-->
শিরোনাম
করোনা শনাক্তের তিন বছর

নিয়ন্ত্রণে, কিন্তু ঝুঁকিমুক্ত নয়

নিখিল মানখিন
নিয়ন্ত্রণে, কিন্তু ঝুঁকিমুক্ত নয়

নিখিল মানখিন: বিশ্বে যতদিন সংক্রমণ অব্যাহত থাকবে, ততদিনই করোনাভাইরাসের নতুন ঢেউয়ের প্রবল আশঙ্কা থাকে বলে জানিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা। তারা বলছেন, বাংলাদেশের বর্তমান করোনা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে। কিন্তু পরবর্তী ঢেউয়ের বিষয়টি উড়িয়ে দেয়া যাবে না। বাংলাদেশে দৈনিক করোনা রোগী শনাক্তের হার এক শতাংশের নিচে এবং বিশ্বের অনেক দেশে শূন্যের কোঠায় গিয়েও নতুন ঢেউয়ের ভয়ংকর রূপ ধারণ করার ঘটনা রয়েছে। তাই করোনা প্রতিরোধ ও নিয়ন্ত্রণে উদাসীনতা দেখানো যাবে না বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা।

 

বিশ্বের অনেক দেশে করোনা পরিস্থিতি এখনো ওঠানামা করছে। নাজুক পরিস্থিতিতে রয়েছে চীন। কিন্তু সংক্রমণ হ্রাস পেলেই মানুষের স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলার ক্ষেত্রে উদাসীনতা, অবহেলা ও অজুহাত বেড়ে যায়। ফলে সেই দেশে সৃষ্টি হয় করোনার নতুন ঢেউ। আর এক দেশের ঢেউয়ের ছোঁয়া লাগে অন্য সব দেশেও। বেড়ে যায় করোনার প্রবল ঢেউয়ে আক্রান্ত দেশের সংখ্যা। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, দৈনিক পরিসংখ্যান অনুযায়ী বাংলাদেশে পরীক্ষা বিবেচনায় করোনা সংক্রমণের হার নিয়ন্ত্রণে রয়েছে। তবে এটা নিয়ে ঝুঁকিমুক্ত ভাবার কোনো কারণ নেই। তাছাড়া সারাবিশ্ব থেকে করোনা মহামারি দূর না হওয়া পর্যন্ত সংক্রমণ যেকোনো সময় বেড়ে যাওয়ার আশঙ্কা রয়েই যায়। দেশে দুর্বল প্রতিরোধ কার্যক্রমের পাশাপাশি স্বাস্থ্যবিধিও মানা হচ্ছে না। করোনার নমুনা পরীক্ষা করাতে আগ্রহ হারিয়ে ফেলেছে দেশের মানুষ। উপসর্গহীন রোগী এবং করোনা রোগীর অবাধ চলাফেরা দেশকে আরো বেশি করোনাঝুঁকিতে ফেলে দিচ্ছে বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা।

 

করোনাভাইরাসের আঘাতে জর্জরিত হয়েছে বিশ্বের অধিকাংশ দেশ। হ্রাস পাওয়ার কয়েক সপ্তাহ পরই হঠাৎ করে বেড়ে যায় সংক্রমণ। পরিসংখ্যানগতভাবে বাংলাদেশে করোনা পরিস্থিতির উন্নতি হয়েছে। তবে পরিসংখ্যানগত করোনার চিত্রে আশঙ্কামুক্ত থাকতে পারছেন না দেশের মানুষ। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা, বিভিন্ন জরিপ এবং দৈনিক রোগী শনাক্তের হার দেখিয়ে দিচ্ছে বাংলাদেশ এখনো করোনার প্রবল থাবা থেকে বের হয়ে আসতে পারেনি।

 

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, পৃথিবীর বিভিন্ন দেশেই করোনা সংক্রমণের হার কমে গিয়ে আবার বেড়েছে। বাংলাদেশেও ঘটেছে এমন ঘটনা। বিশ্লেষণে দেখা যায়, ২০২০ সালে সংক্রমণের ঊর্ধ্বমুখী প্রবণতা শুরু হয় এপ্রিলে। জুন পর্যন্ত সংক্রমণ উঠতে থাকে। জুলাই থেকে নিম্নমুখী প্রবণতা শুরু হয়। আগস্ট, সেপ্টেম্বর, অক্টোবর পর্যন্ত নিম্নমুখী থেকে নভেম্বরে আবার কিছুটা ঊর্ধ্বমুখী প্রবণতা শুরু হয়ে ডিসেম্বরে আবার কমতে শুরু করে। ২০২১ সালের জানুয়ারি, ফেব্রুয়ারি একেবারেই কমে গিয়ে মার্চে ঊর্ধ্বমুখী প্রবণতা শুরু হয়। এপ্রিলে অনেক বেড়ে যায়। মে মাসে কমে আবার জুন মাসে ঊর্ধ্বমুখী প্রবণতা জুলাই পর্যন্ত অব্যাহত থাকে। আগস্টে কমতে শুরু করে নভেম্বর পর্যন্ত কমে ডিসেম্বরের শেষের দিকে কিছুটা বাড়তে শুরু করে। আর ২০২২ সালের জানুয়ারির প্রথম সপ্তাহ থেকে অবনতি ঘটতে থাকে দেশের করোনা পরিস্থিতির। কিন্তু ওই বছরের জুন থেকে দেশে করোনা পরিস্থিতির উন্নতি অব্যাহত রয়েছে। বর্তমানে পরিস্থিতি অনেকটা সহনীয় পর্যায়ে রয়েছে। কিন্তু আমাদের করোনাভাইরাস বিষয়ে অসতর্ক হওয়ার কোনো সুযোগ নেই, বরং আমাদের আরো বেশি সচেতন এবং সতর্কতার ওপর জোর দেয়া উচিত।

 

সম্প্রতি এক আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যমকে দেয়া সাক্ষাৎকারে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মুখ্য বিজ্ঞানী সৌম্যা স্বামীনাথন বলেন, যেকোনো সময় একটা ভ্যারিয়েন্টের উদ্ভব হতে পারে এবং আমরা আবার আগের অবস্থায় ফিরে যেতে পারি। তাই সতর্ক থাকতে হবে। সাধারণ মানুষের সতর্কতাই করোনার বিরুদ্ধে লড়াই করার এক ও একমাত্র রক্ষাকবচ।

 

স্বামীনাথনকে প্রশ্ন করা হয়েছিল, মহামারির শেষ কবে। উত্তরে তিনি বলেন, ‘আমার মনে হয় না কেউ সেটা অনুমান করতে পারবে। মহামারি শেষ হয়ে গেছে, এটা ঘোষণা করা উচিত নয়, কিছু মানুষ যেমন করছে। সমস্ত সাবধানতা এখনই ঝেড়ে ফেললে বিপদ হবে। সাবধানতা চালিয়ে যেতে হবে বলে জানান স্বামীনাথন।

 

রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (আইইডিসিআর) উপদেষ্টা ডা. মুসতাক হোসেন ভোরের আকাশকে বলেন, বাংলাদেশের বর্তমান করোনা পরিস্থিতি অনেকটা সহনীয় পর্যায়ে রয়েছে। কিন্তু পরবর্তী ঢেউয়ের বিষয়টি উড়িয়ে দেয়া যাবে না। বাংলাদেশে দৈনিক করোনা রোগী শনাক্তের হার এক শতাংশের নিচে এবং বিশ্বের অনেক দেশে শূন্যের কোঠায় গিয়েও নতুন ঢেউয়ের ভয়ংকর রূপ ধারণ করার ঘটনা রয়েছে। তাই করোনা প্রতিরোধ ও নিয়ন্ত্রণে উদাসীনতা দেখানো যাবে না।

 

তিনি আরো বলেন, পৃথিবীর অনেক দেশেই করোনা সংক্রমণের ওঠানামার খেলা চলে আসছে। যখন করোনাভাইরাসের সংক্রমণ কমে যায়, তখন মানুষ অসতর্ক হয়ে যায়, ফলে সংক্রমণ পুনরায় বেড়ে যায়। আমরা এমনিতেই অসতর্ক, তাই দেশে সংক্রমণ আবার বেড়ে যেতে পারে। টিকা মৃত্যুর ঝুঁকি কমায়, সংক্রমণ ঠেকাতে পারে না। তাই টিকা গ্রহণ করলেই পুনরায় সংক্রমিত হবেন নাÑ এমন ভাবার কোনো কারণ নেই। যতক্ষণ পর্যন্ত পৃথিবী থেকে করোনাভাইরাস পুরোপুরি বিদায় না হবে ততদিন সংক্রমণের আশঙ্কা থাকবেই। সংক্রমণের হ্রাস-বৃদ্ধির খেলা চলবে।

 

আইইডিসিআরের সাবেক প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা এএসএম আলমগীর ভোরের আকাশকে বলেন, দেশের বর্তমান করোনা পরিস্থিতিকে আমরা কোনোভাবেই ঝুঁকিমুক্ত ভাবতে পারি না। কমে গিয়ে হঠাৎ প্রবল হয়ে ওঠার ঘটনা রয়েছে। তাই নির্দেশিত স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলার বিকল্প নেই। সবকিছু বিবেচনায় নিয়েই করোনা প্রতিরোধে কাজ করে যাচ্ছে সরকার। মানুষের স্বাস্থ্যবিধি মানার প্রবণতা কমলে কিছুদিন পরই সংক্রমণ বাড়তে দেখা যায়। স্বাভাবিক পরিস্থিতির দিকে যাচ্ছে তা বলার সময় আসেনি।

 

করোনা মোকাবিলার জন্য গঠিত জাতীয় টেকনিক্যাল পরামর্শক কমিটির সভাপতি অধ্যাপক ডা. মোহাম্মদ শহিদুল্লাহ ভোরের আকাশকে বলেন, করোনা মোকাবিলায় বাংলাদেশের সফলতা বিশ্বের অনেক উন্নত দেশকে পেছনে ফেলে দিয়েছে। বাংলাদেশের জনসংখ্যার ঘনত্ব প্রতি বর্গকিলোমিটারে ১২শ জনের বেশি। জনসংখ্যায় বিশ্বে বাংলাদেশের অবস্থান অষ্টম। তাই এক জায়গায় সংক্রমণ শুরু হলে সারা দেশে ছড়াতে খুব বেশি সময় লাগে না। দেশের করোনা পরিস্থিতিকে এখনো ঝুঁকিমুক্ত ভাবা ঠিক হবে না বলে জানান ডা. মোহাম্মদ শহিদুল্লাহ।

 

স্বাস্থ্য অধিদপ্তর জানায়, দেশে প্রথম করোনাভাইরাসে আক্রান্ত শনাক্ত হয় ২০২০ সালের ৮ মার্চ। এরপর থেকে ২০২৩ সালের ৮ মার্চ পর্যন্ত দেশে মোট করোনা শনাক্তের সংখ্যা ২০ লাখ ৩৭ হাজার ৮৯৩ জন এবং করোনায় মোট মৃতের সংখ্যা ২৯ হাজার ৪৪৫ জন। পরীক্ষিত মোট নমুনা সংখ্যা ১ কোটি ৫৩ লাখ ২০ হাজার ৫৬৯টি। বর্তমানে ল্যাবরেটরির সংখ্যা ৮৮৫টি।

 

অধিদপ্তর আরো জানায়, গত ২৪ ঘণ্টায় করোনা শনাক্তের হার শূন্য দশমিক ৪০ এবং সুস্থতার হার ৯৮ দশমিক ৪৫। মৃত্যুর ঘটনা নেই। অধিদপ্তর জানায়, বিভাগভিত্তিক বিবেচনায় ২০২৩ সালের ৮ মার্চ পর্যন্ত করোনায় মোট মৃতের মধ্যে ঢাকা বিভাগে ১২ হাজার ৯৪৪ জন, চট্টগ্রামে ৫ হাজার ৯০৬ জন, রাজশাহীতে ২ হাজার ১৬৩ জন, খুলনায় ৩ হাজার ৭৩৫ জন, বরিশালে ৯৯৩ জন, সিলেটে ১ হাজার ৩৬৪ জন, রংপুরে ৪২৯ জন এবং ময়মনসিংহ বিভাগে ৯১১ জন মারা গেছেন।

 

বয়সভিত্তিক পরিসংখ্যানে, করোনায় মোট মৃতের মধ্যে শূন্য থেকে ১০ বছর বয়সি শূন্য ৩১ শতাংশ, ১১ থেকে ২০ বছরের শূন্য দশমিক ৬৯ শতাংশ, ২১ থেকে ৩০ বছরের ২ দশমিক ৩২ শতাংশ, ৩১ থেকে ৪০ বছরের ৫ দশমিক ৯০ শতাংশ, ৪১ থেকে ৫০ বছরের মধ্যে ১১ দশমিক ৭১ শতাংশ, ৫১ থেকে ৬০ বছরের মধ্যে ২৩ দশমিক ২৫ শতাংশ, ৬১ থেকে ৭০ বছরের মধ্যে ৩০ দশমিক ৯০ শতাংশ, ৭১ থেকে ৮০ বছরের মধ্যে ১৭ দশমিক ৫২ শতাংশ, ৮১ থেকে ৯০ বছরের মধ্যে ৫ দশমিক ৯৩ শতাংশ, ৯১ থেকে ১০০ বছরের মধ্যে ১ দশমিক ২৯ শতাংশ এবং ১০০ বছরে বেশি বয়সি শূন্য দশমিক ১৩ শতাংশ।

 

স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালেক ভোরের আকাশকে বলেন, বাংলাদেশ পৃথিবীর অনেক উন্নত দেশের তুলনায় ভালোভাবে কোভিড-১৯ মোকাবিলা করেছে। এখনো অনেক দেশে চিকিৎসা দিতেও হিমশিম খাচ্ছে। কিন্তু আমরা এখন রোগী খুবই কম পাচ্ছি। আগে একটা ল্যাব ছিল। কিন্তু এখন সারা দেশে ল্যাব রয়েছে। যে কেউ চাইলেই নমুনা পরীক্ষা করাতে পারে এখন। হাসপাতালগুলোতেও অনেক উন্নতি আছে আমাদের। হাই ফ্লো নজল ক্যানোলা, অক্সিজেন প্লান্ট বসানো থেকে শুরু করা আমরা চিকিৎসক, নার্স ও অন্যান্য স্বাস্থ্যসেবা কর্মীদের সংখ্যাও বাড়িয়েছি।

 

তিনি বলেন, সংক্রমণ এমনিতেই তো আর কমে যায়নি। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় ও অধিদপ্তরের সবাই যেভাবে কাজ করেছে, তার ফসল বর্তমান পরিস্থিতি। কিন্তু তাও আমাদের সজাগ থাকতে হবে। জনগণকে স্বাস্থ্যবিধি মানার বিষয়ে প্রচারণা চালিয়ে যেতে হবে।

 

ভোরের আকাশ/আসা

মন্তব্য

Beta version