-->

তামাক কোম্পানির হস্তক্ষেপে ২ বছর বিলম্বে নীতিমালা

আরিফ সাওন
তামাক কোম্পানির হস্তক্ষেপে ২ বছর বিলম্বে নীতিমালা

আরিফ সাওন: ধূমপান রোধে সরকারের সতর্কবার্তা ও কার্যক্রম দুর্বল করতে ব্যাপক তৎপরতা চালায় তামাকপণ্য উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠানগুলো। যার কারণে তখন সচিত্র স্বাস্থ্য সতর্কবার্তা মুদ্রণ সংক্রান্ত নীতিমালা প্রণয়ন পিছিয়ে যায় ২ বছর। উপরিভাগের পরিবর্তে মোড়কের নিচের ৫০ শতাংশে সচিত্র সতর্কবার্তা মুদ্রণের নীতিমালা হয়।

 

মোড়কের নিচের অংশে সচিত্র সতর্কবার্তা মুদ্রণে ও নীতিমালা প্রণয়নে বিলম্ব করাতে এবং স্বাস্থ্য সতর্কবার্তা বাস্তবায়নের বিরুদ্ধে তামাক কোম্পানিগুলোর মধ্যে সবচেয়ে জোরালো ভূমিকা পালন করেছে ব্রিটিশ-আমেরিকান টোব্যাকো বাংলাদেশ (বিএটিবি)। তামাক কোম্পানির পক্ষে সবচেয়ে সক্রিয় ভূমিকা পালন করেছে সিগারেট উৎপাদকদের জোট বাংলাদেশ সিগারেট ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যাসোসিয়েশন (বিসিএমএ)।

বিশ্বখ্যাত ব্রিটিশ মেডিকেল জার্নাল (বিএমজে) গ্রুপের টোব্যাকো কন্ট্রোল জার্নালে সম্প্রতি প্রকাশিত এক গবেষণাপত্রে এ তথ্য প্রকাশ করা হয়েছে। বাংলাদেশে তামাকজাত পণ্যের মোড়কে সচিত্র স্বাস্থ্য সতর্কবার্তা মুদ্রণসংক্রান্ত নীতিমালা প্রণয়ন ও বাস্তবায়নে তামাক কোম্পানির হস্তক্ষেপ বিষয়ক এ গবেষণাপত্র গত ২৪ এপ্রিল প্রকাশিত হয়েছে।

 

গবেষণাপত্রটি এমন সময়ে প্রকাশিত হলো, যখন বাংলাদেশ সরকার কর্তৃক তামাক নিয়ন্ত্রণ আইনের সংশোধনী প্রক্রিয়া চলমান। খসড়া সংশোধনীতে অন্যান্য বিষয়ের সঙ্গে তামাকজাত পণ্যের মোড়কে ৯০ শতাংশ জায়গাজুড়ে সচিত্র স্বাস্থ্য সতর্কবার্তা মুদ্রণের প্রস্তাব করা হয়েছে।

 

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, সংশোধনী প্রক্রিয়া নস্যাৎ করতে তামাক কোম্পানিগুলো ইতোমধ্যে নানাভাবে হস্তক্ষেপ শুরু করেছে। সম্প্রতি প্রকাশিত ওই গবেষণায় তামাকজাত পণ্যের মোড়কের উপরিভাগের ৫০ শতাংশ জায়গাজুড়ে সচিত্র স্বাস্থ্য সতর্কবার্তা মুদ্রণসংক্রান্ত ২০১৩ সালের সংশোধীত তামাক নিয়ন্ত্রণ আইন প্রণয়ন ও বাস্তবায়নে তামাক কোম্পানির হস্তক্ষেপের বিভিন্ন দিক তুলে ধরা হয়েছে।

 

গবেষক দলের মধ্যে রয়েছেন যুক্তরাজ্যের বাথ ইউনিভার্সিটির টোব্যাকো কন্ট্রোল রিসার্চ গ্রুপের পরিচালক অধ্যাপক অ্যানা বি গিলমোর এবং রিসার্চ অ্যাসোসিয়েট ড. ব্রিটা কে ম্যাথুস, প্রজ্ঞার (প্রগতির জন্য জ্ঞান) নির্বাহী পরিচালক এবিএম জুবায়ের, হেড অব প্রোগ্রামস মো. হাসান শাহরিয়ার, হেড অব অ্যাডভোকেসি মো. শাহেদুল আলম এবং মিডিয়া ম্যানেজার অব টোব্যাকো কন্ট্রোল প্রোগ্রাম মো. মেহেদি হাসান।

 

গবেষক দলের অন্যতম সদস্য এবং প্রজ্ঞার নির্বাহী পরিচালক জুবায়ের এ গবেষণার ফলাফলের আলোকে সরকারের প্রতি তামাক কোম্পানির হস্তক্ষেপ বিষয়ে সতর্ক থাকার আহব্বান।

 

তিনি বলেন, ‘বাংলাদেশে প্রথমবার সচিত্র স্বাস্থ্য সতর্কবার্তা প্রচলনে ২০১৩ সালে আইন সংশোধনীর ক্ষেত্রে যে অভিজ্ঞতা হয়েছিল, সরকারকে তা বিবেচনায় রাখতে হবে। চলমান সংশোধনী প্রক্রিয়াকে বাধাগ্রস্ত করতে তামাক কোম্পানিগুলো প্রায় একই ধরনের হস্তক্ষেপ অব্যাহত রাখবে। তামাক কোম্পানির ক‚টকৌশলে বিভ্রান্ত না হয়ে নীতিনির্ধারকদের জনস্বাস্থ্য বিষয়ে সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার প্রদান করতে হবে।’

 

প্রজ্ঞার মিডিয়া ম্যানেজার অব টোব্যাকো কন্ট্রোল প্রোগ্রাম মেহেদি হাসান বলেন, বাংলাদেশে সচিত্র স্বাস্থ্য সতর্কবাণী বাস্তবায়নে তামাক কোম্পানির হস্তক্ষেপ বিষয়ক গবেষণাটি ২০১৩ সালের ১ মার্চ থেকে ২০১৭ সালের ৩১ নভেম্বর পর্যন্ত গণমাধ্যমে প্রকাশিত প্রতিবেদন এবং তামাক কোম্পানি, সরকার এবং আদালতের মোট ১১টি নথির ওপর ভিত্তি করে পরিচালিত হয়েছে।

 

গবেষণায় বলা হয়, সচিত্র স্বাস্থ্য সতর্কবার্তা মুদ্রণ বিষয়ে তামাক কোম্পানির হস্তক্ষেপের মূল উদ্দেশ্য ছিল এর বাস্তবায়ন প্রক্রিয়া যথাসম্ভব প্রলম্বিত করা এবং মোড়কের উপরিভাগের বদলে নিচের ৫০ শতাংশ জায়গায় মুদ্রণের মাধ্যমে সচিত্র স্বাস্থ্য সতর্কবার্তার কার্যকারিতা দুর্বল করে দেয়া। এ হস্তক্ষেপের ক্ষেত্রে তামাক কোম্পানির পক্ষে সবচেয়ে সক্রিয় ভ‚মিকায় দেখা গেছে সিগারেট উৎপাদকদের জোট বাংলাদেশ সিগারেট ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যাসোসিয়েশনকে।

 

তামাক কোম্পানিগুলোর মধ্যে ব্রিটিশ-আমেরিকান টোব্যাকো বাংলাদেশ (বিএটিবি) সচিত্র স্বাস্থ্য সতর্কবার্তা বাস্তবায়নের বিরুদ্ধে সবচেয়ে জোরালো ভ‚মিকা পালন করে। সরকারের উচ্চপর্যায়ে এবং বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ দপ্তরের সঙ্গে যোগাযোগের সম্পর্ককে কাজে লাগিয়ে সচিত্র স্বাস্থ্য সতর্কবার্তা বাস্তবায়ন সংক্রান্ত বিধিমালা প্রণয়ন প্রক্রিয়ায় রাজস্ব বিভাগের মাধ্যমে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের ওপর চাপ সৃষ্টি করতে সমর্থ হয় কোম্পানিটি।

 

২০১৩ সালে ৩০ অক্টোবর প্রকাশিত খসড়া বিধিমালায় সচিত্র স্বাস্থ্য সতর্কবার্তা বাস্তবায়নের জন্য তামাক কোম্পানিগুলোকে ৬ মাস সময়সীমা বেঁধে দেয়া হয়। কিন্তু নীতিনির্ধারণী পর্যায়ে প্রভাব বিস্তারের মাধ্যমে তা প্রায় ২ বছর পিছিয়ে দিতে সক্ষম হয় কোম্পানিগুলো।

 

সর্বশেষ ২০১৬ সালের ১৯ মার্চ তামাকজাত পণ্যের মোড়কে সচিত্র স্বাস্থ্য সতর্কবার্তা মুদ্রণ শুরু হয়। তবে কোম্পানির হস্তক্ষেপে তা মোড়কের উপরিভাগের বদলে নিচের ৫০ শতাংশে মুদ্রিত হয়। গবেষণাপত্রে জনস্বাস্থ্য সুরক্ষায় তামাক কোম্পানির কার্যক্রম নিয়মিতভাবে মনিটরিংয়ের পাশাপাশি বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার এফসিটিসি আর্টিক্যাল ৫.৩ সংক্রান্ত গাইডলাইন বাস্তবায়নকে সরকারের অগ্রাধিকার তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করার সুপারিশ করা হয়। তামাক কোম্পানির হস্তক্ষেপ মুক্ত থাকার হাতিয়ার আর্টিকেল ৫.৩।

 

কোন দেশে কেমন সচিত্র স্বাস্থ্য সতর্কবার্তা : বিশ্বের ৮৩টি দেশ তামাকজাত দ্রব্যের মোড়কে ৫০ শতাংশের অধিক জায়গাজুড়ে সচিত্র স্বাস্থ্য সতর্কবাণী মুদ্রণ করছে, যার মধ্যে প্রতিবেশী দেশ নেপাল (৯০%), ইন্ডিয়া (৮৫%), থাইল্যান্ড (৮৫%), মালদ্বীপ (৯০%), শ্রীলঙ্কা (৮০%), অস্ট্রেলিয়া (৮২.৫%), উরুগুয়ে (৮০%) ও তুরস্ক (৯২.৫%) অন্যতম।

 

অন্যদিকে বিশ্বের ১৮টি দেশে প্লেইন প্যাকেজিং প্রথা বাস্তবায়ন করছে যার মধ্যে রয়েছে অস্ট্রেলিয়া (২০১২), ফ্রান্স (২০১৭), যুক্তরাজ্য (২০১৭), নরওয়ে (২০১৮), আয়ারল্যান্ড (২০১৮), নিউজিল্যান্ড (২০১৮), হাঙ্গেরি (২০১৯), সৌদি আরব (২০১৯), তুরস্ক (২০১৯), থাইল্যান্ড (২০১৯), উরুগুয়ে (২০১৯), স্লোভেনিয়া (২০২০), ইসরাইল (২০২০), সিঙ্গাপুর (২০২০), কানাডা (২০১৯), বেলজিয়াম (২০২১), নেদারল্যান্ডস (২০২১) এবং ডেনমার্ক (২০২১)।

 

এছাড়া আরো ২০টি দেশ নেপাল, শ্রীলঙ্কা, জর্জিয়া, মরিশাস, সাউথ আফ্রিকা, রোমানিয়া, তাইওয়ান, ব্রাজিল, চিলি, গুয়েরন্সে, জার্সি, ইকুয়েডর, পানামা, জাম্বিয়া, বোতসোয়ানা, কেনিয়া, মালয়েশিয়া, ইউনাইটেড আরব আমিরাত (ইউএই), ফিনল্যান্ড ও সুইডেন প্লেইন প্যাকেজিং প্রবর্তনের পথে উল্লেখযোগ্য প্রস্তুতি সম্পন্ন করেছে।

 

কেন সচিত্র স্বাস্থ্য সতর্কবার্তা : বড় আকারের সচিত্র স্বাস্থ্য সতর্কবার্তা সহজেই তরুণ ও ব্যবহারকারীদের তামাকের ব্যবহার ছাড়তে উৎসাহিত করে। উরুগুয়ে ও অস্ট্রেলিয়ায় পরিচালিত গবেষণায় দেখা গেছে, সচিত্র সতর্কবার্তার আকার বাড়ানো হলে ব্যবহারকারী স্বাস্থ্য ক্ষতির বিষয়ে ভাবতে বাধ্য হয় এবং তামাক ছাড়তে উৎসাহিত হয়।

 

মেক্সিকোয় এক গবেষণায় দেখা গেছে, বৃহদাকার সচিত্র সতর্কবার্তা অল্প বয়সিদের (১২-১৪ বছর) মধ্যে সিগারেটের প্রতি আকর্ষণ কমায়।

 

কেন তামাক ক্ষতিকর? : ধূমপান ও ধোঁয়াবিহীন তামাকসহ সব ধরনের তামাকই স্বাস্থ্যের জন্য মারাত্মক ক্ষতিকর। হৃদরোগ এবং শ্বাসতন্ত্রের বিভিন্ন অসুখের অন্যতম প্রধান কারণ তামাক। তামাকের ধোঁয়ায় রয়েছে ৭,০০০টি রাসায়নিক পদার্থ যার মধ্যে ৭০টি ক্যান্সার সৃষ্টিকারী। তামাক সেবনের ফলে করোনারি হার্ট ডিজিজ এবং স্ট্রোক হওয়ার ঝুঁকি কয়েকগুণ বেড়ে যায় এবং মুখ গহব্বর, ফুসফুস, খাদ্যনালিসহ প্রায় ২০ ধরনের ক্যান্সার হয়।

 

এছাড়া দীর্ঘমেয়াদি ফুসফুস সংক্রমণে (সিওপিডি) ধূমপায়ীদের মৃত্যুঝুঁকি অধূমপায়ীদের তুলনায় ১৩ গুণ পর্যন্ত বেশি। তামাক ব্যবহারের কারণে প্রতি বছর বিশ্বে ৮০ লাখের বেশি মানুষ মারা যায়। কোভিড-১৯ মহামারিতে ধূমপায়ীদের গুরুতর অসুস্থ হওয়ার ঝুঁকি ৪০-৫০ শতাংশ বেশি বলে জানিয়েছিল বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা।

 

বাংলাদেশের চিত্র : ২০১৭ সালের জিএটিএসের জরিপ অনুযায়ী, বাংলাদেশে ৩৫ শতাংশ অর্থাৎ প্রায় ৩ কোটি ৭৮ লাখ প্রাপ্তবয়স্ক মানুষ তামাক ব্যবহার করেন। ধোঁয়াবিহীন তামাক ব্যবহারকারী ২ কোটি ২০ লাখ (২০.৬%) এবং ধূমপায়ী ১ কোটি ৯২ লাখ (১৮%)।

 

২০১৪ সালের জিএসএইচএসের জরিপ অনুযায়ী, বাংলাদেশে ১৩-১৫ বছর বয়সি ছাত্রছাত্রীদের মধ্যে তামাক ব্যবহারের হার ৯.২ শতাংশ, যা অত্যন্ত উদ্বেগজনক। তামাক ব্যবহারজনিত রোগে দেশে প্রতি বছর ১ লাখ ৬১ হাজার মানুষ অকালে মৃত্যুবরণ করে।

 

২০১৯ সালে প্রকাশিত ‘ইকোনমিক কস্ট অব টোব্যাকো ইউজ ইন বাংলাদেশ : এ হেলথ কস্ট অ্যাপ্রোচ’ শীর্ষক গবেষণা ফলাফলে দেখা গেছে, ২০১৭-১৮ অর্থবছরে তামাক ব্যবহারের অর্থনৈতিক ক্ষতির (চিকিৎসা ব্যয় এবং উৎপাদনশীলতা হারানো) পরিমাণ ৩০ হাজার ৫৬০ কোটি টাকা।

 

ভোরের আকাশ/নি 

মন্তব্য

Beta version