দেশের প্রতিটি প্রান্তে মিডওয়াইফের সেবা সহজলভ্য করা গেলে নিরাপদ স্বাভাবিক প্রসব যেমন বাড়বে তেমনি মা ও নবজাতকের মৃত্যুঝুঁকি কমে আসবে উল্লেখযোগ্য হারে। ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের জনস্বাস্থ্য বিষয়ক শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ব্র্যাক জেমস পি গ্রান্ট স্কুল অফ পাবলিক হেলথ (ব্র্যাক জেপিজিএসপিএইচ) এর সাম্প্রতিক করা এক গবেষণায় এ চিত্র উঠে এসেছে।
গবেষণা প্রতিবেদনটি স্বাস্থ্যসেবা খাতে কার্যকরভাবে মিডওয়াইফদের দক্ষতা কাজে লাগানোর যে সুযোগ আর তার পাশাপাশি যেসব প্রতিবন্ধকতা রয়েছে সেগুলোর দিকেও আলোকপাত করেছে। “মিডওয়াইফদের কর্মপরিবেশ এবং তাদের দক্ষতা প্রয়োগের পর্যালোচনা” শিরোনামে পরিচালিত এ গবষেণার মূল লক্ষ্যই ছিলো দেশে মিডওয়াইফদের কাজের পরিবেশটা ঠিক কেমন তার একটি চিত্র তুলে ধরা ও তাদের কর্মদক্ষতাকে সর্বোচ্চ প্রয়োগের মাধ্যমে কিভাবে গর্ভবতী মা ও তার নবজাতকের সঠিক সেবার আরো উন্নতি ঘটানো যায় তার অনুসন্ধান করা।
রোববার (২৮ মে) আন্তর্জাতিক নিরাপদ মাতৃত্ব দিবস ২০২৩ উপলক্ষ্যে বাংলাদেশ হেলথ রিপোর্টার্স ফোরামের সহযোগিতায় ব্র্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের মিডওয়াইফারি এডুকেশন প্রোগ্রাম তাদের আদাবর একাডেমিক সাইটে এই গবেষণা প্রতিবেদন প্রকাশের আয়োজন করে।
প্রতিবেদনের মূল অনুসন্ধান থেকে প্রাপ্ত তথ্যের মধ্যে গুরুত্বপূর্ন একটি হচ্ছে মিডওয়াইফরা তাদের কর্মক্ষেত্রে "মিডওয়াইফ" পদবি নিয়ে নিযুক্ত হওয়ার পরও প্রায়ই দেখা যায় তাদের পেশাগত ভূমিকার পরিবর্তে নার্সিং সেবা দিতে কিংবা অন্যান্য প্রশাসনিক দায়িত্ব পালন করতে হচ্ছে। সরকারি প্রতিষ্ঠানের তূলনায় এই চিত্র বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে বেশি দেখা গেছে, যেখানে মিডওয়াইফরা নিয়মিত ভাবেই নার্সের কাজ করছে। গবেষণায় পাওয়া গেছে মিডওয়াইফদের একটি উল্লেখযোগ্য অংশ মিডওয়াইফের নির্ধারিত সেবা দেয়ার বদলে প্রশাসনিক দায়িত্ব পালন করছে। প্রতিবেদনটি বলছে মিডওয়াইফারি দক্ষতা সম্পূর্ণরূপে কাজে লাগানোর প্রয়োজনীয় পরিবেশ তৈরি করে মিডওয়াইফের সেবার পরিধি নির্দিষ্ট করে তারপর র জন্য বেসরকারী সংস্থাগুলিতে তাদের পদায়ন করাটা জরুরি।
মিশ্র পদ্ধতি অনুসরণে করা এ গবেষণাটি কর্মক্ষেত্রে মিডওয়াইফদের মুখোমুখি হওয়া চ্যালেঞ্জগুলিও উন্মোচন করেছে। সেগুলোর মধ্যে রয়েছে রোগীর পরিবারের সদস্য, মিথ্যা অভিযোগ এবং স্বাভাবিক প্রসব থেকে বিরত থাকার চাপসহ বিভিন্ন উৎস থেকে উদ্ভূত হয়েছিল। মিডওয়াইফারি নয় এমন কাজের জন্য মিডওয়াইফদের অর্পণ করে এবং তাদের ভূমিকা ও দায়িত্বকে ক্ষুণ্ন করে নিয়োগকর্তারাও এই চ্যালেঞ্জগুলিতে অবদান রেখেছেন। প্রতিবেদনে মিডওয়াইফদের জন্য সহায়ক ও সক্ষম কাজের পরিবেশ নিশ্চিত করতে এই চ্যালেঞ্জ মোকাবেলার গুরুত্বের ওপর জোর দেওয়া হয়েছে।
সীমিত সংগতি নিয়ে পরিচালিত হলেও এই গবেষণা প্রতিবেদনটি মিডওয়াইফারি এবং স্বাস্থ্যসেবার ক্ষেত্রে একটি উল্লেখযোগ্য সংযোজন বলে মনে করেন গবেষক ড. জাহিদুল কাইয়ুম। তিনি বলেন “আমাদের উচিত মিডওয়াইফারি দক্ষতা যেখানে যতটা সম্ভব ব্যবহার করার চেষ্টা করা। পাশাপাশি এমন একটি উপায় স্বাস্থ্য ব্যবস্থার সংস্কারের চেষ্টা করা উচিত যাতে মিডওয়াইফরা নিরাপদ মাতৃত্বে যথেষ্ট অবদান রাখতে পারে। মিডওয়াইফরা প্রাইভেট সেক্টরে একজন সম্ভাব্য উদ্যোক্তাও হতে পারে, যা মা ও নবজাতকের স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করতে বড় ভূমিকা রাখবে।”
২৫৬ জন পেশজীবীর উপর পরিচালিত এই জরিপ থেকে বেশ কিছু সুপারিশ উঠে এসেছে। মিডওয়াইফরা তাদের পেশা সম্পর্কে আশাবাদী এবং তাদের পেশার উন্নয়নে কিছু ব্যবস্থা নেওয়ার পরামর্শ দেন। মিডওয়াইফারি এডুকেশন প্রোগ্রামের প্রধান ডা. শারমিনা রহমান বলেন “মিডওয়াইফাদের শুধু নিয়োগ করলেই হবে না, তাদেরকে তাদের কাজটা ঠিক ভাবে করতে দিতে হবে। গর্ভবতী মা এবং তার নবজাতকের জন্য যে সেবা গুলো তার দেবার কথা তাকে সেই সেবাটাই ঠিক ভাবে দিতে হবে। মিডওয়াইফ কে দিয়ে নার্সের কাজ করানো যাবে না। ”
সরকারি খাতে মিডওয়াইফ নিয়োগ বাড়ানোর পাশপাশি সমস্ত বেসরকারি হাসপাতাল ও ক্লিনিকে মিডওয়াইফারি পদ সৃষ্টি করার আবেদন জানিয়েছেন তারা। মিডওয়াইফারি পেশা সম্পর্কে সমাজের সব স্তরের মানুষের ভেতর সচেতনতা বাড়ানোর এবং প্রসুতি মা ও তার নবজাতকের সেবায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখার সুযোগ প্রাপ্তির উপর বিশেষ জোর দেন। তারা মনে করেন বাংলাদেশ যদি বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার সুপারিশের সাথে তাল মিলিয়ে স্বাস্থ্যসেবায় মিডওয়াইফদের ভূমিকার ব্যাপারে সচেতন হয় তাহলে নিরাপদ স্বাভাবিক প্রসব বাড়িয়ে মা ও নবজাতকের জীবন রক্ষার প্রয়োজনীয় যে লক্ষ্য নির্ধারন করা হয়েছে তা অর্জন করা সম্ভব।
প্রকাশনা অনুষ্ঠানে কলাম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ড. আহমেদ মুশতাক রাজা চৌধুরি বলেন “নির্ধারিত সময়সীমার মধ্যে বাংলাদেশকে এগিয়ে যেতে এবং মাতৃস্বাস্থ্য যেসব টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা রয়েছে সেগুলো অর্জন করতে হলে আমাদের ব্যাতিক্রম ভাবে চিন্তা করতে হবে। এক্ষেত্রে অবশ্যই মিডওয়াইফারির পেশা হিসেবে সম্প্রসারন এবং দেশের প্রতিটি ইউনিয়নে তাদের নিয়োগ একটি অপরিহার্য বিষয়।”
ভোরের আকাশ/আসা
মন্তব্য