চাকরি থেকে অব্যাহতি নেয়ার পর জলিয়াতির মাধ্যমে ১১ বছর বহাল তবিয়তে থাকার অভিযোগ রয়েছে জাতীয় হৃদরোগ ইনস্টিটিটিউটের চিকিৎসক ডা. ফাতেমা দোজার বিরুদ্ধে। যার সত্যতা যাচাইয়ে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় তদন্ত করছে । অভিযোগের বিষয়ে চিকিৎসককে নিজের পক্ষে প্রমাণাদিসহ তদন্ত কর্মকর্তার নিকট হাজির হয়ে লিখিত জবাব দিতে বলা হলেও তিনি গত দুই বছর ধরে মন্ত্রণালয়ের নির্দেশ অবজ্ঞা করে শৃংখলা ভঙ্গের বেপরোয়া খেলায় মেতে উঠেছেন।
জানা গেছে- তিনি বিধিবর্হিভূতভাবে চাকরিতে থাকার অভিযোগে তার বিরুদ্ধে তদন্ত চলছে। অভিযোগের সত্যতা যাচাইয়ের জন্য একাধিকবার ডাকার পরও তিনি মন্ত্রণালয়ের ডাকে সাড়া দেননি। নিজের পক্ষে কোন লিখিত জাবাবও দেননি। সেটি সরকারী কর্মচারী আচরণ বিধিমালা লঙ্ঘনের শাস্তিযোগ্য অপরাধ। ডা. ফাতেমা দোজা ২০০৭ সালে রেডিওলোজিস্ট পদে হৃদরোগ হাসপাতালে যোগ দেন। এরপর ২০১২ সালের ২০ ফেব্রুয়ারিতে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ে রেডিওলোজি অ্যান্ড ইমেজিং বিভাগে সহকারী অধ্যাপক পদে অস্থায়ী ভিত্তিতে ৬ মাসের জন্য নিয়োগ পান। ওই বছরের ২২ ফেব্রুয়ারি সরকারি চাকরি হতে অব্যাহতি চেয়ে হৃদরোগ ইনস্টিটিউটের তৎকালীন পরিচালকের মাধ্যমে স্বাস্থ্য সচিব বরাবর লিখিত আবেদন করেন। ২৩ ফেব্রুয়ারি স্বাস্থ্য মহাপরিচালক বরাবর তার অব্যাহতির আবেদন প্রেরিত হয়। অতঃপর তিনি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ে যোগদান করেন।
এদিকে নির্ধারিত মেয়াদের পরও বিএসএমএমইউ কর্তৃপক্ষ তার চাকরি স্থায়ী করেনি। ওই সময় তিনি বিভিন্ন বেসরকারি হাসপাতালেও প্র্যাকটিস করেন। চাকরি থেকে অব্যাহতি নেয়ার দেড় বছর পরে অব্যাহতির বিষয়টি গোপন করে অসাধু উপায়ে হৃদরোগ হাসপাতালে মেডিকেল অফিসার হিসেবে কর্মরত দেখিয়ে সহকারী অধ্যাপক হিসেবে পদোন্নতি প্রাপ্ত হয়ে ঐ হাসপাতালে ২০১৩ সালের ১১ জুন যোগদান করেন অনুরূপ ভাবে সহযোগী অধ্যাপক পদে পদোন্নতি নিয়ে একই হাসপাতালে ২০১৭ সালের ৩০ আগস্ট যোগদান করেন। অতঃপর ২০২১ সালে ২রা আগস্টে অধ্যাপক পদে পদোন্নতির জন্য স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় থেকে সুপিরিয়র সিলেকশন বোর্ডে ৩৪ জনের নামের তালিকা প্রেরিত হয় ঐ তালিকায় ডা ফাতেমার নাম ছিল ১৪ নং ক্রমিকে চাকরি হতে অব্যাহতি নেয়ার পরও তিনি একে একে পদোন্নতি পেয়েছেন, ভোগ করেছেন সকল সরকারী আর্থিক সুযোগ-সুবিধা।
সরকারী প্রচলিত বিধি মোতাবেক সরকারি চাকুরী হতে অব্যাহতি নেয়ার জন্য কেউ একবার আবেদন করলে সেটি সঙ্গে সঙ্গে গৃহীত বা মন্জুর হয়েছে বলে বিবেচিত হয়। তার এহেন জালিয়াতির অভিযোগ স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের নজরে আসলে ২০২১ সালের ২৭ ডিসেম্বর একটি তদন্ত কমিটি গঠন করে মন্ত্রণালয়ের তৎকালীন যুগ্ম-সচিব (প্রকল্প বাস্তবায়ন-১ শাখা) মিনা মাসুদ উজ্জামানকে তদন্তের দায়িত্ব দেন। ১৫ কর্ম দিবসের মধ্য প্রতিবেদন দাখিলের নির্দেশ দেয়। তদন্ত কর্মকর্তা ডা. ফাতেমার বিরুদ্ধে অভিযোগ বিষয়ে স্ব পক্ষে প্রমাণাদিসহ স্ব-শরীরের হাজির হয়ে লিখিত জবাব দিতে ২০২২ সালের ৫ জানুয়ারি লিখিত নির্দেশ দেন ঐ নির্দেশে ১০ জানুয়ারি হাজির হওয়ার জন্য বলা হয়। কিন্তু ওই তারিখে ডা. ফাতেমা সচিবালয়ে হাজির হননি। লিখিত জবাবও দাখিল করেননি। তদন্ত কর্মকর্তা দ্বিতীয়বার ১৮ জানুয়ারি লিখিত নির্দেশ দিয়ে ২৩ জানুয়ারি হাজির হওয়ার জন্য বলেন। এবারও ডা. ফাতেমা হাজির হননি। জবাবও দাখিল করেননি।
এদিকে সরকারের নিয়মিত কাজের অংশ হিসেবে তদন্ত কর্মকর্তাকে (মিনা মাসুদ উজ্জামান) ১৫ ফেব্রুয়ারি জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ বিভাগে বদলি করা হয়। তবে তদন্ত চলমান রাখতে ৭ মার্চ আরেক যুগ্ম সচিব মোহাম্মদ হেলাল হোসেনকে (উন্নয়ন অধিশাখা) দায়িত্ব দেওয়া হয়। নতুন কর্মকর্তা (তৃতীয়বারের মত) গত ২৯ মার্চ লিখিত নির্দেশ দিয়ে ৫ এপ্রিল সচিবালয়ে হাজির হওয়ার জন্য বলেন। এবারও ডা. ফাতেমা অনুপস্থিত থেকে লিখিত জবাবদানে বিরত থাকেন। এভাবে চতুর্থবারের মত ২২ নভেম্বর লিখিত নির্দেশ দিয়ে ৬ ডিসেম্বর হাজির হওয়ার জন্য বলা হয়। ওই দিন ডা. ফাতেমা হাজির হয়ে জবাব দেয়ার জন্য সময় চান।
এরইমধ্যে তিনি গত ২৭ নভেম্বর থেকে ৪ ডিসেম্বর যুক্তরাষ্ট্রের অনুষ্ঠেয় একটি আন্তর্জাতিক সেমিনারে যোগদানের আমন্ত্রণপত্রের শর্ত পরিবর্তন/ জালিয়াতি করে মন্ত্রণালয়ে উপস্থাপন করেন। এ ঘটনার তদন্তে সত্যতা পায় মন্ত্রণালয়। আমন্ত্রণ পত্রের সত্যতা যাচাইয়ের লক্ষে আয়োজক সংস্থাকে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় থেকে ইমেইল প্রেরণ করা হলে তারা জানান আমন্ত্রণ পত্রের শর্ত পরিবর্তন করা হয়েছে। স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় ডা. ফাতেমার এহেন কর্মকান্ডকে মন্ত্রণালয়কে বিভ্রান্ত করার চেষ্টা উল্লেখ করে সরকারী কর্মচারী শৃঙ্খলা বিধিমালা (বিধিমালা ২০১৮) অনুযায়ী শাস্তিযোগ্য অপরাধ করার কারণে ডা. ফাতেমা দোজার বিরুদ্ধে কেন বিভাগীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে না, তা সাত কর্মদিবসের মধ্যে জানানোর জন্য নির্দেশ দেওয়া হয়। গত ১৫ ডিসেম্বর উপসচিব মোহাম্মদ ইকবাল হোসেন স্বাক্ষরিত এ সংক্রান্ত কারণ দর্শানোর নোটিশ ডা. ফাতেমাকে দেওয়া হয়। অনুসন্ধানে জানা যায়, সাত কর্ম দিবসের মধ্যে ডা. ফাতেমাকে কারনণ দর্শানোর জবাব দিতে বলা হলেও দুইমাস পেরিয়ে গেলেও তিনি জবাব দেননি।
জবাব না দেয়ার বিষয়টি স্বীকার করে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের উপসচিব মোহাম্মদ ইকবাল হোসেন বলেন, মন্ত্রণালয়ে তিনি কোন লিখিত জবাব দেননি। তাকে দেয়া নির্দেশনার একটি কপি হাসপাতাল পরিচালককেও দেওয়া হয়েছে। পরিচালক চাইলে বিভাগীয় মামলা রুজ্জুর জন্য আমাদের কাছে লিখতে পারেন। আমরা আরও একবার তাকে (ডা. ফাতেমা) চিঠি দিব।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের একজন উর্দ্ধতন কর্মকর্তা বলেন, মন্ত্রণালয়ের নির্দেশ অমান্য করে ডা. ফাতেমা দোজা সারকারি আচরণ বিধিমালা লঙ্ঘন করেছেন। যা শাস্তিযোগ্য অপরাধ এজন্য তার বিরুদ্ধে বিভাগীয় মামলা দায়করণ পূর্বক গুরুদন্ডে দন্ডিত করা যায় ।
এসব বিষয়ে কথা বলার জন্য ডা. ফাতেমা দোজার সঙ্গে একাধিকবার যোগাযোগের চেষ্টা করা হলেও তিনি সাড়া দেননি। তার ব্যক্তিগত মুঠোফোনে কল করা ও খুদেবার্তা পাঠানো হলেও কোনো জবাব দেননি । তার কর্মস্থলে গিয়ে ও তার সাক্ষাত পাওয়া যায়নি।
ভোরের আকাশ/আসা
মন্তব্য