নিখিল মানখিন: ‘কমিউনিটি ক্লিনিক স্বাস্থ্য সহায়তা ট্রাস্ট আইন-২০১৮’-এর পূর্ণাঙ্গ বাস্তবায়ন নিয়ে সৃষ্টি হয়েছে ধূম্রজাল। ট্রাস্টে জনবল ন্যস্তকরণের জন্য নির্দেশনা দিয়েছে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়। ২০১৮ সালে মন্ত্রিসভা এবং পরে জাতীয় সংসদে পাস হলেও নানা জটিলতার কারণে আইনটির বাস্তবায়ন থমকে গিয়েছিল। এই ট্রাস্টে কমিউনিটি হেলথ প্রোভাইডারদের (সিএইচসিপি) কর্মজীবন নিশ্চিত করা হয়েছে। হেলথ প্রোভাইডাররা দেশে প্রচলিত অন্যান্য সংবিধিবদ্ধ সংস্থায় কর্মরত কর্মচারীদের মতো তাদের স্থায়ীকরণ, বেতন বৃদ্ধি, পদোন্নতির সুযোগ, গ্র্যাচুইটি ও অবসরভাতাসহ অন্যান্য সুযোগ-সুবিধা প্রাপ্য হবেন। কিন্তু ট্রাস্টের বাস্তবায়ন থমকে যাওয়ায় কর্মচারীদের মধ্যে কর্মজীবনের অনিশ্চয়তা নিয়ে সৃষ্টি হচ্ছে অসন্তোষ। ব্যাহত হচ্ছে ক্লিনিকের সেবা কার্যক্রম।
জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের ‘কমিউনিটি ক্লিনিক স্বাস্থ্য সহায়তা ট্রাস্ট আইন-২০১৮’ সম্পর্কিত নির্দেশনায় বলা হয়েছে, ‘২০২২ সালের ৩০ তারিখের স্বাস্থ্যসেবা বিভাগের ৪৫,০০,০০০০, ১৭৩,০১৫,০৬৬,১৯-২১২ নং সূত্রস্থ স্মারকের পরিপ্রেক্ষিতে স্বাস্থ্যসেবা বিভাগের আওতাধীন কমিউনিটি ক্লিনিক স্বাস্থ্য সহায়তা ট্রাস্টের বিষয়ে কিছু ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য নির্দেশক্রমে অনুরোধ করা হলো।
সেগুলো হলো- ব্যবস্থাপনা পরিচালকের পদটি আইন দ্বারা সৃষ্ট পদ বিধায় এটি ট্রাস্টে ন্যস্ত করার প্রয়োজন নেই। কমিউনিটি ক্লিনিক স্বাস্থ্য সহায়তা ট্রাস্ট আইন-২০১৮ জারির তারিখে যেসব পদে জনবল কর্মরত ছিল না, অর্থাৎ শূন্য ছিল, সেসব পদ এবং জনবল ন্যস্ত করা যাবে না। ‘রিভাইটালাইজেশন অব কমিউনিটি হেলথ কেয়ার ইনিশিয়েটিভস অব বাংলাদেশ (আরসিএইচসিআইবি)’ শীর্ষক প্রকল্প এবং ‘কমিউনিটি বেইজড হেলথ কেয়ার (সিবিএইচসি)’ অপারেশনাল প্ল্যানের আওতায় নিয়োজিত ১৩ হাজার ৯৪৯টি পদে কর্মরত জনবলসহ ‘কমিউনিটি ক্লিনিক স্বাস্থ্য সহায়তা ট্রাস্ট আইন-২০১৮’-এ ন্যস্ত করার বিষয়ে বেশ কিছু শর্তে প্রয়োজনীয় আদেশ জারি করতে হবে বলে জানিয়েছে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়।
কমিউনিটি ক্লিনিক প্রকল্পের কর্মকর্তারা জানান, ২০১৮ সালের জুলাইয়ে ‘কমিউনিটি ক্লিনিক স্বাস্থ্য সহায়তা ট্রাস্ট আইন-২০১৮’-এর খসড়ার চূড়ান্ত অনুমোদন দেয় মন্ত্রিসভা। পরে সরকার দশম জাতীয় সংসদের শেষ অধিবেশনে কমিউনিটি ক্লিনিককে স্থায়ী প্রতিষ্ঠানে রূপ দিতে কমিউনিটি ক্লিনিক স্বাস্থ্য সহায়তা ট্রাস্ট-২০১৮ বিল পাস করে।
সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগের আদেশ : স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের অধীন কমিউনিটি হেলথ কেয়ার প্রোভাইডার (সিএইচসিপি) পদের চাকরি জাতীয়করণের বিষয়ে হাইকোর্টের আদেশ সংশোধন করে দিয়েছেন সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগ।
আদালত সিএইচসিপিদের চাকরি রাজস্ব খাতে স্থানান্তরে হাইকোর্টের রায় সংশোধন করে তাদের চাকরি ‘কমিউনিটি ক্লিনিক স্বাস্থ্য সহায়তা ট্রাস্ট আইন ২০১৮’ অনুযায়ী ব্যবস্থা গ্রহণের নির্দেশ দিয়েছেন। ২০২২ সালের ৬ মার্চ রাষ্ট্রপক্ষের আপিল নিষ্পত্তি করে এ আদেশ দেন আপিল বিভাগ। এ সংক্রান্ত রাষ্ট্রপক্ষের ৬২টি আপিলের ওপর রায়ের জন্য নির্ধারিত দিনে প্রধান বিচারপতির নেতৃত্বাধীন আপিল বিভাগ এই আদেশ দেন।
ট্রাস্টি বোর্ড গঠন : দেশের স্বাস্থ্যসেবাকে মানুষের দোরগোড়ায় পৌঁছাতে অধ্যাপক ডা. সৈয়দ মোদাচ্ছের আলীকে সভাপতি করে ১৫ সদস্যের কমিউনিটি ক্লিনিক স্বাস্থ্য সহায়তা ট্রাস্টি বোর্ড গঠন করেছে সরকার। ২০২২ সালের ৭ ফেব্রুয়ারি স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের স্বাস্থ্যসেবা বিভাগের উপসচিব এস এম জাহাঙ্গীর হোসেন স্বাক্ষরিত এক প্রজ্ঞাপনে এ তথ্য জানানো হয়।
এতে বলা হয়েছে, কমিউনিটি ক্লিনিক স্বাস্থ্য সহায়তা ট্রাস্ট আইন অনুযায়ী ১৫ সদস্যের পূর্ণাঙ্গ ট্রাস্টি বোর্ড গঠন করা হয়েছে। এই ট্রাস্টি বোর্ডের মেয়াদ ২০২৪ সালের ৩ ডিসেম্বর পর্যন্ত থাকবে। তবে বোর্ডের মেয়াদ শেষ হওয়ার আগে মনোনীত যেকোনো সদস্যকে কারণ দর্শানো ছাড়া দায়িত্ব থেকে অব্যাহতি দিতে পারবে সরকার। পূর্ণাঙ্গ ট্রাস্টি বোর্ডের সভাপতি ছাড়াও সহসভাপতি করা হয়েছে ডা. মাখদুমা নার্গিসকে। আর ট্রাস্টের ব্যবস্থাপনা পরিচালককে সদস্য সচিব করা হয়েছে বলে প্রজ্ঞাপনে বলা হয়েছে।
মাঠকর্মীদের অসন্তোষ : কমিউনিটি ক্লিনিকের প্রায় ১৪ হাজার হেলথ কেয়ার প্রোভাইডার (সিএইচসিপি) চাকরির স্থায়িত্ব ও দীর্ঘ বছর ধরে একই সীমিত বেতন নিয়ে হতাশায় ভুগছেন বলে দাবি করেছেন কমিউনিটি হেলথ কেয়ার প্রোভাইডার (সিএইচসিপি) অ্যাসোসিয়েশনের নেতারা। দাবি আদায়ে বিভিন্ন সময়ে আন্দোলনে নেমেছেন তারা। বিষয়টি আদালত পর্যন্ত গড়িয়েছে।
অ্যাসোসিয়েশনের নেতারা অভিযোগ করেন, জনগণের দোরগোড়ায় স্বাস্থ্যসেবা পৌঁছে দেয়ার প্রধান মাধ্যম কমিউনিটি ক্লিনিকে প্রায় ১৪ হাজার কর্মচারী কাজ করছে। যার মধ্যে প্রায় সাড়ে চার হাজার মুক্তিযোদ্ধার সন্তান। তারা নিরলসভাবে কাজ করলেও চাকরি স্থায়ীকরণ হচ্ছে না। ফলে প্রায় ১৪ হাজার পরিবারের কাছে ইনক্রিমেন্ট, বিনোদন ও প্রশান্তি ভাতাসহ সরকারের দেয়া সব সুযোগ-সুবিধা থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন। এতে পরিবার-পরিজন নিয়ে সচ্ছলভাবে দিন কাটানো যাচ্ছে না। নিদারুণ অবহেলায় দিন কাটছে তাদের। চাকরি স্থায়ীকরণ না হওয়ায় এরই মধ্যে অনেকেই চাকরি ছেড়ে অন্যত্র চলে যাচ্ছেন। ফলে তাদের অবস্থা একেবারেই নাজেহাল হয়ে যাচ্ছে। আবার যারা চাকরি করছেন দীর্ঘদিন কোনো সুরাহা না হওয়ায় পরিবার চালাতেও হিমশিম খেতে হচ্ছে। এই পদে যারা চাকরি করছেন, তাদের বেশির ভাগই মাস্টার্স পাস। তারা আর কোথাও ভালো চাকরির সন্ধানে যেতে পারছেন না। এ অবস্থায় সিএইচসিপিদের চাকরি স্থায়ীকরণের দাবি জানান অ্যাসোসিয়েশনের নেতারা। তবে ‘কমিউনিটি ক্লিনিক স্বাস্থ্য সহায়তা ট্রাস্ট আইন-২০১৮’ বাস্তবায়ন হলে হেলথ প্রোভাইডাররা দেশে প্রচলিত অন্যান্য সংবিধিবদ্ধ সংস্থায় কর্মরত কর্মচারীদের মতো তাদের স্থায়ীকরণ, বেতন বৃদ্ধি, পদোন্নতির সুযোগ, গ্র্যাচুইটি ও অবসরভাতাসহ অন্যান্য সুযোগ-সুবিধা প্রাপ্য হবেন। এতে কর্মচারীদের মধ্যে কর্মজীবনের অনিশ্চয়তা নিয়ে বিদ্যমান অসন্তোষ দূর হবে।
কমিউনিটি ক্লিনিক প্রকল্পের কর্মকর্তারা জানান, মানুষের দোরগোড়ায় স্বাস্থ্যসেবা পৌঁছে দেয়ার জন্য ১৯৯৬ সালে কমিউনিটি ক্লিনিক চালু করে আওয়ামী লীগ সরকার। জনকল্যাণমূলক এই প্রকল্পটি ২০০১ সালে বিএনপি-জামায়াত জোট সরকার ক্ষমতায় এসে বন্ধ করে দেয়। প্রকল্পের টাকা অন্য খাতে ব্যয় করে ফেলে। পরে আওয়ামী লীগ সরকার গত ২০০৯ সালে ক্ষমতায় এসে প্রকল্পটি আবার চালু করে। এখান থেকে দেশের লাখ লাখ মানুষ স্বাস্থ্যসেবা নিচ্ছেন।
সরকারি হিসাবে সারা দেশে ১৪ হাজারের বেশি ক্লিনিক চালু অবস্থায় আছে। প্রতিটি ক্লিনিক থেকে দৈনিক গড়ে ৩০ জন মানুষ সেবা নেয়। ক্লিনিক থেকে মা, নবজাতক ও অসুস্থ শিশুর সমন্বিত সেবা (আইএমসিআই), প্রজনন স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা সেবা এবং সাধারণ আঘাতে চিকিৎসা দেয়া হয়। প্রতিটি ক্লিনিকে শিশু ও মায়েদের টিকাদানের ব্যবস্থা আছে। ক্লিনিকে ডায়াবেটিস বা উচ্চরক্তচাপের মতো অসংক্রামক রোগ শনাক্ত করা হয়। স্বাস্থ্য-শিক্ষার পাশাপাশি দেয়া হয় পুষ্টিশিক্ষা। বয়স্ক, কিশোর-কিশোরী ও প্রতিবন্ধীদের লক্ষণভিত্তিক চিকিৎসা ও পরামর্শ দেয়া হয়। ক্লিনিক থেকে ২৭ ধরনের ওষুধ ছাড়াও শিশুদের অণুপুষ্টিকণার প্যাকেট দেয়া হয়।
কমিউনিটি বেইজড হেলথ কেয়ার (সিবিএইচসি) এর লাইন ডিরেক্টর ডা. মো. কাইয়ুম তালুকদার বলেন, কমিউনিটি ক্লিনিক আমাদের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার চিন্তা প্রসূত কার্যক্রম এবং বর্তমান সরকারের সাফল্যের এক উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত। যা দেশে এবং বিদেশে সর্বক্ষেত্রেই প্রশংসিত হয়েছে। এ কার্যক্রমের মাধ্যমে দরিদ্র এবং সুবিধাবঞ্চিত গ্রামীণ জনগোষ্ঠী তারা নিকটস্থ কমিউনিটি ক্লিনিক হতে সমন্বিত স্বাস্থ্য, পরিবার পরিকল্পনা এবং পুষ্টিসেবা গ্রহণ করে থাকে।
মো. কাইয়ুম তালুকদার বলেন, কমিউনিটি ক্লিনিক কার্যক্রমকে গতিশীল এবং টেকসই করার লক্ষ্যে মহান জাতীয় সংসদে কমিউনিটি ক্লিনিক স্বাস্থ্য সহায়তা ট্রাস্ট আইন অনুমোদন করা হয় এবং এই আইনের বলে কমিউনিটি ক্লিনিক স্বাস্থ্য সহায়তা ট্রাস্ট একটি সংবিধিবদ্ধ সংস্থা হিসেবে কর্মকাণ্ড চালিয়ে যাচ্ছে। বর্তমানে কমিউনিটি ক্লিনিক স্বাস্থ্য সহায়তা ট্রাস্টের আওতাধীন সিবিএসসি অপারেশন প্ল্যানের মাধ্যমে কমিউনিটি ক্লিনিকসমূহ পরিচালিত হচ্ছে। এখন পর্যন্ত আমাদের ১৪ হাজার ২০৮টি কমিউনিটি ক্লিনিক তার কর্মকাণ্ড চালিয়ে যাচ্ছে এবং জনগণের দোরগোড়ায় স্বাস্থ্যসেবা দেয়ার কর্মকাণ্ড চালিয়ে যাচ্ছে। ১৪ হাজার ২০৮টি কমিউনিটি ক্লিনিকের মাধ্যমে আমরা বিগত বছরে মোট ৯ কোটি ৮৩ লাখ ১ হাজার ১৫৪ জন মানুষকে স্বাস্থ্যসেবা দিয়েছি এবং ১৮ হাজার ১৮৬টি স্বাভাবিক প্রসব সেখানে করানো হয়েছে। ৭৯ লাখ ১৫ হাজার ৯৩৯ জন শিশুর রোগীকে দেখানো হয়েছে।
তিনি বলেন, আমাদের চার হাজারেরও অধিক কমিউনিটি ক্লিনিকে স্বাভাবিক প্রসবের ব্যবস্থা রয়েছে এবং এই ১৪ হাজার ২০৮টি কমিউনিটি ক্লিনিকের প্রতিটি ক্লিনিক প্রতি মাসে বাচ্চাদের জিপিআই কর্মকাণ্ডের মাধ্যমে টিকা প্রদান করে থাকে। আমাদের কমিউনিটি ক্লিনিকে যে রোগীগুলো জটিল এবং দুরারোগ্য রোগ নিয়ে আসে, কমিউনিটি ক্লিনিক থেকে তাদের নিকটস্থ স্বাস্থ্যকেন্দ্রে অথবা বিশেষায়িত হাসপাতালে পাঠানো হয়। এ ধরনের রেফারের রোগীর সংখ্যা এখন পর্যন্ত এক কোটির ওপরে।
ভোরের আকাশ/আসা
মন্তব্য