নিখিল মানখিন: স্বাস্থ্য ও চিকিৎসাসেবার ব্যাপক উন্নতি ঘটলেও দেশে রোগে মৃত্যুহার বৃদ্ধি অব্যাহত রয়েছে বলে জানিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা। বার্ষিক সরকারি পরিসংখ্যানেও একই চিত্র পাওয়া গেছে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, দেশের স্বাস্থ্য ও চিকিৎসাসেবার মান বহুগুণ বেড়েছে। স্বাস্থ্য সচেতন হয়ে উঠেছে দেশের মানুষ। সুযোগ হাতের নাগালে থাকায় রোগের প্রাথমিক পর্যায়েই রোগীরা চিকিৎসাসেবা নিতে পারছেন। কিন্তু রোগে মৃত্যুহার বেড়ে যাওয়ায় উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন বিশেষজ্ঞরা।
সরকারি প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) সর্বশেষ জরিপে দেখা গেছে, গত ২০২০ সালে সারা দেশে নানা রোগে ৮ লাখ ৫৪ হাজার ২৫২ জন মারা গেছেন। ২০১৯ সালের তুলনায় মৃত্যু বেড়েছে ৩১ হাজার ৪১২ জনের। ২০১৯ সালে ৮ লাখ ২২ হাজার ৮৪১ জন মারা যান। জরিপে বলা হয়, এক বছরের ব্যবধানে দেশে ব্রেইন স্ট্রোক বা মস্তিষ্কে রক্তক্ষরণজনিত মৃত্যু দ্বিগুণ হয়ে গেছে। ব্রেইন স্ট্রোকের পাশাপাশি আশঙ্কাজনকভাবে বেড়েছে হৃদরোগ বা হার্ট অ্যাটাকে মৃত্যুও। ২০২০ সালে হৃদরোগ আক্রান্ত হয়ে ১ লাখ ৮০ হাজার ৪০৮ জন মারা গেছেন। আগের বছর এ রোগে মারা যান ১ লাখ ৪৭ হাজার ২৫৯ জন। জরিপের তথ্যানুযায়ী, লিভার ক্যানসারেও মৃত্যুর সংখ্যা বেড়েছে। ২০২০ সালে এ রোগে আক্রান্ত হয়ে মারা গেছেন ২৯ হাজার ৮৫০ জন। ২০১৯ সালে এ রোগে আক্রান্ত হয়ে মৃত্যু হয়েছিল ২১ হাজার ৩৭৪ জনের। সারা দেশে ২ হাজার ১১২টি অঞ্চল থেকে বিবিএসের নিজস্ব প্রতিনিধিদের মাধ্যমে তথ্য সংগ্রহ করে প্রতিবেদনটি তৈরি হয়েছে বলে জানান সচিব। ডেঙ্গু, পোলিও, ডিপথেরিয়া, জলাতঙ্কসহ নানা কারণে মানুষের মৃত্যু কমে এলেও হার্ট অ্যাটাকসহ বিভিন্ন কারণে মৃত্যুহার বেড়েছে বলে জরিপে বলা হয়।
বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকরা বলছেন, স্বাস্থ্য ও চিকিৎসাসেবার ব্যাপক উন্নতি ঘটেছে। কিন্তু বিস্ফোরক জনসংখ্যার বিপরীতে এ সেবা প্রাপ্তিতে সংকট রয়েই গেছে। অর্থ সংকটে মাঝপথে থেমে যাচ্ছে জটিল রোগে আক্রান্ত অধিকাংশ রোগীর চিকিৎসা। রাষ্ট্রীয় চিকিৎসা-সুবিধার অপর্যাপ্ততা এবং দরিদ্রতা ও অসচেতনতার কারণে প্রাথমিক পর্যায়ে রোগ শনাক্ত হয় না অধিকাংশ রোগীর। দেরিতে শনাক্ত হওয়ায় চিকিৎসা গ্রহণ করে রোগমুক্তি হওয়ার সুযোগ পায় না অনেক রোগী।
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ^বিদ্যালয়ের মেডিসিন অনুষদের সাবেক ডিন এবং প্রধানমন্ত্রীর ব্যক্তিগত চিকিৎসক অধ্যাপক ডা. এবিএম আব্দুল্লাহ ভোরের আকাশকে বলেন, শুধু বাংলাদেশে নয়, অত্যাধুনিক চিকিৎসাব্যবস্থা সমৃদ্ধ বিশে^র অনেক দেশেও রোগে মৃত্যু কমেনি। বাংলাদেশে এখনো বহু মানুষ খুব অল্প বয়সে মারা যাচ্ছেন এবং তা হচ্ছে প্রতিরোধযোগ্য নানা কারণে। ৭০ শতাংশের বেশি মানুষ অনিরাময়যোগ্য, ক্রনিক বা দীর্ঘমেয়াদি রোগে মারা যান। এসব রোগ মানুষ থেকে মানুষে সংক্রমিত হয় না এবং সাধারণত আরোগ্য লাভের গতি খুব ধীর। এককভাবে সবচেয়ে বড় জীবননাশকারী রোগ কার্ডিওভাসকুলার ডিজিজ বা হৃদরোগ, যা হৃৎপিণ্ড এবং ধমনিকে ক্ষতিগ্রস্ত করে এবং প্রতি তিনটি মৃত্যুর জন্য এ রোগ দায়ী। দ্বিতীয় প্রধান কারণ ক্যানসার, যা প্রতি ছয়জনের মধ্যে একজনের মৃত্যুর জন্য দায়ী। এছাড়া অন্যান্য অসংক্রামক রোগ যেমন ডায়াবেটিস, শ^াসতন্ত্রের নির্দিষ্ট কিছু রোগ এবং ডিমেনশিয়া জীবন কেড়ে নেয়া রোগের তালিকার শীর্ষে রয়েছে। এখনো প্রতিরোধযোগ্য রোগে যে সংখ্যায় লোক মারা যাচ্ছেন, সে বিষয়টি আরো বেশি হতাশার। তবে মানুষ আগের চেয়ে বেশিদিন বাঁচতে পারছে, যদিও কিছু মানুষ বিশেষ করে শিশুরা প্রতিরোধযোগ্য অসুখে মারা যাচ্ছেন। এটাও সত্য, এখনো বহু পথ পাড়ি দিতে হবে। স্যানিটেশন, পরিচ্ছন্নতা, পুষ্টি এবং মৌলিক স্বাস্থ্যবিধি বিষয়ে আরো উন্নতি এসবই এজন্য গুরুত্বপূর্ণ। চলমান স্বাস্থ্য খাতের উন্নতি চালিয়ে যেতে হলে কী কী কারণে মানুষ মারা যাচ্ছেন, সেটা জানা খুবই গুরুত্বপূর্ণ।
স্বাধীনতা চিকিৎসক পরিষদের (স্বাচিপ) সাবেক মহাসচিব অধ্যাপক ডা. এমএ আজিজ ভোরের আকাশকে বলেন, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে স্বাস্থ্য সেক্টরে এসেছে অভূতপূর্ব সাফল্য। স্বাস্থ্যবিষয়ক সহস্রাব্দ উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা (এমডিজি) অর্জন করে টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা (এসডিজি) অর্জনেও বাংলাদেশের প্রশংসনীয় অগ্রগতি হয়েছে। স্বাস্থ্য সেক্টরের এসডিজি অর্জনের অনেক ইতিবাচক উপসর্গ ইতোমধ্যে দৃশ্যমান হয়ে উঠেছে। দেশের সর্বত্র বিস্তার লাভ করেছে ডিজিটাল স্বাস্থ্যসেবার নেটওয়ার্ক। এমন মজবুত অবকাঠামোর ওপর দাঁড়িয়ে বাংলাদেশের স্বাস্থ্যসেবা প্রদানের মাত্রার ব্যাপক বিস্তার ঘটেছে। বাংলাদেশের স্বাস্থ্যসেবার অবকাঠামো বিশে^র উন্নয়নশীল দেশের মডেল হয়ে দাঁড়িয়েছে। এমন ভিত্তির ওপর দাঁড়িয়ে করোনা মহামারি মোকাবিলায় বাংলাদেশের ব্যাপক সফলতা বিশ^বাসীর নজর কেড়েছে। স্বাস্থ্য খাতের ব্যাপক অর্জনের জন্য ৩টি জাতিসংঘ পুরস্কারসহ ১৬টি আন্তর্জাতিক পুরস্কার ও সম্মাননা অর্জন করেছে বাংলাদেশের স্বাস্থ্য খাত। এত অর্জন থাকার পরও রোগে মৃত্যুহার বাড়তেই পারে। দেশের সব মানুষ আজ স্বাস্থ্য ও চিকিৎসাসেবার আওতায় এসেছে। রোগের পরীক্ষা-নিরীক্ষার ক্ষেত্রও বেড়েছে। ফলে আগের তুলনায় রোগ শনাক্তের মাত্রার হারও বেড়েছে। এতে রোগে মৃত্যুর চিত্রও আগের তুলনায় বেশি প্রকাশিত হচ্ছে। এর আগেও নানা রোগে অনেক মানুষ মারা গেলেও শনাক্ত করার সুযোগ কম থাকায় জানা সম্ভব হয়ে ওঠেনি বলে জানান ডা. আজিজ।
স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালেক সম্প্রতি সাংবাদিকদের বলেন, দেশব্যাপী একটি ব্যাপকভিত্তিক স্বাস্থ্যসেবা নেটওয়ার্ক গড়ে তোলা হয়েছে। জনস্বাস্থ্যের উন্নয়নে সরকারের সমন্বিত কর্মপরিকল্পনা রয়েছে। একটি সুস্থ জাতি গড়ে তোলার লক্ষ্যে ক্লিনিক চালু করা হয়েছে। এসব ক্লিনিকে প্রশিক্ষিত স্বাস্থ্যকর্মী নিয়োগ দেয়া হয়েছে। তাদের দেয়া হয়েছে ল্যাপটপ ও ইন্টারনেট সংযোগ। রোগীদের বিনামূল্যে ওষুধ দেয়া হচ্ছে। আর চালু করা হয়েছে ই-হেলথ ও টেলিমেডিসিন সেবা কার্যক্রম। জনবল বৃদ্ধি, অবকাঠামোর উন্নয়ন, মাতৃ ও শিশু মৃত্যু হ্রাস, ওষুধের সরবরাহ বৃদ্ধি, কমিউনিটি ক্লিনিক চালু , স্বাস্থ্য খাতে ডিজিটাল কার্যক্রম ইত্যাদি উন্নয়নমূলক উদ্যোগ গ্রহণ ও বাস্তবায়ন করে যাচ্ছে সরকার। স্বাস্থ্যকর্মী, প্রাইমারি, সেকেন্ডারি, টারসিয়ারি ও বিশেষায়িত হাসপাতাল এবং উভয়মুখী রেফারেন্স পদ্ধতি প্রবর্তন করেছি, যা বিশ্বে সামাজিক, অর্থনৈতিক ও পরিবেশগত বিষয়গুলোকে কর্মপরিকল্পনায় গুরুত্ব দেয়া হয়েছে। দেশে গড়ে উঠেছে ডিজিটাল স্বাস্থ্যসেবার মজবুত অবকাঠামো। স্বাস্থ্য খাতে সাফল্য অর্জনের মাধ্যমে দেশের জনগণের প্রতি নিজেদের অঙ্গীকার পূরণ করছে বর্তমান সরকার। আর সর্বজনীন স্বাস্থ্য সুরক্ষা করতে নিজেদের দেয়া প্রতিশ্রুতি বাস্তবায়নেও সরকার সবসময় আন্তরিক।
ভোরের আকাশ/আসা
মন্তব্য