-->

কার নির্দেশে আনিছুর ফের ঢামেকে?

আরিফ সাওন
কার নির্দেশে আনিছুর ফের ঢামেকে?
ঢামেকে ডিউটি বাদ দিয়ে আনিছুর রহমানের জন্মদিন পালন। (-ছবি-সংগৃহিত)

আরিফ সাওন: বদলি আদেশের দুইদিন বাদেই দিলেন মামলা ঠুকে। আবার কয়েকমাস পরই মামলাও নিলেন প্রত্যাহার করে। কিন্তু যাননি বদলিকৃত কর্মস্থলে। রয়েছেন ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ (ঢামেক) হাসপাতালে। স্বাক্ষরও করে গেছেন পুরোনো কর্মস্থল ঢামেকের হাজিরা খাতায়। ডিউটিরত নার্সদের নিয়ে ঢামেকের ছাদে জন্মদিনও পালন করেছেন ঘটা করে। এজন্য ঢামেক কর্তৃপক্ষ ব্যাখ্যা চেয়ে তাকে চিঠিও দেয়। বদলির আদেশের পর এভাবেই কেটে গেছে ১৫ মাস। অথচ বদলি করা কর্মস্থলে যোগদান করেননি তিনি। এতোদিন বদলিকৃত কর্মস্থলে যোগদান না করলেও কর্তৃপক্ষ ছিলেন নিশ্চুপ। অথচ অদৃশ্য হাতের ইশারায় সেই ব্যক্তিকেই গত ১২ ফেব্রুয়ারি ফের বদলি করা হয়েছে ঢামেক হাসপাতালে।

 

যাকে নিয়ে এতো কথা, তিনি হলেন সিনিয়র স্টাফ নার্স মো. আনিছুর রহমান। তিনি সরকার দলীয় নার্সিং সংগঠন স্বাধীনতা নার্সেস পরিষদের (স্বানাপ) ঢামেক শাখার সদস্য সচিব হিসেবে নিজেকে পরিচয় দেন। সরকারের নির্দেশনাকে দেখান বৃদ্ধাঙ্গুলী। উর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষ, এমনকি খোদ নার্সিং ও মিডওয়াইফারি অধিদপ্তরকেও দেন না পাত্তা।

 

আনিছুরকে ঢামেকে বদলির বিষয়ে প্রস্তাবনা পাঠানো হয়নি বলে দাবি করেছে নার্সিং ও মিডওয়াইফারি অধিদপ্তর। তবুও ঢামেকে  তাকে বদলি করে আদেশ জারি করতে হয়েছে।

 

আনিছুর রহমানের বদলির প্রসঙ্গে নার্সিং ও মিডওয়াইফারি অধিদপ্তরের মহাপরিচালক মো. এনামুল হক বলেন, ‘এ বিষয়ে কথা বলার এখতিয়ার আমার নেই। আমরা যা করি সচিব স্যারের নির্দেশনায়ই করি। আমরা প্রস্তাব পাঠাই, সচিব স্যার তা এগ্রি করেন।’ 

 

‘তাকে ঢামেকে রাখার বিষয়ে আপনারা কি কোনো প্রস্তাব দিয়েছিলেন’- এমন প্রশ্নে তিনি বলেন, ‘আমাদের পক্ষ থেকে ঢাকা মেডিক্যালে তাকে রাখার কোনো প্রস্তাবনা ছিলো না। সচিব স্যারও চাননি, স্যার অন্য জায়গা দিতে চেয়েছিলেন। পরে কোনো রিকোয়েস্টে স্যার করতে বাধ্য হয়েছেন।’

এবিষয়ে স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের স্বাস্থ্য সেবা বিভাগের সচিব ড. মু আনোয়ার হোসেন হাওলাদার বলেন, এ বিষয়ে আমার কিছু জানা নেই। দেখতে হবে। 'আপনার নির্দেশে নাকি হয়েছে'- এমন প্রশ্নে তিনি বলেন, একজন নার্সও আমার নির্দেশে কি বদলী করতে হয়? প্রস্তাবনার ভিত্তিতে বদলি করা হয়।

 

'তারা নাকি প্রস্তাব পাঠায়নি'- এমন প্রশ্নে তিনি বলেন, তাহলে আমাকে দেখে বলতে হবে। আমার জানা নেই।

 

তবে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক নার্স নেতা বলেন, আনিছুর রহমান স্বানাপের সদস্য সচিব পরিচয় দিলেও তিনি তা নন। ২০১৮ সালে স্বানাপের যে কাউন্সিল হয়, তাতে তিনি অংশগ্রহণই করেননি। তিনি ভূয়া পরিচয় দিয়েই নিয়ে থাকেন যত সুবিধা।

 

জানা গেছে- তিনি ছিলেন ঢামেকে সহকারী ট্রলি ম্যান। তারপর পাবনা মানসিক হাসপাতালে সহকারী নার্সের ছয়মাসের প্রশিক্ষণ নেন। এই প্রশিক্ষণের পর এরশাদ সরকারের আমলে সহকারী নার্স হিসেবে তার চাকরি হয়। পোস্টিং হয় ঢাকা মেডিক্যালে। পরে তিনি ঢাকা নার্সিং ইনস্টিটিউটে (বর্তমান ঢাকা নার্সিং কলেজ) ইনসার্ভিস ডিপ্লোমা কোর্স সম্মন্ন করেন। এরপর ২০১০ সালে সিনিয়র স্টাফ নার্স হিসেবে পদোন্নতি পান।

 

সরকারি তথ্যবিবরণী থেকে জানা গেছে, সবশেষ ২০২১ সালের ১৯ অক্টোবর আনিছুর রহমানকে ঢামেক হাসপাতাল থেকে হবিগঞ্জের আজমেরিগঞ্জ উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে সিনিয়র স্টাফ নার্স হিসেবে বদলি করা হয়। সেখানে যোগদান না করে দুইদিন পর ২১ অক্টোবর বদলি আদেশের বিরুদ্ধে ঢাকার প্রশাসনিক ট্রাইবুনাল-১ এ স্বাস্থ্যসেবা বিভাগের সচিব, নার্সিং ও মিডওয়াইফারি অধিদপ্তরের মহাপরিচালক এবং ঢামেক হাসপাতালের পরিচালককে বিবাদী করে একটি মামলা করে দেন।

 

২০২১ সালের ৪ নভেম্বর প্রশাসনিক ট্রাইবুনাল-১ এর আদেশে তিন মাসের জন্য আনিছুরের বদলি/পদায়ন স্থগিত করা হয়। এরপর ২০২২ সালের ২ ফেব্রুয়ারি আবার একই ট্রাইবুনাল মামলাটি নিষ্পত্তি না হওয়া পর্যন্ত তার বদলি/পদায়ন স্থগিত করেন।

 

কিছুদিন পর আনিছুর রহমান ঢাকার প্রশাসনিক ট্রাইবুনাল-১ এ দায়েরকৃত মামলাটি প্রত্যাহার করেন। কিন্তু যোগদান করেননি বদলিকৃত কর্মস্থলে। নিয়মিত তাকে দেখা গেছে ঢামেকে। ঢামেকের হাজিরা খাতায়ও তিনি স্বাক্ষর করেছেন।

 

আনিছুর রহমানের বিষয়ে সিদ্ধান্ত গ্রহণের জন্য গত ৪ জানুয়ারি স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের স্বাস্থ্যসেবা বিভাগের সচিব বরাবর ঢামেক হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ একটি চিঠি পাঠায়। সেখানে আনিছুর রহমানের কর্মকাণ্ডের বিবরণ উল্লেখ করে বলা হয়- এমতাবস্থায়, আনিছুর রহমানকে উর্ধতন কর্তৃপক্ষ কর্তৃক যে কর্মস্থলে পদায়ন করা হবে সে ব্যাপারে ঢামেক কর্তৃপক্ষের কোনো আপত্তি থাকবেনা।

 

গত ২৩ জানুয়ারি ছিলো আনিছুর রহমানের জন্মদিন। ঢামেকে পদায়ন না থাকলেও সেদিন সকালে ঢামেক হাসপাতালের পুরনো বিল্ডিংয়ের ছাদে কর্তব্যরত শতাধিক নার্সকে সঙ্গে নিয়ে কেকে কেটে ঘটা করে জন্মদিনও পালন করেন। এতে রোগীদের ভোগান্তিতে পড়তে হয়। বিব্রত হন চিকিৎসকরা। হঠাৎ করে তারা নার্স খুজে পাওয়া যাচ্ছিল না। ওইদিনই ঢামেক কর্তৃপক্ষ ব্যাখ্যা চেয়ে আনিছুর রহমান এবং ঢামেকের সেবা তত্ত্বাবধায়ক (মেট্রন) কারিমা খাতুনকে চিঠি দেয়।

 

কিন্তু কোনোতেই কিছু হচ্ছে না এই সিনিয়র নার্সের। অবশেষে গত ১২ ফেব্রুয়ারি নার্সিং ও মিডওয়াইফারি অধিদপ্তরের পরিচালক (প্রশাসন) মো. নাসির উদ্দিন (উপসচিব) স্বাক্ষরিত এক অফিস আদেশে আনিছুর রহমানকে পুনরায় ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে বদলি করা হয়। এতে অনেকেই বিস্ময় প্রকাশ করেছেন। বিজ্ঞপ্তিতে তার বর্তমান কর্মস্থল হিসেবে ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতাল এবং হবিগঞ্জের আজমেরীগঞ্জ উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সকে আদেশাধীন উল্লেখ করা হয়েছে।

 

ঢামেক হাসপাতালের হাজিরা খাতায় স্বাক্ষরের বিষয়টি স্বীকার করে মো. আনিছুর রহমান বলেন, গত ১২ ফেব্রুয়ারির পূর্ব পর্যন্ত আমি ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নার্সিং সুপারভাইজার হিসেবে কর্মরত ছিলাম। এজন্য স্বাক্ষর করেছি। ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ থেকেই আমাকে ঢাকা মেডিক্যাল কলেজে বদলি করা হয়েছে। গত ১৩ ফেব্রুয়ারি বদলি আদেশের কপি পেয়েছি। ১৪ ফেব্রুয়ারি তারিখে যোগদান করেছি।

 

ভোরের আকাশ/আসা

মন্তব্য

Beta version