-->
শিরোনাম
আজ বিশ্ব হেপাটাইটিস দিবস

৯০ শতাংশ রোগী জানে না, তারা আক্রান্ত

নিখিল মানখিন
৯০ শতাংশ রোগী জানে না, তারা আক্রান্ত

নিখিল মানখিন: হেপাটাইটিস সংক্রমণ বুঝতে পারেননি রাজধানীর মেরুল বাড্ডাবাসী মো. রহমত আলী (৪৬)। প্রায় সময় ক্লান্তি ও দুর্বলতা অনুভব করতেন তিনি। মুখে ছিল না রুচি। কমতে থাকে ওজন। তার চোখ থাকত হলুদে। জন্ডিস ভেবে তিনি কবিরাজি চিকিৎসাও গ্রহণ করেছেন।

 

কিন্তু শেষ সময়ে এসে মহাখালীর শেখ রাসেল গ্যাস্ট্রোলিভার ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করিয়ে লিভার সিরোসিসে আক্রান্ত হওয়ার বিষয়টি জানতে পারেন রহমত আলী। গত ৬ মাস ধরে চলছে তার এলোপ্যাথি চিকিৎসা।

 

কিন্তু অত্যন্ত ব্যয়বহুল চিকিৎসা চালাতে গিয়ে দিশাহারা হয়ে পড়েছে এ গরিব রোগীর পরিবার। এভাবে হেপাটাইটিস একটা নীরব ঘাতক হিসেবে মানুষের দেহে বছরের পর বছর বসবাস করে চলে। প্রতি ১০ জনের ৯ জন জানেই না, তারা হেপাটাইটিস বি ও সিতে আক্রান্ত বলে জানান বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকরা।

 

জন্ডিস ও লিভার জটিলতায় আক্রান্ত হয়ে গত ১৪ মে রাজধানীর একটি হাসপাতালে মারা যান ক্যাম্পাস লাইভ২৪ ডট কমের প্রধান সম্পাদক আজহার মাহমুদ। মৃত্যুকালে তার বয়স হয়েছিল ৫২ বছর। তিনি অকালে ঝরে গেলেন।

 

দৈনিক সমকাল, দৈনিক মানবজমিন ও বাংলাদেশ প্রতিদিন, ভয়েস অব আমেরিকা, বৈশাখী টিভি ও বাংলাদেশ টেলিভিশনে অপরাধ বিষয়ক প্রতিবেদক হিসেবে কর্মরত ছিলেন তিনি। শেষ সময়ে শনাক্ত হওয়ার কারণে তার চিকিৎসা করাতে গিয়ে চিকিৎসকরা অসহায় হয়ে পড়েন বলে পারিবারিক সূত্রে জানা গেছে।

 

এদিকে জন্ডিসে আক্রান্ত হয়ে দীর্ঘদিন কবিরাজি চিকিৎসা গ্রহণ করেছেন ময়মনসিংহের হালুয়াঘাট থানাধীন গোবরাকুড়া গ্রামের আকবর হোসেন (৩৭)।

 

তিনি ভোরের আকাশকে জানান, থানা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে গেলে জন্ডিস থাকার বিষয়টি তাকে জানানো হয়। দীর্ঘ বছর ধরে তিনি জন্ডিসে আক্রান্ত। তিনি বেশি করে আখের রস খেতে শুরু করেন। কবিরাজি চিকিৎসা নিয়েছেন। কিন্তু স্বাস্থ্যের দ্রুত অবনতি ঘটতে থাকে। একপর্যায়ে তিনি ভর্তি হন শেখ রাসেল গ্যাস্ট্রোলিভার ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালে। তার লিভার জটিলতা রয়েছে প্রাথমিক পর্যায়ে। গত দু’মাসের চিকিৎসায় তার স্বাস্থ্যের অনেক উন্নতি হয়েছে বলে জানান আকবর হোসেন।

 

বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকরা বলছেন, বাংলাদেশে হেপাটাইটিস সংক্রমণকে এক নীরব ঘাতক হিসেবে দেখা হচ্ছে। এ হেপাটাইটিস সংক্রমণ বাংলাদেশে জনসাধারণের মধ্যে জন্ডিস রোগ হিসেবে পরিচিত। প্রকৃত অর্থে হেপাটাইটিস হলো ভাইরাসজনিত লিভারের রোগ। চিকিৎসা বিজ্ঞানে ৫ ধরনের হেপাটাইটিস রয়েছে। হেপাটাইটিস এ এবং ই স্বল্পমেয়াদি লিভার রোগ। এটি বিশ্রাম নিলে একপর্যায়ে সেরে ওঠে। তবে প্রাণঘাতী হচ্ছে হেপাটাইটিস বি এবং সি ভাইরাসের সংক্রমণ।

 

প্রাথমিক অবস্থায় লিভারের কোনো রোগ ধরা পড়লে তা ৬০ থেকে ৭০ শতাংশই প্রতিরোধ করা সম্ভব। এক্ষেত্রে অনেকের জ্ঞানেরও অভাব রয়েছে। কারো হেপাটাইসিস ‘বি’ বা ‘সি’ ভাইরাস থাকলে এবং সময়মতো তা প্রতিরোধ না করলে ধীরে ধীরে লিভার সিরোসিস বা ক্যান্সারে রূপ নেয়। এ ধরনের রোগীদের শেষ চিকিৎসাই হচ্ছে লিভার প্রতিস্থাপন। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার হিসেবে দেখা যায়, বাংলাদেশে হেপাটাইটিস বি ও সি ভাইরাসে প্রায় ১ কোটি মানুষ আক্রান্ত।

 

বেসরকারি হিসেবে হেপাটাইটিসে প্রতি বছর ২০ হাজারের বেশি মানুষের মৃত্যু হয় বাংলাদেশে। হেপাটাইটিস নিয়ে উদ্বেগের সবচেয়ে বড় কারণ হচ্ছে সারা বিশ্বে হেপাটাইটিস বি ও সি ভাইরাসে সংক্রমিত ১০ জনের মধ্যে ৯ জনই জানে না, শরীরে এ ভাইরাস তারা বহন করছে। এ রোগে আক্রান্তরা অনেক ক্ষেত্রেই সুচিকিৎসা পায় না।

 

আর বাংলাদেশে হেপাটাইটিসে আক্রান্তদের একটা বড় অংশ ঝাড়ফুঁক, পানি পড়া, ডাব পড়া নেয়ার মতো কবিরাজি চিকিৎসার দ্বারস্থ হন।

 

অ্যাসোসিয়েশন ফর দ্য স্টাডি অব দ্য লিভার, ঢাকার মহাসচিব, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের ইন্টারভেনশনাল হেপাটোলজি বিভাগের অধ্যাপক ডা. মামুন আল মাহতাব স্বপ্নীল ভোরের আকাশকে জানান, দীর্ঘ বছর ধরে হেপাটাইটিস ভাইরাস প্রতিরোধে কাজ করে যাচ্ছে আমাদের অ্যাসোসিয়েশন।

 

বাংলাদেশে সাধারণত ‘এ, বি, সি ও ই’ ভাইরাস দ্বারা লিভার হেপাটাইটিস হয়ে থাকে। জন্ডিস দেখা দিলে এ রোগটি ধরা যায়, যদিও নিশ্চিত হওয়ার জন্য রোগীর রক্তে ভাইরাসের নির্দিষ্ট এন্টিজেন বা এন্টিবডি উপস্থিত থাকা প্রয়োজন। হেপাটাইটিস জন্ডিস হিসেবে বা জন্ডিস ছাড়াও ধরা পড়তে পারে। হেপাটাইটিস ‘বি’ দ্বারা আক্রান্ত বেশিরভাগ রোগীর দেহে ভাইরাসটি বাহক হিসেবে সুপ্ত অবস্থায় থাকে। কোনো ধরনের উপসর্গ দেখা না বলে এ-সংক্রান্ত জটিলতা দেখা না দিলে রোগীরা সাধারণত চিকিৎসকদের শরণাপন্ন হন না।

 

এ-সংক্রান্ত রোগের ব্যাপকতা নির্ভর করে জীবাণুটি কখন শরীরে প্রবেশ করেছিল এবং ব্যক্তিটির রোগপ্রতিরোধ ক্ষমতা কতটুকু। তাই হেপাটাইটিস ভাইরাস প্রতিরোধে সচেতন থাকা দরকার। তিনি আরো জানান, বিশ্বের প্রায় ৩৫ কোটি মানুষ হেপাটাইটিস ভাইরাসে আক্রান্ত, যা মোট জনগোষ্ঠীর এক-তৃতীয়াংশ। প্রতি বছর হেপাটাইটিসজনিত রোগে বিশ্বের প্রায় ১৪ লাখ মানুষের মৃত্যু হয়।

 

আর বাংলাদেশে মোট আক্রান্তের সংখ্যা প্রায় ১ কোটি এবং প্রতি বছর মারা যায় প্রায় ২০ হাজার রোগী। আক্রান্ত বেশিরভাগ মানুষই জানে না তারা ভাইরাসটিতে আক্রান্ত। সরকারি হাসপাতালে বিভিন্ন রোগে মৃত্যু হওয়ার মোট সংখ্যার বিবেচনায় লিভারজনিত কারণে মৃত্যুর সংখ্যা রয়েছে ৩ নম্বরে।

 

বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকরা বলছেন, প্রতি বছর হেপাটাইটিসজনিত রোগে বিশ্বের প্রায় ১৪ লাখ মানুষের মৃত্যু হয়। আক্রান্ত বেশিরভাগ মানুষই জানে না, তারা ভাইরাসটিতে আক্রান্ত। এভাবে নিজের অজান্তেই আক্রান্ত ব্যক্তি ভাইরাসটি অন্যদের মাঝে ছড়িয়ে দেয়। আর শরীরে থাকা ভাইরাসটি যেকোনো সময় সক্রিয় হয়ে আক্রান্তকারীকে মেরে ফেলতে পারে বা তাকে শারীরিকভাবে অক্ষম করে ফেলতে পারে।

 

এটি একটি দীর্ঘমেয়াদী রোগ, তা সত্ত্বেও বিশ্বব্যাপী এ রোগটি সম্পর্কে সচেতনতা অত্যন্ত কম। এমনকি স্বাস্থ্যকৌশল প্রণয়নকারী দপ্তরগুলোও এ বিষয়ে উদাসীন। লিভার সিরোসিস ও লিভার ক্যান্সারের জন্য প্রধানত দায়ী হেপাটাইটিস। রোগটি বিশ্বব্যাপী মহামারি আকারে ছড়িয়ে পড়ার সামর্থ্য রাখে। পাঁচ ধরনের ভাইরাস হেপাটাইটিস রোগটির জন্য দায়ী।

 

এগুলোকে ইংরেজি এ, বি, সি, ডি এবং ই দিয়ে চিহ্নিত করা হয়। এগুলো সাধারণত দূষিত পানি ও খাবারের মাধ্যমে, আক্রান্ত ব্যক্তির রক্তের মাধ্যমে, যৌনবাহিত হয়ে বা আক্রান্তের শরীরে কোনো তরলের সংস্পর্শে ছড়িয়ে পড়ে।

 

পাঁচটি ভাইরাসের মধ্যে ‘বি’ ভাইরাসটি সবচেয়ে সাধারণ। ভাইরাসটি আক্রান্ত মায়ের শরীর থেকে নবজাতক বা দুগ্ধপোষ্য শিশুর মধ্যে বাহিত হতে পারে। এছাড়া দূষিত সিরিঞ্জের মাধ্যমে মাদকগ্রহণকারীদের মাঝে ভাইরাসটি ছড়িয়ে পড়ার প্রবল সম্ভাবনা আছে। ‘ই’ ভাইরাসটি সাধারণত দূষিত পানি বা খাবারের মাধ্যমে ছড়িয়ে থাকে।

 

ডব্লিউএইচওর মতে, উন্নয়নশীল দেশগুলোয় হেপাটাইটিস ছড়িয়ে পড়ার জন্য ‘ই’ ভাইরাসটি প্রধানত দায়ী। উন্নত অর্থনীতির দেশগুলোয়ও এর সংক্রমণ ক্রমেই বাড়ছে বলে জানিয়েছে ডবিøউএইচও। ‘এ’ ও ‘বি’ ভাইরাসের কার্যকরী ভ্যাকসিন বাজারে পাওয়া যায়। এটি ‘ডি’ এর সংক্রমণেও ব্যবহার করা যায়, আর ‘ই’ ভাইরাসের ভ্যাকসিন তৈরি হলেও এখনো সহজলভ্য হয়ে ওঠেনি। ‘সি’ ভাইরাসের কোনো ভ্যাকসিন এখনো তৈরি করা যায়নি।

 

এদিকে বাংলাদেশে এখনো হেপাটাইটিস ভাইরাসজনিত রোগের চিকিৎসা ব্যয়বহুল উল্লেখ করে বিশেষ সচেতন থাকার জন্য পরামর্শ দিয়েছেন চিকিৎসা বিশেষজ্ঞরা।

 

অ্যাসোসিয়েশন ফর দ্য স্টাডি অব দ্য লিভারের সভাপতি অধ্যাপক সেলিমুর রহমান ভোরের আকাশকে বলেন, বর্তমানে দেশে হেপাটাইটিস ‘বি’ পজিটিভ’ ও ‘সি’ পজিটিভ ভাইরাসের জীবাণু বহনকারী মানুষের সংখ্যা বেড়েই চলেছে। হেপাটাইটিস ‘বি’ ও ‘সি’ সাধারণত রক্ত, সুঁচ ও সিরিঞ্জের মাধ্যমে শরীরে প্রবেশ করে। নিয়মিত পরীক্ষা করানো উচিত। রোগীর শরীরে অন্য কারো প্রবেশ করানোর আগে সেই রক্ত ভালভাবে পরীক্ষা করা উচিত।

 

সুঁচ ব্যবহারে সাবধানতা অবলম্বন করতে হবে। আর ডিসপোজিবল সিরিঞ্জ ব্যবহার করতে হবে। হেপাটাইটিস ‘এ’ ও ‘ই’ ভাইরাস প্রতিরোধে বিশুদ্ধ পানি খেতে হবে। তিনি আরো বলেন, ‘বি পজিটিভ’ ভাইরাসে আক্রান্তদের চিকিৎসায় ট্যাবলেট ও ইনজেকশন ব্যবহৃত হয়। প্রতিটি ২৫ টাকা থেকে ২০০ টাকা মূল্যের ট্যাবলেট দীর্ঘদিন ধরে খেতে হয়।

 

আর প্রতিটি ১৫ হাজার থেকে ২০ হাজার টাকা মূল্যের ইনজেকশন প্রতি সপ্তাহে একটি করে খেতে হয়। রোগীর অবস্থা অনুযায়ী ৬ মাস থেকে ১ বছর ধরে এ ইনজেকশন দিতে হয়। ‘সি’ ভাইরাসের চিকিৎসায় ট্যাবলেট দিয়ে চলে না। শুধু ইনজেকশন দিয়ে করাতে হয় বলে চিকিৎসা ব্যয়ও বেশি হয়ে থাকে। এসব ভাইরাসজনিত রোগের হাত থেকে রেহাই পেতে স্বাস্থ্য সচেতনতার ওপর বিশেষ জোর দিয়েছেন অধ্যাপক সেলিমুর রহমান।

 

পূর্ণাঙ্গ ও স্থায়ী লিভার প্রতিস্থাপন সেন্টার নেই: লিভার প্রতিস্থাপনে কয়েকবার সফলতার মুখ দেখেছে বাংলাদেশ। তবে অর্থ, যন্ত্রপাতি ও প্রশিক্ষিত জনবলের অভাবে দেশে পূর্ণাঙ্গ ও স্থায়ী লিভার প্রতিস্থাপন সেন্টার স্থাপন করা সম্ভব হচ্ছে না বলে জানান বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকরা।

 

তারা বলেন, পূর্ণাঙ্গ সেন্টার না থাকায় লিভার প্রতিস্থাপনের প্রয়োজন হলে রোগীকে বিদেশে পাড়ি দিতেই হয়। দেশি-বিদেশি হাসপাতালগুলোর সম্মিলিত প্রচেষ্টায় দেশে এ পর্যন্ত হাতেগোনা কয়েকজন রোগীর লিভার প্রতিস্থাপন করানো হয়েছে। প্রতিটি লিভার প্রতিস্থাপনে একক কোনো হাসপাতালের কৃতিত্ব নেই। বারডেম, ল্যাবএইড ও বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ে হাতেগোনা কিছুসংখ্যক রোগীর লিভার প্রতিস্থাপন করানো হয়েছে।

 

এ প্রতিস্থাপন কাজের মধ্যে তিনটিই হয়েছে বারডেম হাসপাতালে। ব্যয়বহুল চিকিৎসা হওয়ায় লিভার প্রতিস্থাপন করাতে না পেরে অকালে মারা যায় অনেক লিভার ফেইলিউর রোগী।

 

ভোরের আকাশ/নি 

মন্তব্য

Beta version