প্রধানমন্ত্রীর ব্যক্তিগত চিকিৎসক, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ব বিদ্যালয়ের মেডিসিন অনুষদের সাবেক ডিন ইমেরিটাস অধ্যাপক ডা. এবিএম আব্দুল্লাহ অনেক আগেই জাতীয় ও আন্তর্জাতিক চিকিৎসা ক্ষেত্রে বিশেষ জায়গা করে নিয়েছেন। চিকিৎসায় অসামান্য অবদানের জন্য তিনি একুশে পদকসহ বিভিন্ন পুরস্কারেস ভূষিত হয়েছেন।
মেডিকেল শিক্ষার ওপর তিনি ৭টি বই লিখেছেন, যা বিভিন্ন দেশে পাঠ্যবই হিসেবে সমাদৃত। সম্প্রতি দেশের চিকিৎসাসেবার নানা বিষয় নিয়ে তিনি দৈনিক ভোরের আকাশ পত্রিকার সঙ্গে কথা বলেছেন। সাক্ষাৎকারটি নিয়েছেন পত্রিকাটির বিশেষ প্রতিবেদক নিখিল মানখিন।
ভোরের আকাশ : দেশের মেডিকেল শিক্ষার মান বিভিন্ন মহলে নানাভাবে সমালোচিত হয়ে আসছে। আপনি বিষয়টি কীভাবে দেখছেন?
অধ্যাপক ডা. এবিএম আব্দুল্লাহ : শিক্ষা বলতে শুধু মেডিকেল শিক্ষা নয়, সব ধাপের সবগুলো শিক্ষাকেই বোঝায়। প্রাথমিক, মাধ্যমিক, উচ্চ মাধ্যমিক, তারপর মেডিকেল শিক্ষার বিষয়। কিছুদিন আগে একটা পত্রিকায় এ বিষয়ে ভালো একটি লেখা পড়লাম। লেখাটি ভালোই হয়েছে। তাতে লেখা আছে ‘পাসের হার বেড়েছে, শিক্ষার মান কমেছে’। এমন অবস্থা সব জায়গাতেই। যদি নিচের স্তরের শিক্ষার মান উন্নত না হয়, তাহলে মেডিকেল শিক্ষার মানও কমে যাবে। তবে দেশের মেডিকেল শিক্ষার অবস্থাও ভালো-মন্দ মিলিয়ে আছে।
সরকারি-বেসরকারি মিলে দেশে অনেক মেডিকেল কলেজ রয়েছে। আবার অনেক বেসরকারি মেডিকেল কলেজের মান প্রশ্নবিদ্ধ। নিজস্ব ভবন নাই, শিক্ষক নাই ও ল্যাবরেটরি সুবিধা নাই। এমন কথাও শোনা যায় যে, অনেক মেডিকেল কলেজে রোগীই নাকি নাই। এতে হাতেকলমে শিক্ষা ব্যাহত হয়। আবার ঢালাওভাবে সব বেসরকারি মেডিকেল কলেজের মান খারাপ, তাও বলা যাবে না।
অনেক সরকারি মেডিকেল কলেজে অনেক শূন্য পদ। অধ্যাপক, সহযোগী অধ্যাপকের পদ খালি। নার্স, টেকনিশিয়ানসহ চাহিদার তুলনায় জনবলের সংকট রয়ে গেছে। একেবারে সব ভালো তা বলাও মুশকিল। মানুষ তো ভালো সেবা চায়। কিন্তু মেডিকেল শিক্ষার মান উন্নত না হলে রোগীর সেবার মানও বাড়তে পারে না।
ভোরের আকাশ : দেশের চিকিৎসাসেবার মান আন্তর্জাতিক মানে উন্নীত হয়েছে বলে দাবি করে থাকেন স্বাস্থ্য সেক্টরের কর্তাব্যক্তিরা। দীর্ঘ কর্মজীবনের অভিজ্ঞতায় আপনি কী মনে করেন ?
ডা. এবিএম আব্দুল্লাহ : অনেক কিছুতে দেশের চিকিৎসাসেবা আন্তর্জাতিক মান স্পর্শ করেছে, কিন্তু সামগ্রিকভাবে সীমাবদ্ধতা রয়ে গেছে। আমাদের বুঝতে হবে যে, বিভিন্ন দেশে উন্নত চিকিৎসা চালু হয়েছে দেশ স্বাধীন হওয়ার অনেক আগে। আমাদের দেশ স্বাধীন হয়েছে ১৯৭১ সালে। যুদ্ধ বিধ্বস্ত দেশ গড়তে পর্যাপ্ত সময় পাননি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। মাঝখানে চলে মারামারি, কাটাকাটির ঘটনা। দেশ গড়ার কাজ তো চলছে গত ১৫ বছর ধরে। তবে চিকিৎসা ও স্বাস্থ্য সেক্টরের অবকাঠামোর অনেক উন্নয়ন ঘটেছে। সামনের দিনগুলোতে আরো হবে।
প্রধানমন্ত্রীর ব্যক্তিগত চিকিৎসক আরো বলেন, আমাদের হার্ট, লিভার, কিডনি, নিউরো, বক্ষব্যাধি, চক্ষু ও মেন্টাল ইনস্টিটিউট সবকিছুই হয়েছে। কিন্তু এসব বিশেষায়িত চিকিৎসাসেবা অনেকটা বিভাগীয় শহরকেন্দ্রিক। প্রান্তিক জনগোষ্ঠী সবসময় এসব সুযোগ-সুবিধা পায় না। জেলা পর্যায়েও সব জেলায় নেই। আর উপজেলা পর্যায়ে তো একেবারেই নেই। ফলে গ্রামের গরিব, সাধারণ মানুষ এসব উন্নত চিকিৎসাসেবা পায় না।
বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের সংখ্যা অনেক কম, হাতেগোনা। দেশ ছোট, মানুষ বেশি এবং রোগীও তো বেশি। জনসংখ্যা ও রোগীর তুলনায় দেশে চিকিৎসক ও নার্সসহ জনবল খুবই কম। উন্নত চিকিৎসাসেবার সুযোগ-সুবিধার অপ্রতুলতা এবং তা গ্রহণের আর্থিক সামর্থ্য না থাকায় দেশে বিদ্যমান আন্তর্জাতিক মানের চিকিৎসাসেবার ধারেকাছেও আসতে পারেন না দেশের অধিকাংশ মানুষ। ফলে দেশে বিদ্যমান আন্তর্জাতিক মানসম্পন্ন চিকিৎসা সম্পর্কে তাদের ধারণাও নেই। তবে দেশের চিকিৎসাসেবা অনেক উন্নতি লাভ করেছে। এসেছে অত্যাধুনিক সুযোগ-সুবিধা। কিন্তু অধিকাংশ মানুষ আন্তর্জাতিক মানের সেবা নিতে পারেন না। সারা দেশে বিশেষায়িত চিকিৎসাসেবার পরিধি বাড়াতে হবে।
তিনি আরো বলেন, রাজনৈতিক বিবেচনায় ঢালাওভাবে অনেক মেডিকেল কলেজের অনুমোদন দেয়া হচ্ছে। নিজস্ব জমি নেই, অবকাঠামো নেই, শিক্ষক নেই। সব কলেজের মান ভালো না। এসব সমস্যার সমাধান না করে আমরা যতই চেষ্টা করি না কেন, স্বাস্থ্য সেক্টরের প্রত্যাশিত উন্নতি ঘটবে না। সাইনবোর্ড মার্কা কলেজ দিয়ে ভালো চিকিৎসক তৈরি হবে না।
ভোরের আকাশ : অভিযোগ রয়েছে, দেশের চিকিৎসা ব্যয় অত্যন্ত ব্যয়বহুল, সাধারণ মানুষের নাগালের বাইরে। এ বিষয়ে কিছু বলেন?
ডা. এবিএম আব্দুল্লাহ : শুধু চিকিৎসাসেবা নয়, সব জিনিসের দামই তো বেশি। চিকিৎসাসেবাও এর বাইরে থাকতে পারে না। দরিদ্র রোগীদের শেষ আশ্রয়স্থল সরকারি হাসপাতাল। সরকারি হাসপাতালে দক্ষ জনবল এবং উন্নত মেডিকেল উপকরণ রয়েছে।
কিন্তু নানা কারণে এসব কিছুর সর্বোচ্চ ব্যবহার হয় না। সরকারি হাসপাতালে চিকিৎসা ব্যয় কম হলেও ভিড় বেশি, রোগী বেশি। মানুষ সব সুবিধা পায় না। অনেক ওষুধ বাইরে থেকে কিনতে হয়। আর বেড়েই চলেছে ওষুধের দাম। শুধু গরিব নয়, মধ্যবিত্ত পরিবারের নাগালের বাইরে চলে যাচ্ছে ওষুধের দাম। আর বেসরকারি হাসপাতালের চিকিৎসা ব্যয় তো অনেক সময় ধনাঢ্য রোগীরাই সামাল দিতে পারেন না। সরকারি হাসপাতালের তুলনায় বেসরকারি হাসপাতালগুলোতে চিকিৎসা ব্যয় সাধারণ মানুষের নাগালের বাইরে।
ভোরের আকাশ : বিদেশগামী রোগীর লাইন খাটো হচ্ছে না বলে আলোচনা রয়েছে। রোগীদের বিদেশগামী হওয়ার পেছনে কী কী কারণ থাকতে পারে?
ডা. এবিএম আব্দুল্লাহ : বিভিন্ন কারণে রোগী দেশের বাইরে যায়। বাইরে যাওয়া মানে দেশের চিকিৎসাসেবার মান খারাপ তা নয়। সীমিত আয়তন ও বিস্ফোরিত জনসংখ্যার দেশে রোগীও বেশি। এমন তো নয় যে, দেশের সব হাসপাতাল ফাঁকা পড়ে আছে, রোগীই নেই। দেশের প্রতিটি হাসপাতাল, ক্লিনিক রোগীতে ভর্তি থাকে। জায়গা দিতে হিমশিম খাচ্ছে হাসপাতালগুলো। সব জায়গায় একই অবস্থা। দেশে রোগী বেশি হলে তো বিদেশে যেতেই পারে। দেশের বাইরে যাওয়া মানে দেশের সব চিকিৎসাব্যবস্থা খারাপ তা নয়।
ডা. এবিএম আব্দুল্লাহ বলেন, অনেক মানুষের অর্থসম্পদ ও আয় বেড়েছে। প্রতিদিন অনেক মানুষ বেড়াতে, শপিং করতে বিদেশে যায়। ভারতে, সিঙ্গাপুরে ও ব্যাংককে বেড়াতে যায়। সেই ফাঁকে কেউ কেউ চিকিৎসাসেবা গ্রহণ করে আসেন। কম টাকা থাকলে ভারতে যায়, যাদের বেশি টাকা আছে তারা সিঙ্গাপুর ও ব্যাংককে যায়। দেশের হাসপাতালগুলোতে সব সময় বেশি ভিড় থাকে, লম্বা লাইন থাকে। সাময়িক হয়রানির শিকার হতে হয়। প্রত্যাশিত পরিবেশ থাকে না। এসব থেকে রেহাই পেতে কেউ কেউ বিদেশে যায়।
তিনি আরো বলেন, অনেক রোগী আছেন যারা দেশে অনেক চিকিৎসা করানোর পরও সুস্থ হতে পারছেন না। তারা আরো চেষ্টা করে দেখতে বিদেশে যান। যেমন ক্যান্সার রোগী, হার্টের রোগী, কিডনির রোগী, লিভারের রোগী চূড়ান্ত পর্যায়ে যাওয়া এসব রোগী শেষ চেষ্টা করে দেখতে বিদেশে যায়।
ডা. এবিএম আব্দুল্লাহ আরো বলেন, আস্থার সংকট তো রয়ে গেছে। অনেকে দেশের চিকিৎসার ওপর আস্থা রাখতে পারছেন না। এটাও তো অস্বীকার করার মতো নয়। অনেক কারণেই মানুষ বিদেশে যাচ্ছেন। শেষ চেষ্টা করে দেখতে মানুষ বিদেশে যেতেই পারেন। কিন্তু ঢালাওভাবে বলা যাবে না যে, সব রোগী বিদেশে যাচ্ছেন। দেশে চিকিৎসা হচ্ছে না।
প্রধানমন্ত্রীর ব্যক্তিগত চিকিৎসক বলেন, দেশে এখন সব জটিল রোগের চিকিৎসা সুবিধা রয়েছে। কিডনি প্রতিস্থাপন চলে আসছে দীর্ঘ বছর ধরে। ডায়ালাইসিস সুবিধা এখন হাতের কাছে পাওয়া যাচ্ছে। ক্যান্সার রোগের থেরাপিসহ অত্যাধুনিক চিকিৎসা সুবিধা রয়েছে। ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে স্থায়ীভাবে শুরু হয়েছে বোনম্যারো সংযোজন। সীমিত পরিসরে হলেও শুরু হয়েছে লিভার সংযোজন। তারপরও মানুষের যা প্রত্যাশা, তা হয়তো পুরোপুরি পূরণ হয় না।
ভোরের আকাশ : চিকিৎসক ও রোগীর সম্পর্কে দূরত্ব রয়ে যাচ্ছে বলে অভিযোগ রয়েছে। প্রায় সময় ঘটে রোগীর স্বজন এবং ডাক্তার-নার্সদের মধ্যে হাতাহাতি ও মারামারির ঘটনা। বাস্তবতা কী বলে?
ডা. এবিএম আব্দুল্লাহ : রোগী ও চিকিৎসকদের পাল্টাপাল্টি অভিযোগ দীর্ঘদিনের। চিকিৎসকদের বিরুদ্ধে রোগীদের অভিযোগের শেষ নেই। ঠিকমতো দেখে না, আচরণ ভালো না, প্রেসক্রিপশনে অপ্রয়োজনীয় টেস্ট লেখেন এ ধরনের অনেক অভিযোগ করেন রোগীরা। তবে লোকজনের এমন ঢালাও অভিযোগ করা ঠিক না। আর রোগীদের অভিযোগ ও সমস্যা সমাধানের এখতিয়ার চিকিৎসকদের হাতে নেই।
এটা হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের প্রশাসনের দায়িত্ব। রোগীরা কী অভিযোগ করেন? তারা অভিযোগ করেন যে, হাসপাতালের পরিবেশ ভালো না, রোগীশয্যা ও টয়লেট নোংরা, সরকারি হাসপাতালে ওষুধ পাওয়া যায় না, চিকিৎসক ও নার্স সংকট এসব সমস্যার সমাধান চিকিৎসকদের হাতে নেই, তা সবাইকে বুঝতে হবে। চিকিৎসকদের একতরফা দোষ দিয়ে লাভ নেই।
তিনি আরো বলেন, দেশের স্বাস্থ্য ব্যবস্থার প্রতি মানুষের অভিযোগের শেষ নেই। অব্যবস্থাপনা, অনিয়ম, দুর্নীতি, চুরি তো রয়েই গেছে। এসব কিছুর জন্য তো চিকিৎসক দায়ী নন। এসব ঠিক না করে দেশের চিকিৎসার মান বাড়ানো যাবে না।
তাছাড়া রাজনৈতিক বিষয় রয়েছে। মেডিকেল কলেজে অধ্যাপক নেই। সংকট রয়েছে চিকিৎসক ও নার্সের। রাজনৈতিক দলাদলি তো রয়েই গেছে। সুতরাং ভালো ডাক্তার তৈরি করতে লাগবে ভালো পরিবেশ। ভালো ডাক্তার তৈরির প্রতিবন্ধকতা দূর না করলে চিকিৎসার মান বাড়বে না। ভালো ডাক্তার তৈরি করবেন না, শুধু গালি দিয়ে যাবেন, তা হতে পারে না। এসব কাজ প্রশাসনের। এ বিষয়ে প্রশাসনকেই দায়িত্ব নিয়ে সমস্যাসমূহের সমাধান করতে হবে।
ডা. এবিএম আব্দুল্লাহ আরো বলেন, আরেকটি বিষয় হলো, চিকিৎসারত অবস্থায় কোনো রোগী মারা গেলেই চিকিৎসকদের মারধর করা ঠিক না। ইচ্ছাকৃতভাবে ভুলের বিচার করতে দেশে আইন রয়েছে। তবে এটা সত্য যে, ইচ্ছাকৃতভাবে কোনো চিকিৎসক একজন রোগীকে খারাপ চিকিৎসাসেবা দেন না। অজান্তে কিছু কিছু ভুলের বা অভিজ্ঞতার ঘাটতির ঘটনা ঘটতে পারে। যার (চিকিৎসক) কাছে যেতেই হবে তার সঙ্গে মারামারি করলে তো হবে না।
এমন ঘটনা যতই বাড়বে, রোগী ও চিকিৎসকের মধ্যে দূরত্বতা ততই বাড়বে, যা আমরা কেউ প্রত্যাশা করি না। নিজেদের দায়িত্ব ঠিকমতো পালন করলেই এমন ঘটনা ঘটনার আশঙ্কা থাকে না। সর্বোপরি সংশ্লিষ্ট প্রশাসনকেই মূল দায়িত্ব পালন করতে হবে।
এমনিভাবে চলতে থাকলে দেশের চিকিৎসাসেবার ওপর মানুষের আস্থা হ্রাস পেতেই থাকবে। জীবনটাই তো আসল। আর বিদেশগামী রোগীর সংখ্যাও বাড়তেই থাকবে। চিকিৎসকদের দোষ দিয়ে বিদেশ যাওয়ার বিষয়টি যুক্তিযুক্ত হতে পারে না। দেশে সব জটিল রোগের চিকিৎসা সুবিধা রয়েছে।
ভোরের আকাশ/নি
মন্তব্য