকে বলেন, দেশে প্রায় ১২ লাখ ক্যানসার রোগী রয়েছে। প্রতি বছর প্রায় আড়াই লাখ নতুন ক্যানসার রোগী শনাক্ত করা হচ্ছে। আক্রান্তদের মধ্যে আবার চার থেকে পাঁচ শতাংশ শিশু রয়েছে। অর্থাৎ ১২ থেকে ১৩ হাজার শিশু। যদি শিশুর বয়স ১৮ বছর পর্যন্ত ধরা হয়, তাহলে আক্রান্তের সংখ্যা হবে ১২ থেকে ১৮ হাজার। আমাদের দেশে শিশু ক্যানসার রোগীর তুলনায় বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক, নার্স ও টেকনোলজিস্টের সংখ্যাও কম। ফলে সব ক্যানসার রোগীকে চিকিৎসা দেয়া সম্ভব হয় না বলে জানান অধ্যাপক ডা. মোল্লা ওবায়েদুল্লাহ বাকী।

 

ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের পেডিয়েট্রিক হেমাটোলাজি অ্যান্ড অনকোলজি (শিশু রক্তরোগ ও ক্যানসার) বিভাগের বিভাগীয় প্রধান অধ্যপক ডা. জোহরা জামিলা খান। তিনি সাংবাদিকদের বলেন, বাবা যদি কর্মক্ষেত্রে রাসায়নিকের সংস্পর্শে আসে, তাহলে শিশুদের ক্যানসার নিয়ে জন্মানোর ঝুঁকি থাকে। গর্ভাবস্থায় মা ধূমপান বা অ্যালকোহল গ্রহণ করলে শিশু গর্ভাবস্থাতেই আক্রান্ত হতে পারে। এছাড়া খাদ্য উৎপাদনে কীটনাশকের অতিরিক্ত ব্যবহার, খাবারে ফরমালিনের ব্যবহারসহ নানা কারণে শিশুর ক্যানসার হতে পারে।

 

ডা. জামিলা আরো বলেন, বাংলাদেশে শিশুদের ক্যানসার আক্রান্তের হার বাড়লেও সেই অভিভাবক পর্যায়ে অসচেতনতার কারণে শুরুতেই সেটি শনাক্ত হয় না। ফলে দীর্ঘদিন নানা অপচিকিৎসায় জটিল আকার ধারণ করে। তবে শুরুতে এটি শনাক্ত করা গেলে ৭৩ শতাংশ শিশুই প্রাথমিক পর্যায়ে সুস্থ হতে পারে। বাকি ২৫ শতাংশ শিশুর ক্ষেত্রে উন্নত চিকিৎসার দরকার হতে পারে।

 

শিশু ক্যানসারের লক্ষণ সম্পর্কে ডা. জোহ্রা জামিলা খান বলেন, শিশুর ক্যানসার শনাক্তে সবচেয়ে বেশি ভ‚মিকা রাখতে পারেন মা। বাচ্চার সবসময় খেয়াল রাখতে হবে যে, শরীরের স্বাভাবিক অবস্থার কোনো পরিবর্তন হচ্ছে কিনা। চোখের রংয়ের পরিবর্তন, শরীরের কোথাও সামান্য ফুলে যাওয়া, ত্বকের স্বাভাবিক রং পরিবর্তন হওয়া, গলার দুই পাশে বা পেটে চাকা ধরে ফুলে যাওয়া, বাচ্চার অন্ড কোষ কোনোভাবে কমে যাওয়া এসব লক্ষণ দেখা দিলে দ্রæত চিকিৎসকের কাছে নিতে হবে বলে জানান ডা. জামিলা খান।

 

বাংলাদেশ ক্যানসার সোসাইটি জানায়, দেশে হাতেগোনা যে কয়েকটি হাসপাতালে শিশুদের ক্যানসারের চিকিৎসা হচ্ছে, সেগুলো ঢাকাকেন্দ্রিক। বড় বেসরকারি হাসপাতালগুলোতে চিকিৎসাব্যবস্থা থাকলেও তা ব্যয়বহুল। তাই সারা দেশ থেকে ঢাকায় এসে সরকারি হাসপাতালে ক্যানসারের দীর্ঘমেয়াদি চিকিৎসা অনেকটা কঠিন হয়ে পড়ে।

 

দেশে বর্তমানে সরকারি মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল রয়েছে ৩৩টি। এগুলোর মধ্যে শিশু হেমাটোলজি ও অনকোলজি বিভাগ রয়েছে ৮টিতে। সেগুলোতে সব মিলিয়ে শিশু ক্যানসার চিকিৎসকের সংখ্যা ৪০ জনের বেশি নয় বলে জানিয়েছেন জাতীয় ক্যানসার গবেষণা ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালের অধ্যাপক মমতাজ বেগম।

 

এর বাইরে জাতীয় ক্যানসার গবেষণা ইনস্টিটিউট ও হাসপাতাল, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় (বিএসএমএমইউ) এবং ঢাকা শিশু হাসপাতালে এই চিকিৎসাসেবা দেয়া হয়।

 

ক্যান্সারে আক্রান্ত শিশুদের পূর্ণাঙ্গ চিকিৎসায় দরকার তিনটি সুবিধা কেমোথেরাপি, রেডিওথেরাপি ও অস্ত্রোপচার। ঢাকা মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতাল, জাতীয় ক্যানসার গবেষণা ইনস্টিটিউট ও হাসপাতাল এবং বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ে (বিএসএমএমইউ) ছাড়া এসব সুবিধা আর কোনো সরকারি হাসপাতালে নেই।

 

ভোরের আকাশ/নি 

মন্তব্য

Beta version