আরিফ সাওন: বাংলাদেশে ই-সিগারেট এবং ভ্যাপিং এর ব্যবহার তরুণ এবং যুব সমাজের মধ্যে উদ্বেগজনক হারে দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে। অনেক তরুণের কাছে এখন ইলেকট্রনিক সিগারেট ফ্যাশন হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে। এতে উদ্বিগ্ন সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞরা।
তারা বলছেন, উদ্ভাবনী কৌশল, সুগন্ধি ব্যবহার এবং আকর্ষণীয় ডিজাইনের কারণে কিশোর এবং তরুণদের মাঝে বিশেষত বিদ্যালয়গামী শিশুদের মধ্যে এসব তামাকপণ্যের জনপ্রিয়তা ব্যাপকভাবে বৃদ্ধি পাচ্ছে। জনস্বাস্থ্য সুরক্ষায় ভারত, শ্রীলঙ্কা, থাইল্যান্ড, সিঙ্গাপুরসহ ৩২টি দেশ এসব পণ্য বিক্রয় নিষিদ্ধ করেছে। যুক্তরাজ্যসহ বহুদেশ এসব পণ্য নিষিদ্ধের জন্য কাজ করছে। দ্রুতই আইন সংশোধন করে তা বন্ধ করা উচিত বলে তারা মনে করেন।
জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক ডা. লেলিন চৌধুরী বলেন, ই-সিগারেট সিগারেটের মতই স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর। এটা শারীরিক ও মানসিক ক্ষতি করে। ই-সিগারেটের কারণে ক্যান্সারসহ নানা ধরনের শারীরিক জটিলতা দেখা দিতে পারে। চিন্তা শক্তি কমে যেতে পারে। তরল নিকোটিনযুক্ত ই-সিগারেট আমাদের যুব সমাজ বেশি ব্যবহার করছে। পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে আইন করে এটি বন্ধ করা হয়েছে। আমাদের দেশেও আইন করে এটিকে বাদ দিতে হবে।
প্রজ্ঞার নির্বাহী পরিচালক এবিএম জুবায়ের বলেন, দেশে তামাক নিয়ন্ত্রণ আইনের খসড়া সংশোধনী থেকে ই-সিগারেট ও ভ্যাপিং পণ্য নিষিদ্ধের প্রস্তাব বাদ দিতে ভয়েস অব ভেপারস এবং এশিয়া হার্ম রিডাকশন অ্যালায়েন্স অতি সম্প্রতি একটি সামিট এবং গোলটেবিল বৈঠক করেছে, যার নেপথ্যে ছিল ফিলিপ মরিসের (পিএমআই) অর্থপুষ্ট ফাউন্ডেশন ফর এ স্মোক ফ্রি ওয়ার্ল্ড (এফএসএফডব্লিউ) এর অনুদানপ্রাপ্ত সংস্থা এবং প্রতিনিধি। এসব আয়োজনে সরকারের সংশ্লিষ্ট সংস্থার প্রতিনিধিদেরকেও যুক্ত করা হয়েছে এবং গনমাধ্যম ও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ব্যাপক প্রচার চালানো হয়েছে। একইসাথে বিশেষ ক্রোড়পত্র প্রকাশের মাধ্যমে বিশ্বসাস্থ্য সংস্থাসহ বেশকিছু আর্ন্তজাতিক সংস্থার ই-সিগারেট ও ভ্যাপিং বিরোধী অবস্থানকে বিকৃতভাবে উপস্থাপন করা হয়েছে, যা অত্যন্ত উদ্বেগজনক।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (ডব্লিউএইচও) প্রকাশিত WHO Report on Global Tobacco Epidemic 2021 এ ইলেক্ট্রনিক নিকোটিন ডেলিভারি সিস্টেমস (ENDS) অর্থাৎ ই-সিগারেটসহ সকল ইমার্জিং টোব্যাকো প্রোডাক্টকে স্বাস্থ্যের জন্য মারাত্মক ক্ষতিকর পণ্য হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে। এগুলো আসক্তিসহ নানাবিধ স্বাস্থ্যক্ষতি তৈরি করে। শিশু-কিশোরদের মধ্যে যারা এসব পণ্যে আসক্ত তাদের মধ্যে সিগারেট শুরু করার সম্ভাবনা দ্বিগুণেরও বেশি। অর্থাৎ, ইলেক্ট্রনিক নিকোটিন ডেলিভারি প্রোডাক্ট তামাকপণ্য ব্যবহারের “gateway”হিসেবেও কাজ করে বলে প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে।
বাংলাদেশের মোট জনগোষ্ঠির প্রায় ৪৮ শতাংশই তরুণ, যাদের বয়স ২৪ বছর বা তার নিচে। অর্থাৎ বাংলাদেশ এখন ডেমোগ্রাফিক ডিভিডেন্ট সময়কাল অতিবাহিত করছে যেখানে, নির্ভরশীল জনগোষ্ঠির তুলনায় কর্মক্ষম জনগোষ্ঠির সংখ্যা বেশি। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সাম্প্রতিক সময়ে তরুণদের মধ্যে ক্ষতিকর ইলেকট্রনিক সিগারেটের ব্যবহার বেশ চোখে পড়ছে। অন্য তরুণদেরও এটি আকৃষ্ট করছে। অথচ একটি দেশের আর্থ-সামাজিক উন্নয়ন এবং ইতিবাচক পরিবর্তনে তরুণ জনগোষ্ঠির অবদান অতি গুরুত্বপূর্ণ। বাংলাদেশে বিদ্যমান পরিস্থিতি বিবেচনায় ইমার্জিং টোব্যাকো প্রোডাক্ট বা ই-সিগারেটসহ সব ভ্যাপিং ও হিটেড তামাকপণ্যের উৎপাদন, আমদানি, বিক্রয় ও বাজারজাতকরণ নিষিদ্ধ করতে হবে।
স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয় ধূমপান ও তামাকজাত দ্রব্য ব্যবহার (নিয়ন্ত্রণ) আইন, ২০০৫ (২০১৩ সালে সংশোধিত) অধিকতর শক্তিশালীকরণের লক্ষ্যে ইলেকট্রনিক নিকোটিন ডেলিভারি সিস্টেম (ই-সিগারেট, ভ্যাপিং), হিটেড টোব্যাকো প্রোডাক্টসহ এধরনের সকল পণ্য নিষিদ্ধের প্রস্তাব করা হয়েছে। এছাড়া সংশোধিত আইনে সকল ইলেকট্রনিক নিকোটিন ডেলিভারি সিস্টেম, এর যন্ত্রাংশ বা অংশ বিশেষ (ই-সিগারেট, ভ্যাপ, ভ্যাপিং, ভ্যাপার ইত্যাদি) হিটেড টোব্যাকো প্রোডাক্টস, হিট নট বার্ন এবং ওরাল নিকোটিন পাউচ যে নামেই অভিহিত হোক না কেন, এগুলোর উৎপাদন, আমদানি, রপ্তানি, সংরক্ষণ, বিজ্ঞাপন, প্রচার-প্রচারণা, প্রণোদনা, পৃষ্ঠপোষকতা, বিপণন, বিতরণ, ক্রয়-বিক্রয় ও পরিবহন নিষিদ্ধের প্রস্তাব করা হয়েছে।
সম্প্রতি এক অনুষ্ঠানে স্বাস্থ্যসেবা বিভাগের অতিরিক্ত সচিব এবং জাতীয় তামাক নিয়ন্ত্রণ সেলের সমন্বয়কারী হোসেন আলী খোন্দকার বলেন, স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় মনে করে ই-সিগাটের বা ভ্যাপিং সিগারেটের মতোই স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর। তাই এর উৎপাদন, আমদানি এবং বিক্রয় সম্পূর্ণ নিষিদ্ধের প্রস্তাব করা হয়েছে সংশোধনী আইনে। শীঘ্রই তা কেবিনেটে উঠবে।
ই-সিগারেট বিক্রি নিষিদ্ধ করা হলে তরুণ ও কিশোর বয়সীদের ধূমপানে আসক্ত হওয়া থেকে বিরত রাখা যাবে, যা ২০৪০ সালের মধ্যে তামাকমুক্ত বাংলাদেশ অর্জনে সহায়তা করবে।
ভোরের আকাশ/নি
মন্তব্য