-->
শিরোনাম

বৈশ্বিক স্বীকৃতি পেল শেখ হাসিনার কমিউনিটি ক্লিনিক প্রকল্প

নিখিল মানখিন
বৈশ্বিক স্বীকৃতি পেল শেখ হাসিনার কমিউনিটি ক্লিনিক প্রকল্প

নিখিল মানখিন: অবশেষে আনুষ্ঠানিকভাবে আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি পেয়েছে কমিউনিটি ক্লিনিক প্রকল্প। মঙ্গলবার জাতিসংঘে প্রথমবারের মতো কমিউনিটিভিত্তিক স্বাস্থ্যসেবাবিষয়ক একটি রেজুলেশন সর্বসম্মতিক্রমে গৃহীত হয়েছে।

 

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এটি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সফল নেতৃত্বের আরেকটি আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি। এই ক্লিনিক প্রকল্পটি ইতোমধ্যে প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবার রোলমডেল হিসেবে বিশ্বে সুনাম অর্জন করেছে। কমিউনিটি ক্লিনিক থেকে ইপিআই টিকা ও কোভিড ভ্যাকসিন প্রদানসহ সারা দেশের প্রান্তিক জনগণের স্বাস্থ্য, পরিবার পরিকল্পনা ও পুষ্টিসেবা দেয়ার জন্য বিনামূল্যে ৩০ ধরনের ওষুধ এবং স্বাস্থ্যসেবা সামগ্রী দেয়া হচ্ছে। বাড়ির পাশেই মিলছে স্বাস্থ্যসেবা।

 

দেশের মানুষকে নিরবচ্ছিন্ন স্বাস্থ্যসেবা দেয়ার লক্ষ্যে সরকার এ পর্যন্ত সারা দেশে পাবলিক-প্রাইভেট অংশীদারিত্বে ১৪ হাজারেরও বেশি কমিউনিটি ক্লিনিক প্রতিষ্ঠা করেছে। ‘কমিউনিটিভিত্তিক প্রাথমিক স্বাস্থ্য ব্যবস্থা: সার্বজনীন স্বাস্থ্য পরিষেবা অর্জনের লক্ষ্যে একটি অংশগ্রহণমূলক ও অন্তর্ভুক্তিমূলক পদ্ধতি’ শিরোনামের ঐতিহাসিক রেজুলেশনটি সরকারি-বেসরকারি অংশীদারিত্বে বাংলাদেশে কমিউনিটি ক্লিনিকভিত্তিক মডেল প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবা প্রতিষ্ঠায় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার অসামান্য উদ্ভাবনী নেতৃত্বকে আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি দিয়েছে জাতিসংঘ।

 

বাংলাদেশ কর্তৃক প্রস্তাবিত রেজুলেশনটিতে জাতিসংঘের সদস্য রাষ্ট্রগুলো কমিউনিটি ক্লিনিক প্রতিষ্ঠায় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সফল উদ্ভাবনী উদ্যোগের ব্যাপক স্বীকৃতি দিয়ে এই উদ্যোগকে ‘দ্য শেখ হাসিনা ইনিশিয়েটিভ’ হিসেবে উল্লেখ করে। এটি জনগণের স্বাস্থ্যসেবার উন্নয়ন এবং বৈশ্বিক স্বাস্থ্যসেবায় সাম্য আনয়নে বাংলাদেশের দৃঢ় প্রতিশ্রুতিতে প্রতিফলিত করে।

 

মঙ্গলবার সাধারণ পরিষদে রেজুলেশনটি উপস্থাপন করেন জাতিসংঘে নিযুক্ত বাংলাদেশের স্থায়ী প্রতিনিধি রাষ্ট্রদূত মোহাম্মদ আবদুল মুহিত। কমিউনিটি ক্লিনিকভিত্তিক স্বাস্থ্যব্যবস্থার প্রতি অকুণ্ঠ সমর্থনস্বরূপ জাতিসংঘের ৭০টি সদস্য রাষ্ট্র এই রেজুলেশনটি কো-স্পন্সর করে। রাষ্ট্রদূত মুহিত তার বক্তব্যে সার্বজনীন স্বাস্থ্য পরিষেবা অর্জনে এই রেজুলেশনের ইতিবাচক প্রভাব তুলে ধরেন।

 

তিনি জাতিসংঘ সদস্য রাষ্ট্রগুলো কর্তৃক এই রেজুলেশনের অনুমোদনকে ২০৩০ সালের মধ্যে সার্বজনীন স্বাস্থ্যসেবা অর্জনের বৈশ্বিক প্রচেষ্টায় এক অবিস্মরণীয় মাইলফলক হিসেবে উল্লেখ করেন।

 

তিনি বলেন, রেজুলেশনটির সফল বাস্তবায়ন কমিউনিটি ক্লিনিকভিত্তিক স্বাস্থ্যব্যবস্থা প্রবর্তনের মাধ্যমে বিশ্বের কোটি কোটি মানুষের স্বাস্থ্যসেবার উন্নয়নে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করবে।

 

সার্বজনীন স্বাস্থ্য পরিষেবা এবং জাতিসংঘ উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা অর্জনের নিমিত্ত আন্তর্জাতিক সহযোগিতা বৃদ্ধিতে এই রেজুলেশনের সুদূরপ্রসারী প্রভাব রয়েছে। কারণ এটি সদস্য দেশগুলোতে, বিশেষ করে উন্নয়নশীল দেশগুলোতে এই কমিউনিটি ক্লিনিকভিত্তিক মডেল স্বাস্থ্যব্যবস্থা প্রবর্তন ও বাস্তবায়নে আন্তর্জাতিক আর্থিক প্রতিষ্ঠান, বহুপক্ষীয় এবং আঞ্চলিক উন্নয়ন ব্যাংক ও দাতাদের যথাযথ কারিগরি ও আর্থিক সহযোগিতা প্রদানের জন্য আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়িক কাছে আহব্বান জানিয়েছেন স্থায়ী প্রতিনিধি।

 

কমিউনিটি ক্লিনিক প্রকল্পের কর্মকর্তারা ভোরের আকাশকে জানান, স্মার্ট কমিউনিটি ক্লিনিক ও স্মার্ট স্বাস্থ্যসেবা দেয়ার মাধ্যমে স্বাস্থ্য খাতে কমিউনিটি ক্লিনিকের সাফল্য জাতীয় ও আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত। কমিউনিটি ক্লিনিক থেকে ইপিআই টিকা ও কোভিড ভ্যাকসিন প্রদানসহ সারা দেশের প্রান্তিক জনগণের স্বাস্থ্য, পরিবার পরিকল্পনা ও পুষ্টিসেবা দেয়ার জন্য বিনামূল্যে ৩০ ধরনের ওষুধ এবং স্বাস্থ্যসেবা সামগ্রী দেয়া হচ্ছে।

 

বিনামূল্যে সেবাদান সহজ করার জন্য কর্মরত সব সিএইচসিপিকে ল্যাপটপ ও মডেম দেয়া হয়েছে। বর্তমানে সব কমিউনিটি ক্লিনিক থেকে ডিজিটালি অনলাইন রিপোর্টিং করা হচ্ছে। সেবা সহজীকরণের জন্য মাল্টিপারপাস হেলথ ভলান্টিয়ারের মাধ্যমে সিসিকর্ম এলাকায় অবস্থানরত খানার প্রত্যেক সদস্যের ডিজিটালি হেলথ ডাটা সংগ্রহ করা হয়েছে। এ পর্যন্ত ১১ লাখ গ্রামীণ জনগণকে হেলথ আইডি কার্ড দেয়া হয়েছে। ১০৭টি উপজেলায় এ কার্যক্রম চলমান। পর্যায়ক্রমে সারা দেশে হেলথ আইডি কার্ড দেয়া হবে।

 

জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান সদ্য স্বাধীন দেশের তৃণমূল পর্যায়ে প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করার লক্ষ্যে কমিউনিটি ক্লিনিকের ধারণা প্রবর্তন করেন। মাত্র সাড়ে তিন বছরেই দেশের সাধারণ মানুষের দোরগোড়ায় স্বাস্থ্যসেবা পৌঁছে দিতে তৎকালীন মহকুমা ও থানা পর্যায়ে স্বাস্থ্য অবকাঠামো গড়ে তুলেছিলেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব।

 

প্রকল্পের কর্মকর্তারা আরো জানান, আওয়ামী লীগ সরকারের ১৯৯৬-২০০১ মেয়াদের শুরুতেই আওয়ামী লীগ সরকার দেশব্যাপী প্রতি ৬ হাজার গ্রামীণ জনগোষ্ঠীর জন্য একটি করে মোট ১৮ হাজার কমিউনিটি ক্লিনিক স্থাপনের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে।

 

সেই আলোকে ২০০০ সালের ২৬ এপ্রিল জাতির পিতার জন্মস্থান গোপালগঞ্জের টুঙ্গিপাড়া উপজেলার পাটগাতী ইউনিয়নে দেশের সর্বপ্রথম ‘গিমাডাঙ্গা কমিউনিটি ক্লিনিক’ প্রতিষ্ঠা করে এর শুভ সূচনা হয় এবং ২০০১ সালের মধ্যেই ১০ হাজার ৭২৩টি অবকাঠামো স্থাপনপূর্বক প্রায় ৮ হাজার কমিউনিটি ক্লিনিকের কার্যক্রম চালু হয়।

 

বিএনপি-জামায়াত জোট সরকার ২০০১ সালে ক্ষমতায় এসে রাজনৈতিক প্রতিহিংসার কারণে কমিউনিটি ক্লিনিক কার্যক্রম বন্ধ করে দেয়। ২০০৯ সালে দেশ পরিচালনার দায়িত্ব নিয়ে আবার কমিউনিটি ক্লিনিক স্থাপনের কাজ শুরু করে আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন সরকার।

 

ক্লিনিক প্রকল্পের কর্মকর্তারা আরো বলেন, সেবাগ্রহীতার সংখ্যা বৃদ্ধি পাওয়ার পাশাপাশি সেবার পরিধি সম্প্রসারিত হওয়ার প্রেক্ষাপটে ৫ শতাংশের পরিবর্তে বর্তমানে ৮ শতাংশ জমিতে চার কক্ষবিশিষ্ট নতুন নকশার ভিত্তিতে কমিউনিটি ক্লিনিক নির্মাণ করা হচ্ছে। এ পর্যন্ত মোট ১৪ হাজার ২২৩টি কমিউনিটি ক্লিনিকের নির্মাণ কাজ সম্পন্ন হয়েছে।

 

এর মধ্যে ২০১৫-২০১৬ থেকে এ পর্যন্ত নতুন নকশার ১ হাজার ৮১১টি কমিউনিটি ক্লিনিক নির্মাণ করা হয়েছে। কমিউনিটি ক্লিনিকের সেবা কার্যক্রম পরিচালনার জন্য ২০২২ সালে ৭৭১ জন নতুন কমিউনিটি হেলথ কেয়ার প্রভাইডার (সিএইচসিপি) নিয়োগসহ এ পর্যন্ত মোট ১৪ হাজার ৪৩৮ জন সিএইচসিপি নিয়োগ দেয়া হয়েছে।

 

কমিউনিটি ক্লিনিকের একটি প্রধান বৈশিষ্ট্য হলো এটি সরকার ও জনগণের সম্মিলিত অংশীদারিত্বের একটি সফল কার্যক্রম; যার ধারাবাহিকতা অব্যাহত রাখা এবং স্থায়িত্বের লক্ষ্যে আমাদের সরকার ‘কমিউনিটি ক্লিনিক স্বাস্থ্য সহায়তা ট্রাস্ট আইন’ জাতীয় সংসদে পাস করেছে বলে জানান প্রকল্পটির কর্মকর্তারা।

 

কমিউনিটি বেইজড হেলথ কেয়ার (সিবিএইচসি) এর লাইন ডিরেক্টর ডা. মো. কাইয়ুম তালুকদার বলেন, কমিউনিটি ক্লিনিক আমাদের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার চিন্তা প্রসূত কার্যক্রম এবং বর্তমান সরকারের সাফল্যের এক উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত, যা দেশে এবং বিদেশে সর্বক্ষেত্রেই প্রশংসিত হয়েছে। এ কার্যক্রমের মাধ্যমে দরিদ্র এবং সুবিধাবঞ্চিত গ্রামীণ জনগোষ্ঠী তারা নিকটস্থ কমিউনিটি ক্লিনিক হতে সমন্বিত স্বাস্থ্য, পরিবার পরিকল্পনা এবং পুষ্টিসেবা গ্রহণ করে থাকে।

 

মো. কাইয়ুম তালুকদার বলেন, কমিউনিটি ক্লিনিক কার্যক্রমকে গতিশীল এবং টেকসই করার লক্ষ্যে মহান জাতীয় সংসদে কমিউনিটি ক্লিনিক স্বাস্থ্য সহায়তা ট্রাস্ট আইন অনুমোদন করা হয় এবং এই আইনের বলে কমিউনিটি ক্লিনিক স্বাস্থ্য সহায়তা ট্রাস্ট একটি সংবিধিবদ্ধ সংস্থা হিসেবে কর্মকান্ড চালিয়ে যাচ্ছে। বর্তমানে কমিউনিটি ক্লিনিক স্বাস্থ্য সহায়তা ট্রাস্ট এর আওতাধীন সিবিএসসি অপারেশন প্ল্যানের মাধ্যমে কমিউনিটি ক্লিনিকসমূহ পরিচালিত হচ্ছে।

 

আমাদের চার হাজারেরও অধিক কমিউনিটি ক্লিনিকে স্বাভাবিক প্রসবের ব্যবস্থা রয়েছে এবং এই ১৪ হাজার ২০৮টি কমিউনিটি ক্লিনিকের প্রতিটি ক্লিনিক প্রতি মাসে বাচ্চাদের জিপিআই কর্মকান্ডের মাধ্যমে টিকা প্রদান করা হয়ে থাকে। আমাদের কমিউনিটি ক্লিনিকে যে রোগীগুলো জটিল এবং দুরারোগ্য রোগ নিয়ে আসে কমিউনিটি ক্লিনিক থেকে তাদের নিকটস্থ স্বাস্থ্যকেন্দ্রে অথবা বিশেষায়িত হাসপাতালে পাঠানো হয়। এ ধরনের রেফারের রোগীর সংখ্যা এখন পর্যন্ত এক কোটির ওপরে।

 

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ব বিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক ডা. শারফুদ্দিন আহমেদ ভোরের আকাশকে বলেন, বাংলাদেশে স্বাস্থ্যসেবা খাতের চিত্র পাল্টে দিয়েছে কমিউনিটি ক্লিনিক। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার এ উদ্ভাবনী উদ্যোগ এখন বিশ্বনেতাদের কাছেও মডেল। মঙ্গলবার তারই ভূয়সী প্রশংসা ও স্বীকৃতি মিলল বিশ্ব দরবারে। বিশ্বনেতারা মডেলটি গ্রহণ করায় একে ঐতিহাসিক অর্জন।

 

স্বাধীনতা চিকিৎসক পরিষদের (স্বাচিপ) মহাসচিব অধ্যাপক ডা. এম আজিজ ভোরের আকাশকে বলেন, জাতিসংঘে প্রথমবারের মতো কমিউনিটিভিত্তিক স্বাস্থ্যসেবাবিষয়ক একটি রেজুলেশন সর্বসম্মতিক্রমে গৃহীত হয়েছে। ওই রেজুলেশনের মাধ্যমে বাংলাদেশে কমিউনিটি ক্লিনিকভিত্তিক মডেল প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবা প্রতিষ্ঠায় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার অসামান্য উদ্ভাবনী নেতৃত্বকে আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি দেয়া হয়েছে।

 

এটি জনগণের স্বাস্থ্যসেবার উন্নয়ন এবং বৈশ্বিক স্বাস্থ্যসেবায় সাম্য আনয়নে বাংলাদেশের দৃঢ় প্রতিশ্রুতিতে প্রতিফলিত করে।

 

ভোরের আকাশ/নি 

মন্তব্য

Beta version