-->
বন্ধের নির্দেশ প্রধানমন্ত্রীর

প্রেসক্রিপশন ছাড়াই বিক্রি হচ্ছে অ্যান্টিবায়োটিক

নিখিল মানখিন
প্রেসক্রিপশন ছাড়াই বিক্রি হচ্ছে অ্যান্টিবায়োটিক

নিখিল মানখিন: চিকিৎসকের প্রেসক্রিপশন ছাড়াই বিক্রি হচ্ছে অ্যান্টিবায়োটিক। মনিটরিংয়ে নেই দেশের ওষুধের দোকান। এক টুকরো কাগজে লেখা ওষুধের নাম দেখেই ক্রেতার হাতে তুলে দেয়া হচ্ছে অ্যান্টিবায়োটিক ওষুধ।

 

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (হু) ইতোমধ্যে চিকিৎসকের প্রেসক্রিপশন ছাড়া অ্যান্টিয়োটিক ওষুধ সেবনের ভয়াবহ ক্ষতিকর দিক সম্পর্কে সতর্কবার্তা দিয়েছে। দেশের বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকরাও প্রতিনিয়তই প্রয়োজন ছাড়া অ্যান্টিবায়োটিক ওষুধ না খাওয়ার পরামর্শ দিয়ে যাচ্ছেন। আর গত রোববার একটি অনুষ্ঠানে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাও চিকিৎসকের প্রেসক্রিপশন ছাড়া অ্যান্টিবায়োটিক ওষুধ বিক্রি না করার নির্দেশ দিয়েছেন।

 

অ্যান্টিবায়োটিক ওষুধের ওপর একটি গবেষণা পরিচালনা করেছে পরিবেশ বাঁচাও আন্দোলন (পবা)। রাজধানী ঢাকার বিভিন্ন হাসপাতালের রোগীদের ওপর এই গবেষণাটি পরিচালনা করা হয়। গবেষণা প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, দেশের প্রায় ৫৬ শতাংশ অ্যান্টিবায়োটিক ওষুধ কাজ করছে না।

 

রোগীদের দেহে অ্যান্টিবায়োটিক প্রতিরোধী ক্ষমতা বেড়েছে। জীবাণুর বিরুদ্ধে প্রথাগত অ্যান্টিবায়োটিক কাজে আসছে না। দেশের সরকার স্বীকৃত গবেষণাগারে এসব পরীক্ষা করা হয় বলে জানায় পবা।

 

আর বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা ও বিভিন্ন হাসপাতালের ওষুধ বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বিশ্বে যে পরিমাণ অ্যান্টিবায়োটিক তৈরি হচ্ছে, তার অর্ধেকই ব্যবহৃত হয় গবাদিপশু উৎপাদনে, যা মানুষের জন্য ব্যাপক স্বাস্থ্যঝুঁকি বয়ে আনছে। এভাবে বিভিন্ন কারণে বিশ্বে ওষুধ প্রতিরোধী জটিল আকার ধারণ করেছে। অনেক সংক্রামক রোগ খুব সহজে ভালো হচ্ছে না। একের পর এক ওষুধ অকেজো হয়ে যাচ্ছে।

 

চিকিৎসা ব্যবস্থাকে ব্যয়বহুল করে তোলার পাশাপাশি অকালে মৃত্যু ডেকে আনছে। পবার সাধারণ সম্পাদক লেনিন চৌধুরী ভোরের আকাশকে বলেন, মানবদেহে অ্যান্টিবায়োটিক প্রতিরোধী ক্ষমতা বৃদ্ধি মানবসভ্যতার জন্যই বিরাট হুমকি। শরীরে অপরিকল্পিত অ্যান্টিবায়োটিকের ব্যবহার এর অন্যতম কারণ। এছাড়া মুরগি ও মাছের খামারেও ব্যবহৃত অ্যান্টিবায়োটিকে এসব ঝুঁকি বাড়ছে।

 

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা জানিয়েছে, বিষয়টি জনস্বাস্থ্যের জন্য খুবই ঝুঁকিপূর্ণ এবং সব দেশের সরকার ও সমাজকে এ ব্যাপারে যথাযথ ব্যবস্থা নিতে হবে। অ্যান্টিবায়োটিকের নির্বিচার ব্যবহার এখন এমন স্তরে গেছে যে, এই প্রথমবারের মতো তারা এ ব্যাপারে সচেতনতা তৈরির জন্য একটি বৈশ্বিক প্রচারাভিযান শুরু করেছে।

 

এর উদ্দেশ্য হলো, মানুষকে এটা মনে করিয়ে দেয়া যে অ্যান্টিবায়োটিক-প্রতিরোধী ক্ষমতাসম্পন্ন ব্যাকটেরিয়ার সংখ্যা ক্রমশই বাড়ছে, তাই এটার ব্যবহারের ক্ষেত্রে সতর্ক হওয়া দরকার। তা না হলে ওষুধ হিসেবে এটা কার্যকারিতা হারিয়ে ফেলবে।

 

বাংলাদেশে গবাদিপশু উৎপাদনে অ্যান্টিবায়োটিকের ব্যবহার কতটা রয়েছে এবং তা মানবদেহের জন্য কী ধরনের ক্ষতি ডেকে আনতে পারেÑ এ সম্পর্কে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ওষুধ প্রযুক্তি বিভাগের অধ্যাপক আ ব ম ফারুক ভোরের আকাশকে বলেন, সমস্যাটা হলো প্রাণী দেহের জীবাণুর কারণে যে অসুখ হবে, তার জন্য প্রাণীদেহের নির্দিষ্ট অ্যান্টিবায়োটিক দিয়ে চিকিৎসা করতে হবে।

 

কিন্তু এখন যেটা হচ্ছে মানুষের জন্য নির্দিষ্ট অ্যান্টিবায়োটিক, সেগুলো দিয়ে প্রাণীর চিকিৎসা করা হচ্ছে। মানবদেহের অ্যান্টিবায়োটিক বেশি মাত্রায় কড়া এবং নতুন ধরনের হয়ে থাকে। বলা আছে, মানবদেহের অ্যান্টিবায়োটিক যেন প্রাণীদের না খাওয়ানো হয়। কিন্তু এখন সেটাই করা হচ্ছে।

 

আ ব ম ফারুক আরো বলেন, অনেক কোম্পানি আছে যারা ফিস ফিড, ক্যাটেল ফিড, পোলট্রি ফিড তৈরি করার সময় অ্যান্টিবায়োটিক মিশিয়ে দিচ্ছে। সেখানে মানুষের চিকিৎসার জন্য ব্যবহৃত অ্যান্টিবায়োটিক এবং পশুর চিকিৎসার জন্য নির্দিষ্ট অ্যান্টিবায়োটিক মিশিয়ে দেয়া হচ্ছে। ফলে জীবাণুর শরীরে অ্যান্টিবায়োটিক রেজিট্যান্স তৈরি হচ্ছে।

 

খাবারে অ্যান্টিবায়োটিক মিশিয়ে পশু মোটাতাজাকরণের সঙ্গে কি কোনো সম্পর্ক আছে এর উত্তরে অধ্যাপক আ ব ম ফারুক বলেন, কোম্পানিগুলো বলছে সামান্য পরিমাণ অ্যান্টিবায়োটিক মিশিয়ে দেয়ার ফলে গরু, মুরগি, মাছ রোগমুক্ত থাকবে, তাদের সুস্বাস্থ্য বজায় থাকবে এ বিষয়ে বৈজ্ঞানিক কোনো ভিত্তি নেই। কিন্তু ব্যবসায়িক দিক চিন্তা করে এ কাজটা করছে। শুধু আামদের দেশে নয়, সারাবিশ্বেও খামারিরা সরল বিশ্বাসে এগুলো কিনে নিচ্ছে।

 

আ ব ম ফারুক বলেন, যেসব পশুকে অ্যান্টিবায়োটিক খাওয়ানো হচ্ছে সেই পশুর রক্তের সংস্পর্শে, পশুর সংস্পর্শে আমরা সংক্রমিত হতে পারি। আরেকটা বিষয় হলো, যেসব পশুর শরীরে অ্যান্টিবায়োটিক রেজিট্যান্স জীবাণু তৈরি হয়েছে, তারা যে মল ত্যাগ করছে সেগুলো পরিবেশের সঙ্গে মিশে যাচ্ছে এবং সেখান থেকে অন্যান্য জিন ট্রান্সফরমেশন ঘটছে। এভাবে একটা মহামারি ব্যাপার নীরবে ঘটে যাচ্ছে কিন্তু আমরা টের পাচ্ছি না।

 

আমরা সে কারণে বলছি দুধ, মাছ, মাংস যাই খাই না কেন, এগুলোর মধ্যে সামান্য পরিমাণে অ্যান্টিবায়োটিক চলে আসছে। এর ফলে প্রধান ঝুঁকিটা হলো আমরা ওই অ্যান্টিবায়োটিক রেজিট্যান্স হয়ে যাই। এর ফলে সাধারণ সমস্যাগুলো অ্যান্টিবায়োটিক দিয়ে আর চিকিৎসা করা সম্ভব হবে না।

 

আমরা আশঙ্কা করছি, একটা সময় আসবে আমরা যদি এ সমস্যাগুলো বন্ধ না করি তাহলে অতি সাধারণ সংক্রমণে মানুষ মারা যাবে। ওষুধ প্রতিরোধী হয়ে ওঠার বিষয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন বাংলাদেশের বিজ্ঞ চিকিৎসকরাও।

 

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের মেডিসিন অনুষদের সাবেক ডিন, প্রধানমন্ত্রীর ব্যক্তিগত চিকিৎসক অধ্যাপক ডা. এবিএম আব্দুল্লাহ জানান, অ্যান্টিবায়োটিক ওষুধ বিশ্বব্যাপী অত্যন্ত সমাদৃত এবং চিকিৎসা ক্ষেত্রে যার অবদান অবিস্মরণীয়।

 

দুঃখের বিষয় হলেও সত্য যে, অপব্যবহারের কারণে অ্যান্টিবায়োটিক ওষুধের ক্ষমতা কোনো কোনো জীবাণু ধ্বংসের ক্ষেত্রে অকার্যকর হয়ে যাচ্ছে। বিশ্বের অন্যান্য দেশের তুলনায় আমাদের দেশেও অ্যান্টিবায়োটিকের ব্যবহার কম নয়।

 

মানুষ কোনো রোগ-ব্যাধিতে আক্রান্ত হলেই প্রাথমিকভাবে তার নিকটবর্তী দোকান থেকে ওষুধ কিনে খেতে পারে। ওষুধ কিনতে কোনো বাধ্যবাধকতা না থাকায় এবং ডাক্তারের কোনো প্রেসক্রিপশন না লাগায় মানুষ সহজেই এ কাজটি করছে। এটি হচ্ছে জনসচেতনতার অভাবে। ফলে অপরিমিত ও মাত্রাহীন ওষুধ খাওয়ার ফলে এর জীবাণুনাশক ক্ষমতা নষ্ট হয়ে যাচ্ছে।

 

অ্যান্টিবায়োটিকের অকার্যকারিতা রোধে এখনই ব্যবস্থা নেয়া দরকার জানিয়ে রুহুল হক বলেন, এ বিষয়ে আইন আছে। কিন্তু আইন প্রয়োগ করাটাই হচ্ছে কঠিন কাজ। ওষুধ প্রশাসন অধিদপ্তরের লোকবল বাড়ানো হলে এ বিষয়ে কিছুটা উন্নতি হবে বলে তিনি আশা প্রকাশ করেন।

 

রোববার অ্যান্টিবায়োটিক রেজিস্ট্যান্সের (এএমআর) ভয়াবহতার কথা উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেন, চিকিৎসকের প্রেসক্রিপশন ছাড়া অ্যান্টিবায়োটিক বিক্রি বন্ধ করতে হবে। এ লক্ষ্যে প্রয়োজনীয় নিষেধাজ্ঞা আরোপ করতে হবে।

 

প্রধানমন্ত্রী বলেন, বাংলাদেশের যত্রতত্র অ্যান্টিবায়োটিক কিনতে পাওয়া যায় এবং এটা বন্ধ করতে হবে। চিকিৎসকের ব্যবস্থাপত্র (প্রেসক্রিপশন) ছাড়া যাতে অ্যান্টিবায়োটিক বিক্রি না হয় এবং ওষুধটির যথাযথ প্রয়োগ হয়, সে হিসেবে এটি দিতে হবে।

 

অ্যান্টিবায়েটিকের যথাযথ ব্যবহার নিশ্চিতে সরকারের বিভিন্ন উদ্যোগের কথা উল্লেখ করে তিনি বলেন, বাংলাদেশ চেষ্টা করছে এই অ্যান্টিবায়োটিক যাতে যত্রতত্র বিক্রি না হয়।

 

প্রধানমন্ত্রী বলেন, আগে কমিউনিটি ক্লিনিকগুলো থেকে অ্যান্টিবায়োটিক দেয়া হতো, সেটা এখন বন্ধ করা হয়েছে। এ সময় অধ্যাপক টিমোথি ই ওয়ালশ বলেন, বর্তমান বিশ্বে অ্যান্টি মাইক্রোবিয়াল রেজিস্ট্যান্স-এএমআর মহামারি আকার ধারণ করেছে। এটা এখনই প্রতিরোধ করা না গেলে আগামীতে আরো ভয়াবহ রূপ নেবে এবং লাখ লাখ মানুষের প্রাণহানি ঘটাবে বলে জানান প্রধানমন্ত্রী।

 

এদিকে অভিযোগ রয়েছে, চিকিৎসকের প্রেসক্রিপশন ছাড়াই বিক্রি হচ্ছে অ্যান্টিবায়োটিক। মনিটরিংয়ে নেই দেশের ওষুধের দোকান। এক টুকরো কাগজে লেখা ওষুধের নাম দেখেই ক্রেতার হাতে তুলে দেয়া হচ্ছে অ্যান্টিবায়োটিক ওষুধ। ফার্মেসিতে নেই প্রকৃতি ফার্মাস্টিরা। কয়েক মাসের নামমাত্র প্রশিক্ষণ নিয়ে ওষুধ দোকানগুলোতে ফার্মাসিস্ট সেজে কাজ করে যাচ্ছেন অনেকে।

 

ফার্মাসিস্ট তো দূরের কথা, দেশের মোট ফার্মেসির প্রায় অর্ধেকই নানা প্রশ্নবাণে বিদ্ধ। অধিকাংশ দোকানের নেই লাইসেন্স। লাইসেন্স করে পরবর্তীতে হালনাগাদ করেনি এমন ফার্মেসির সংখ্যাও কম নয়। সব মিলিয়ে দেশের আনাচে-কানাচে গড়ে উঠেছে অসংখ্য অবৈধ ওষুধের দোকান এবং ওই দোকানে কাজ করছেন অনেক ভুয়া ফার্মাসিস্ট।

 

এভাবে মুনাফালোভীদের ওষুধ বিক্রির প্রতিযোগিতা বেড়ে যাওয়ায় প্রেসক্রিপশন ছাড়া ওষুধ বিক্রির মাত্রা বেড়ে গেছে।

 

ভোরের আকাশ/নি 

মন্তব্য

Beta version