আরিফ সাওন: কাজ পাওয়ার জন্য আগেই কমিশন দিয়েছেন ১০ লাখ টাকা! কিন্তু তিনি কাজ পাননি। কাজ দেয়া হয়েছে অন্য একটি ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানকে। এরপর টাকা ফেরত চাইতে গেলে পরবর্তী একটি কাজ দিয়ে টাকা সমন্বয়ের আশ্বাস দেয়া হয়। কিন্তু সে কাজও তিনি পাননি। এমনই অভিযোগ ধ্রুব কথাচিত্র নামের একটি প্রতিষ্ঠানের স্বত্বাধিকারী মো. আশরাফুল আলমের। তিনি এ অভিযোগ দাখিল করেছেন দুর্নীতি দমন কমিশনে (দুদক)। তিনি লিখিতভাবে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের তিন কর্মকর্তার বিরুদ্ধে অভিযোগ দাখিল করে তাদের কাছ থেকে টাকা ফেরত চেয়েছেন। আবেদনে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের (লাইফস্টাইল, হেলথ এডুকেশন অ্যান্ড প্রমোশন) দশ কোটি টাকার স্বাস্থ্যসেবা প্যাকেজের কনসালট্যান্ট ও ঠিকাদার নিয়োগে দুর্নীতি ও অনিয়মের তদন্ত চাওয়া হয়েছে। পাশাপাশি দশ কোটি টাকার স্বাস্থ্যসেবা প্যাকেজের কনসালট্যান্ট ও ঠিকাদার নিয়োগ কার্যক্রম স্থগিত রাখার দাবি জানানো হয়েছে।
গত ৫ মার্চ দুদকে এ অভিযোগ জমা দিয়েছেন আশরাফুল। এর আগে স্বাস্থ্য সচিব বরাবর একই অভিযোগ দাখিল করেন তিনি। সেই আবেদনে তারিখ লেখা আছে ২২/০৩/২০২৩। অথচ ওই চিঠিটি গত ২৬ ফেব্রুয়ারি গ্রহণ করেছেন স্বাস্থ্য সচিব ড. মু. আনোয়ার হোসেন হাওলাদার । এক মাস পরের তারিখ দেয়া চিঠি কীভাবে স্বাস্থ্য সচিব আগেই গ্রহণ করলেন- এ বিষয়ে মো. আশরাফুল আলম ভোরের আকাশকে বলেন, ‘স্বাস্থ্য সচিবের কাছে করা আবেদনে তারিখ ভুল হয়েছে। ২২ মার্চের জায়গায় ২২ ফেব্রুয়ারি হবে।’
এ বিষয়ে টিআইবির নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান ভোরের আকাশকে বলেন, সরকারি কর্মকর্তা এবং ঠিকাদার উভয়পক্ষের যোগসাজশে দুর্নীতি করে লাভবান হওয়া ঘুষ গ্রহণ এবং দেয়ার চেয়েও গুরুতর অপরাধ। কেননা সরকারি কর্মকতা-কর্মচারী এবং ঠিকাদাররা মিলে সমঝোতার দুর্নীতির মাধ্যমে যেভাবে লাভবান হয়ে থাকেন, তাতে রাষ্ট্রেীয় সম্পদের আত্মসাৎসহ বহুমুখি ক্ষতি হয়, যার বোঝা জনগণকে বইতে হয়। সরকারি ক্রয় বিধির লংঘন হয়, উন্মুক্ত প্রতিযোগিতার মাধ্যমে ন্যায্য মুল্য নিশ্চিত করে ক্রয় ও সরবরাহ সম্পন্ন করার সুযোগ থেকে রাষ্ট্রকে বঞ্চিত করা হয়। রাষ্ট্রের সম্পদ বিনষ্ট হয়। যিনি কমিশন দেওয়ার কথা স্বীকার করেছেন, আর যে সরকারী কর্মকর্তারা তা নিয়ে কাজ দিতে চেয়েছেন, বা অধিকতর কমিশনে কাজ দিয়েছেন, এবং যাদের কাজ দেয়া হয়েছে সকল পক্ষই সমঝোতার দুর্নীতি করেছেন। সেজন্য দুদকের উচিত, সকল পক্ষকেই কঠোরভাবে জবাবদিহির মধ্যে আনা। অন্যথায় এ ধরনের সিন্ডিকেটের হাতে রাষ্ট্রকাঠামোর জিম্মি হওয়ার প্রক্রিয়া তরান্বিত হবে।
দুদক চেয়ারম্যান বরাবর দেয়া অভিযোগে বলা হয়েছে, ‘বিগত দুই অর্থবছর ধরে বর্তমান লাইন ডাইরেক্টর ডা. মো. মিজানুর রহমান আরিফ যোগদানের পর থেকে ১০ শতাংশ হারে কোটি টাকা কমিশন নিয়ে সিন্ডিকেটের মাধ্যমে নিজস্ব পছন্দের প্রতিষ্ঠানকে কাজ দিচ্ছেন। আর এ কমিশনের টাকা সংগ্রহের দায়িত্ব পালন করছেন দরপত্র মূল্যায়ন/অন্য কমিটির সভাপতি ডা. মো. শাখাওয়াত হোসেন, প্রোগ্রাম ম্যানেজার (টিএসডি) এবং দরপত্র মূল্যায়নের জন্য কমিটির সদস্য মো. মোখলেচুর রহমান, সহকারী প্রধান (কাঃ সঃ) ও ডেপুটি প্রোগ্রাম ম্যানেজার। এই দুই কর্মকর্তা বিগত ২০২১-২০২২ অর্থবছরে আমাকে একটি সার্ভিস প্যাকেজের কাজ দেয়ার কথা বলে আমার কাছ থেকে নগদ দশ লাখ টাকা কমিশন নেন। প্রকাশ থাকে যে, ওই দশ লাখ টাকা ফেরত না দিয়ে আমাকে ২০২২-২৩ অর্থবছরে আহ্বানকৃত প্যাকেজ নং-৭ প্রোডাকশন অব এসবিসিসি ম্যাটারিয়াল অ্যান্ড কমিউনিকেশন ইন্টারভেনশন ফর প্রিভেনশন ডায়বেটিসের প্রস্তাব দাখিলের পরামর্শ প্রদান করেন এবং আমাকে ওই কাজ দিয়ে তাদের নেয়া দশ লাখ টাকা সমন্বয় করে দেবেন।’
অভিযোগে আরো বলা হয়, ‘আমি বাধ্য হয়ে তাদের কথায় বিশ্বাস করে যথানিয়মে সব কাগজপত্র, অভিজ্ঞতা, দক্ষতা ও আর্থিক সক্ষমতা সংযুক্ত করি। এক্সপ্রেশন অব ইন্টারেস্ট (ইওআই) দাখিল করি। আমার এক্সপ্রেশন অব ইন্টারেস্ট (ইওআই) যাচাই-বাছাই করে আমাকে রিকোয়েস্ট ফর প্রোপোজাল প্রদান করেন। আমরা রিকোয়েস্ট ফর প্রপোজালের চাহিদা মোতাবেক সব তথ্যাদি সংযুক্ত করে Technical & Financial প্রস্তাব দাখিল করি। কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্য, আমার কাছ থেকে অগ্রিম নগদ দশ লাখ টাকা কমিশন নেয়ার পরও দরপত্র মূল্যায়ন ক্রয় কমিটির সভাপতি ডা. মো. শাখাওয়াত হোসেন এবং দরপত্র মূল্যায়ন ক্রয় কমিটির সদস্য মো. মোখলেছুর রহমান আমার Technical & Financial প্রস্তাব বিবেচনা না করে অধিক কমিশন গ্রহণ করে অযোগ্য, অদক্ষ ও ভুয়া প্রতিষ্ঠানকে ঊর্ধ্ব রেটে কাজ দিয়ে সরকারের কোটি কোটি টাকা আত্মসাৎ করছেন। আমি টাকা ফেরত চাইলে ওই দুই কর্মকর্তা আমার দশ লাখ টাকা ফেরত না দিয়ে আমাকে নানাভাবে হয়রানির চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন। সব প্যাকেজের কাগজপত্র তদন্ত করলে অনিয়ম ও দুর্নীতির আসল চিত্র সহজেই পাওয়া যাবে।’
অভিযোগে বলা হয়েছে, ‘দরপত্র মূল্যায়ন/ক্রয় কমিটির সভাপতি ডা. মো. শাখাওয়াত হোসেন এবং দরপত্র মূল্যায়ন ক্রয় কমিটির সদস্য মো. মোখলেছুর রহমান নগদ ৫০ লাখ টাকা কমিশন নিয়ে প্লে-ডক্টরস নামে একটি প্রতিষ্ঠানকে সব ভুয়া কাগজপত্রের ভিত্তিতে সরকারি ও বেসরকারি টেলিভিশন চ্যানেলে প্রচারের জন্য ৪.৫০ কোটি টাকার চুক্তি স্বাক্ষর করেন। পরে ২০২২-২৩ অর্থবছরে দরপত্র আহ্বান না করে পুনরায় ৫০ লাখ টাকা কমিশন নিয়ে এক বছর মেয়াদ বৃদ্ধি করে প্রচার কাজ চালিয়ে যাচ্ছেন এবং সরকারি টাকা আত্মসাৎ করে চলছেন। সরকারি ও বেসরকারি টেলিভিশন চ্যানেলে প্রচারের কাজের জন্য দরপত্র দলিলে চার কোটি টাকার কাজের অভিজ্ঞতা, আড়াই কোটি টাকার আর্থিক সক্ষমতা এবং এক বছরে সাড়ে তিন কোটি টাকার টার্নওভার চাওয়া হয়। এস কে শাহিন রহমানের প্লে-ডক্টরস নামক প্রতিষ্ঠানটির দেশের কোথায় চার কোটি টাকার প্রচার কাজসহ আর্থিক সক্ষমতা ও টার্নওভার আছে- এমন ইতিহাস কারো জানা নেই। ওই প্রতিষ্ঠানের দাখিলকৃত সব কাগজপত্র ভুয়া এবং নীলক্ষেত থেকে তৈরি করে দাখিল করা হয়।’
অভিযোগে আরো বলা হয়, ‘প্রকাশ থাকে যে, এস কে শাহিন রহমানের আরেকটি প্রতিষ্ঠান RIAND Bangladesh Limited একই কায়দায় ভুয়া এবং নীলক্ষেত থেকে তৈরি করা কাগজপত্র নিয়ে বিগত তিন বছর ধরে লাখ লাখ টাকা কমিশন দিয়ে লাইফস্টাইল, হেলথ এডুকেশন অ্যান্ড প্রমোশন দপ্তরে কোটি কোটি টাকার কাজ করে যাচ্ছেন। ওই দুজন কর্মকর্তা ভুয়া এবং নীলক্ষেত থেকে তৈরি করা কাগজসমূহ যাচাই না করে টাকার বিনিময়ে কাজ প্রদান করে যাচ্ছেন। তথ্য অধিকার আইনে একটি প্রতিষ্ঠান প্লে-ডক্টরস কর্তৃক দাখিলকৃত ভুয়া ও নীলক্ষেত থেকে তৈরিকৃত কাগজপত্র চেয়ে আবেদন করলেও ওই কর্তকর্তারা কোনো প্রকার কাগজপত্র সরবরাহ করেননি। দাখিলকৃত কাগজপত্র যাচাই-বাছাই করলে আসল রহস্য উদ্ঘাটিত হয়ে যাবে। এ ছাড়াও ওই প্রতিষ্ঠানটি বিগত তিন বছর ধরে ভুয়া এবং নীলক্ষেত থেকে তৈরি কাগজপত্রের মাধ্যমে লাখ লাখ টাকা কমিশন দিয়ে কোটি কোটি টাকার কাজ ভাগিয়ে নিচ্ছেন।’
মো. মোখলেছুর রহমান একাই ৫টি পদে দায়িত্ব পালন করছেন উল্লেখ করে অভিযোগে বলা হয়েছে, ‘মো. মোখলেছুর রহমান স্বাস্থ্য শিক্ষা ব্যুরোর একজন সহকারী প্রধান/সিনিয়র স্বাস্থ্য শিক্ষা অফিসার। তিনি ডেপুটি প্রোগ্রাম ম্যানেজার, প্রোগ্রাম ম্যানেজার, উপ-প্রধান (ভারপ্রাপ্ত) ও প্রধান (ভারপ্রাপ্ত) হিসেবে পাঁচটি দায়িত্বে রয়েছেন। স্বাস্থ্য শিক্ষা ব্যুরোর সব কর্মকর্তার মধ্যে তিনি সবার জুনিয়র অফিসার। এত জুনিয়র হয়ে ৫টি দায়িত্ব কীভাবে পেয়েছেন জিজ্ঞাসা করা হলে তিনি বলেন মন্ত্রী, সচিব ও মহাপরিচালককে ম্যানেজ করে আমাকে এ দায়িত্ব পেতে হয়েছে। তিনি বলেন, আমার স্বাস্থ্য শিক্ষা ব্যুরোর প্রধান (ভারপ্রাপ্ত) হিসেবে কোনো আদেশ নেই। তথাপি আমি ভারপ্রাপ্ত হিসাবে কাজ করছি এবং দপ্তরপ্রধানের রুমে ও চেয়ারে বসে প্রধান হিসেবে সব কাগজপত্রে স্বাক্ষর করছি। আমার ক্ষমতা আছে বিধায় আদেশ না থাকার পরও আমি কাজ করে যাচ্ছি। আমাকে কেউ কিছু করার ক্ষমতা রাখেন না। আমি আপনার টাকা ফেরত দেয়ার জন্য নিই নাই। গত এবং এই অর্থবছরে কাজ দিতে পারি নাই, ভবিষ্যতে কাজ দিয়ে সমন্বয় করে দিব।’
এ প্রসঙ্গে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের লাইন ডিরেক্টর (লাইফস্টাইল, হেলথ এডুকেশন অ্যান্ড প্রমোশন) ডা. মো. মিজানুর রহমান আরিফ ভোরের আকাশকে বলেন, ‘আমার বিরুদ্ধে করা অভিযোগ সম্পূর্ণ মিথ্যা ও ভিত্তিহীন। কাজ না পাওয়ায় আমার বিরুদ্ধে মিথ্যা অভিযোগ করেছেন।’
ভোরের আকাশ/আসা
মন্তব্য