-->
শিরোনাম

যেভাবে এইচআইভি আক্রান্ত হন যুবক

রুদ্র মিজান
যেভাবে এইচআইভি আক্রান্ত হন যুবক

রুদ্র মিজান: দুশ্চিন্তা করো না ইয়ংম্যান। তুমি আরও নব্বই বছর বাঁচবে। কথাগুলো বলছিলেন চিকিৎসক। কিন্তু বিশ্বাস হয়নি তরুণের। তার মনে হচ্ছিলো, ডাক্তার মিথ্যা সান্ত¡না দিচ্ছেন! যুবক ভাবছেন, এটি মরণব্যাধি ভাইরাস। আক্রান্ত হলে মানুষ বাঁচে না।

 

তিনি শিগগিরই মারা যাবেন। তার আগে ঘটবে নানা ঘটনা। হয়তো বাসা থেকে বের করে দেয়া হবে তাকে। মা-বাবা, বোন, আত্মীয়-স্বজন সবাই তাকে দূরে ঠেলে দেবে। কেউ আশ্রয় দেবে না। ভাবছিলেন আর তার পুরো শরীর কাঁপছিলো। কথা আটকে যাচ্ছিলো। ঘাম ঝরছিলো। ডাক্তার সাহস দিচ্ছিলেন। তরুণের পিঠে হাত রাখতেই তার বুকে জমাট কষ্টের বরফগুলো গলতে শুরু করে। ডাক্তারকে জড়িয়ে ধরে শব্দ করে কাঁদতে থাকেন তিনি। কান্নার শব্দ শুনে পাশের কয়েক জন এগিয়ে যান।

 

এটি ২০১৮ সালের কথা। সেদিনই প্রথম জানতে পারেন তিনি এইচআইভি আক্রান্ত। রাজধানীর ঢাকার বাসিন্দা এই তরুণের নাম রুবলে (ছদ্মনাম)। তখন তিনি দ্বাদশ শ্রেণির ছাত্র। বয়স ২০ বছর। এই বয়সেই এক অন্যরকম যুদ্ধে নামতে হয় তাকে। বাবা ব্যবসায়ী, মা গৃহিণী। তাদের দুই সন্তান। একমাত্র পুত্র রুবেল। সিদ্ধান্ত নেন বিষয়টি কোনোভাবেই কাউকে জানতে দেবেন না।

 

রুবেল জানান, চিকিৎসক তাকে মানসিক শক্তি দেন। সাহস যোগান। কিন্তু শুরুতে ওই প্রতিষ্ঠানেই নেতিবাচক অভিজ্ঞতা অর্জন করেন তিনি। অসুস্থ হওয়ার পর ওই প্রতিষ্ঠানে যান তিনি। এ বিষয়ে রুবেল জানান, অসুস্থ বোধ করছিলেন। ঘাড়ের দু’দিক ফুলে গেছে। প্রতি রাতেই জ্বর আসে। ডায়রিয়া হচ্ছে। ভীষণ ক্লান্তি লাগে।

 

ওষুধ সেবন করছেন কিন্তু সুস্থ হচ্ছেন না। তখনই সন্দেহটা হয়। একাদশ শ্রেণিতে ‘অপরাহ্ণের গল্প’ পড়েছেন, তখন থেকেই এইচআইভি সম্পর্কে একটু আধটু ধারণা তার। এরমধ্যেই একটি এফএম রেডিওতে এইডস সংক্রান্ত একটি অনুষ্ঠান শুনেন তিনি। সেখান থেকে ফোন নম্বর পেয়ে যোগাযোগ করে ছুটে যান রাজধানীর মোহাম্মদপুরে।

 

কথা হয় ওই প্রতিষ্ঠানের কাউন্সিলরের সঙ্গে। সুদর্শনা তরুণী মুখোমুখি বসে জানতে চান, কেন টেস্ট করাতে চাচ্ছেন, তিনি অনিরাপদ যৌনসম্পর্ক করেন কি-না? অনিক মাথা নাড়িয়ে হ্যাঁ-সূচক জবাব দেন। তরুণী জানতে চান, যৌনপল্লীতে, হোটেলে যৌনকর্মীদের কাছে যেতেন কি-না। রুবেল বলেন, না। তরুণী আবার জানতে চান, তাহলে কি গার্লফ্রেন্ডের সঙ্গে? রুবেল না- সূচক মাথা নাড়ান। তরুণীর চোখে-মুখে বিস্ময়। তাহলে কার সঙ্গে ফিজিক্যাল সম্পর্ক করতেন?

 

রুবেল মাথা নিচু করে জানান, তিনি হোমোসেক্স করতেন। তরুণী হতভম্ব হয়ে যান। সঙ্গে সঙ্গে চেয়ারটি একটু দূরে সরিয়ে নেন। তার চোখে কোনো সহানুভ‚তি নেই। সেদিন রক্ত পরীক্ষা শেষে বাসায় ফিরে যান। তৃতীয় দিন ফোনে ডাকা হয় তাকে। রুবেল উপস্থিত হন সেই অফিসে। এবার সেই তরুণী তাকে ডেকে নিয়ে প্রথমে তাকে সাহস দেন। তারপরই জানান, রুবেল এইচআইভি আক্রান্ত। বুঝানোর চেষ্টা করেন। এটি একটি অসুখ ছাড়া কিছুই না। নিয়মিত চিকিৎসা গ্রহণ করলে নিয়ন্ত্রণে থাকবে। সংসার, কাজ সবই করা যাবে। দীর্ঘদিন সুস্থভাবে বেঁচে থাকা যাবে।

 

পরে তাকে নিয়ে যাওয়া হয় চিকিৎসকের কাছে। দ্রুত সিডি ফোর পরীক্ষা করানো হয়। চিকিৎসক জানান, এটি রক্তের শ্বেতকণিকার একটি উপাদান। প্রতি ঘন মিলিমিটার রক্তে সাধারণত ৯০০ থেকে ১২০০ সিডি ফোর থাকে। এইচআইভি আক্রান্ত ব্যক্তির রক্তে সিডি ফোর উপাদান কমতে থাকে এবং সেই সঙ্গে তার রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কমতে থাকে। রক্তে সিডি ফোরের পরিমাণ ২০০-এর নিচে নেমে গেলে তাকে অ্যান্টিরেট্রোভাইরাল থেরাপি দিতে হয়। পরীক্ষায় জানা যায়, রুবেলের সিডি ফোর ৩২০। তারপর শুরু হয় চিকিৎসা। একটা যুদ্ধ।

 

অসচেতনতার কারণেই তিনি এইচআইভি আক্রান্ত হন বলে তার ধারণা। শুরুতে আশার আলো সোসাইটিতে চিকিৎসা নিয়েছেন রুবেল। এখন চিকিৎসা নিচ্ছেন বন্ধু সোশ্যাল ওয়েল ফেয়ার সোসাইটিতে। দুটি প্রতিষ্ঠানের চিকিৎসকরা তাকে সেবা দিয়ে সত্যিকার অর্থে আশার আলো দেখিয়েছেন। রুবেল জানান, এখন তার সিডি ফোর ৯০০। সুস্থ মানুষের মতোই।

 

কিন্তু তার পরিবার, আত্মীয়-স্বজন, সহপাঠী কেউ জানেন না তিনি এইচআইভি আক্রান্ত। রুবেল বলেন, জানাজানি হলে আমি এই সমাজে চলতে পারবো না। এমনকি নিজের পরিবারেও থাকতে পারবো না। এইচআইভি আক্রান্তদের নিয়ে তাদের অনেক ভুল ধারণা। সমাজ তাদের কোনোভাবেই ভালো চোখে দেখে না।

 

জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের এই ছাত্র বলেন, মাস্টার্স শেষ করবো। লিঙ্গ বৈচিত্র্য ও এইডস নিয়ে কাজ করবো। আর কেউ যেন তার মতো এইচআইভি আক্রান্ত না হয়। একইভাবে মানুষ যেন সচেতন হয়। এইচআইভি বা এইডস ছোঁয়াচে না, আক্রান্তদের দূরে ঠেলে না দিয়ে সেবা দিতে হবে। অনিক তেমনটিই করতে চান। মানুষের সেবা করাই তার উদ্দেশ্য।

 

রুবেলে মতো অনেকেই সামাজিকতার কারণে গোপনে এইডসের ভাইরাস এইচআইভি’র সঙ্গে যুদ্ধ করে যাচ্ছেন। স্বাস্থ্য অধিদপ্তর সূত্রে জানা গেছে, ২০২১ সালের নভেম্বর থেকে ২০২২ সালের অক্টোবর পর্যন্ত দেশে ৯৪৭ জন এইচআইভি সংক্রমিত ব্যক্তি শনাক্ত হয়েছেন। তাদের মধ্যে দেশে আশ্রয় নেওয়া রোহিঙ্গা রয়েছেন ১২৮ জন। বাকি ৮১৯ জন এই দেশের নাগরিক।

 

নতুনভাবে সংক্রমিত ব্যক্তিদের মধ্যে ১৮ শতাংশ প্রবাসী শ্রমিক। দেশে এইচআইভি সংক্রমিত রোগী ১৩ সহ¯্রাধিক। ১৯৮৯ সালে দেশে প্রথম এইচআইভি আক্রান্ত রোগী শনাক্ত করা হয়। এই ভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে এ পর্যন্ত মারা গেছে ১ হাজার ৮শ’ ২০ জন।

 

এ বিষয়ে জাতীয় এইডস কমিটির সদস্য সচিব ও বিশিষ্ট ভাইরোলজিস্ট অধ্যাপক ড. নজরুল ইসলাম বলেন, এইচআইভি নিয়ে মানুষের মধ্যে অনেক ভ্রান্ত ধারণা রয়েছে। বুঝতে হবে এটি কোনো ছোঁয়াছে রোগ নয়। নিয়মিত ওষুধ সেবন করলে এইডস রোগীরা দীর্ঘদিন সুস্থ্য থাকতে পারে।

 

এইচআইভি প্রতিরোধ সম্পর্কে তিনি বলেন, চিকিৎসার ক্ষেত্রে অসমতা দূর করতে হবে। অনিরাপদ যৌন সম্পর্ক, রক্ত গ্রহণ কররার ক্ষেত্রে ভাইরাস আক্রান্ত ব্যক্তির ব্যবহৃত সিরিঞ্জ ব্যবহারের মাধ্যমে এটি ছড়াতে পারে। এসব বিষয়ে সচেতনতা তৈরি করতে হবে। সচেতনতার কোনো বিকল্প নেই বলে জানান তিনি।

 

ভোরের আকাশ/নি 

মন্তব্য

Beta version