-->

আক্রান্ত ও মৃত্যু বেশি ১৮-৪০ বছর বয়সিদের

আরিফ সাওন
আক্রান্ত ও মৃত্যু বেশি ১৮-৪০ বছর বয়সিদের

আরিফ সাওন : চলতি বছর ডেঙ্গুতে ১৮ থেকে ৪০ বছর বয়সের মানুষ আক্রান্ত বেশি হয়েছেন। মৃত্যুও হয়েছে এই বয়সি মানুষ বেশি। এছাড়া লিঙ্গভেদে আক্রান্তের হারে অনেক কম হলেও মৃত্যু বেশি হয়েছে নারীদের।

 

চলতি বছরে ১৭ জুলাই পর্যন্ত ২২ হাজার ৪৬৭ জন হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন। এর মধ্যে নারী ৮ হাজার ৩০৩ জন এবং পুরুষ ১৪ হাজার ১৬৪ জন। মৃত্যু হয়েছে ১১৪ জনের। এর মধ্যে নারী ৬৬ জন, পুরুষ ৮৪ জন।

 

সোমবার স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের হেলথ ইমার্জেন্সি অপারেশন সেন্টার ও কন্ট্রোল রুম থেকে বিশ্লেষণে এ তথ্য পাওয়া গেছে।

 

ডেঙ্গু পরিস্থিতি দিনকে দিন অবনতি হচ্ছে। চলতি বছর এ পর্যন্ত ১১৪ জনের মৃত্যু হয়েছে। ডেঙ্গু নিয়ে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছে ২২ হাজারেরও বেশি। ঢাকায় রোগী বেশি থাকলেও দিনকে দিনে ঢাকার বাইরেও রোগী বাড়ছে।

 

হাসপাতালে ভর্তি হওয়া ২২ হাজার ৪৬৭ জনের মধ্যে ১৮ থেকে ৪০ বছর বয়সি ১১ হাজার ২১৩ জন। মৃত্যু হওয়া ১১৪ জনের মধ্যে ৪৭ জনের বয়স ১৮ থেকে ৪০ বছরের মধ্যে। ডেঙ্গু নিয়ে ১৮ বছরের কম বয়সি ৬ হাজার ৭০৭ জন ভর্তি হয়েছে। মৃত্যু হয়েছে ২৪ জনের।

 

স্বাস্থ্য অধিদপ্তর জানায়, ডেঙ্গুতে ৫ বছরের নিচে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছে ১ হাজার ৫১৬ জন। এর মধ্যে মেয়ে ৬৪৯ এবং ছেলে ৮৬৭ জন। ৫ থেকে ১০ বছর বয়সি ১ হাজার ৬১৫ জন। এর মধ্যে মেয়ে ৬৬৩ এবং ছেলে ১ হাজার ৬১৫ জন। ১০ থেকে ১৮ বছর বয়সি ভর্তি হয়েছে ৩ হাজার ৫৭৬ জন। এর মধ্যে মেয়ে ১ হাজার ১৯৪ জন এবং ছেলে ২ হাজার ৩৮২ জন। ১৮ থেকে ৪০ বছর বয়সি ১১ হাজার ২১৩ জন। এর মধ্যে নারী ৩ হাজার ৯৪৪ জন এবং পুরুষ ৭ হাজার ২৬৯ জন। ৪০ থেকে ৬০ বছর বয়সি ৩ হাজার ৫৪৭ জন। এর মধ্যে নারী ১ হাজার ৪৫৩ জন, পুরুষ ২ হাজার ৯৪ জন। ৬০ থেকে ৮০ বছর বয়সি ৯১৯ জন। এর মধ্যে নারী ৩৬৭ জন এবং পুরুষ ৫৫২ জন। আশি বছরের ঊর্ধ্বে ৮১ জন। এর মধ্যে নারী ৩৩ জন এবং পুরুষ ৪৮ জন।

 

মৃৃত্যু হওয়া ১১৪ জনের মধ্যে ৫ বছরের কম বয়সি ৫ জন। এদের তিনজন মেয়ে ও দুইজন ছেলে। ৫ থেকে ১০ বছর বয়সি ৭ জনের মৃত্যু হয়েছে। যাদের একজন মেয়ে এবং ৬ জন ছেলে। ১০ থেকে ১৮ বছর বয়সি ১২ জনের মধ্যে ৭ জন নারী এবং ৫ জন পুরুষ। ১৮ থেকে ৪০ বছর বয়সি ৪৭ জনের মধ্যে ৩২ জন নারী এবং ১৫ জন পুরুষ, ৪০ থেকে ৬০ বছর বয়সি ২৭ জনের মধ্যে ১৫ জন নারী ১২ জন পুরুষ। ৬০ থেকে ৮০ বছর বয়সী ১৪ জনের মধ্যে ৭ জন নারী এবং ৭ জন পুরুষ। আশি ঊর্ধ্ব দুজনের একজন নারী, একজন পুরুষ।

 

২০১৮ সালের তুলনায় চলতি বছরের জুলাই মাসে মৃত্যুর হার অনেক বেশি। ২০১৮ সালের জুলাই মাসে মৃত্যুহার ছিল শূন্য দশমিক ২৬ শতাংশ, ১৯ সালে ছিল শূন্য দশমিক ১৮ শতাংশ, ২০২০ সালে শূন্য দশমিক ৫০ শতাংশ, ২০২১ সালে ছিল শূন্য দশমিক ৩৭ শতাংশ, ২০২২ সালে ছিল শূন্য দশমিক ৪৫ শতাংশ এবং ২৩ সালে শূন্য দশমিক ৫৫ শতাংশ, যা গত ছয় বছরে সর্বোচ্চ।

 

ডেঙ্গু পরিস্থিতির দিনকে দিন অবনতি হচ্ছে। বিশেষ করে ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের মুগদা হাসপাতাল, কদমতলি, জুরাইন, মানিকনগর এবং সবুজবাগ এই এলাকায় রোগীর সংখ্যা খুব বেশি। এখন পর্যন্ত যে পরিস্থিতি তা সামাল দেয়ার মতো প্রস্তুতি সরকারের আছে। কিন্তু সামনের দিনগুলোতে অব্যাহতভাবে রোগী যদি বাড়তে থাকে, তাহলে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যেতে পারে। তাই এ পরিস্থিতি উত্তরণে সকলের সচেতনতার ওপর জোর দিচ্ছে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর।

 

সোমবার সকাল ৮টা পর্যন্ত ঢাকার বিভিন্ন হাসপাতালে ৫ হাজার ৪৪১ জন ডেঙ্গু রোগী ভর্তি ছিল। এর বাইরে আক্রান্ত কত রোগী বাসায় বসে ট্রিটমেন্ট নিচ্ছে নির্দিষ্ট করে সে তথ্য নেই। তবে বাসায় থাকা রোগীদের কয়েকটি পরামর্শ দিয়েছে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর। জ্বরের সঙ্গে কয়েকটি বিপদচিহ্ন দেখা দিলে দ্রুত হাসপাতালে যাওয়ার পরামর্শ দেয়া হয়েছে। একই সঙ্গে যেকোনো ধরনের তথ্য জানতে ও চিকিৎসা পরামর্শ নিতে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের হট লাইন ১৬২৬৩ নম্বরে কল করার আহ্বান জানানো হয়েছে।

 

সোমবার দুপুরে ডেঙ্গু পরিস্থিতি নিয়ে ভার্চুয়াল ব্রিফিংয়ে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের অতিরিক্ত মহাপরিচালক (প্রশাসন) ডা. রাশেদা সুলতানা বলেন, দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের মুগদা হাসপাতাল, কদমতলি, জুরাইন, মানিকনগর এবং সবুজবাগ এই এলাকায় রোগীর সংখ্যা বেশি। উত্তর সিটি করপোরেশের মোহাম্মদপুর, মিরপুর, তেজগাঁও, বাড্ডা এগুলোতে তুলনামূলক কম। আমাদের হাসপাতালগুলো প্রস্তুত আছে। ঢাকা মেডিকেল, সোহরাওয়ার্দী, মিটফোর্ড হাসপাতালসহ সব সরকারি-বেসরকারি হাসপাতাল প্রস্তুত আছে। সরকারি হাসপাতালগুলোতে আমরা ডেডিকেটেড বেডগুলো রেডি রেখেছি। ডেঙ্গু কিটও সব হাসপাতালে চাহিদামতো আছে। নির্ধারিত মশারি দ্বারা রোগী সুরক্ষিত রাখার প্রস্তুতি আছে। আমাদের একটাই উদ্দেশ্য, সচেতনতা বাড়ুক। মশার কামড় থেকে নিজেকে কীভাবে রক্ষা করতে পারি। আমরা জানি যে মশা যদি কামড়াতে না পারে তাহলে কিন্তু ডেঙ্গু রোগ হয় না।

 

যেসব বিপদ চিহ্ন দেখলে আমরা হাসপাতালে যাব : জ্বরের সঙ্গে প্রচণ্ড পেটে ব্যথা, অত্যধিক পানির পিপাসা যদি থাকে, তাহলে অবশ্যই ডাক্তারের পরামর্শ নিতে হবে। এছাড়া ঘনঘন বমি কিংবা রক্তবমি হওয়া, মাড়ি বা নাক থেকে রক্তপাত হওয়া, ছয় ঘণ্টায় প্রস্রাব না হওয়া, ডায়রিয়া হলে কিংবা শারীরিক দুর্বলতা, গর্ভবতী মা এবং নবজাতক শিশুর শরীরের তাপমাত্রা অস্বাভাবিকভাবে কমে গেলে অতিদ্রুত ডাক্তারের কাছে যাওয়ার প্রয়োজন।

 

তিনি বলেন, ডাক্তার তখন রোগীর অবস্থা বুঝে পরামর্শ দেবেন। ভর্তি করা লাগলে ভর্তি করবেন। যদি মনে করেন ভর্তি করা প্রয়োজন নয়, তাকে বাসায় থাকার পরামর্শ দেবেন। আক্রান্ত রোগীর বিপদ চিহ্নগুলো না থাকলে তাকে বাড়িতে যেসব পরামর্শ দেব তা হলোÑ পর্যাপ্ত তরল খাবার খাবেন। ছয় ঘণ্টায় প্রস্রাব হচ্ছে কিনা সেটাও খেয়াল রাখতে হবে। সম্পূর্ণ বিশ্রামে থাকবেন। স্বাভাবিক খাবারের সঙ্গে পর্যাপ্ত লবণযুক্ত খাবার যেমন- খাবার স্যালাইন, ডাবের পানি, ফলের রস ও স্যুপ ইত্যাদি বেশি খেতে হবে। প্যারাসিটামল ছাড়া অন্য কোনো ওষুধ আমরা অ্যাডভাইস করি না। জ¦র কমাতে কুসুম গরম পানি দিয়ে সারা শরীর মুছে রাখতে হবে।

 

তিনি বলেন, সঠিক সময়ে ডাক্তারের কাছে পৌঁছালে এবং সময়মতো যদি তার প্রোপার ট্রিটমেন্ট চালু হয়, ইনশাল্লাহ ডেঙ্গুতে কোনো ক্যাজুয়ালিটি হবে না। ইনশাল্লাহ আমরা প্রত্যেক রোগীকে সেভ করতে পারব।

 

স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের পরিচালক (এমআইএস) অধ্যাপক ডা. শাহাদাত হোসেন বলেন, আমাদের একটা হটলাইট নম্বর আছে ১৬২৬৩। এই নম্বরে যে কেউই পরামর্শ নিতে পারেন। এই সার্ভিসটি ২৪ ঘণ্টাই চালু থাকে। এখান থেকে পরামর্শ নেয়ার সঙ্গে সঙ্গে কিন্তু আপনার মোবাইলে মেসেজ চলে যায়। করোনার সময় এক দিনে ৬৫ হাজার মানুষ ১৬২৬৩ নম্বরে কল করে সেবা নিয়েছিল। ডেঙ্গুর ক্ষেত্রে যদি এই সচেতনতা সৃষ্টি হয়ে, সেক্ষেত্রে মানুষ কিন্তু এখান থেকে পরামর্শ নিতে পারবেন। যারা এই সার্ভিস দেন তাদের প্রশিক্ষণ দেয়া হয়েছে। এই নম্বরে কল করার পর তার মোবাইলে কিন্ত মেসেজ চলে যায়।

 

এদিকে দুপুরে মুগদা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল পরিদর্শনে যান স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের স্বাস্থ্যসেবা বিভাগের সচিব ড. মুহাম্মদ আনোয়ার হোসেন হাওলাদার এবং স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালক অধ্যাপক ডা. এবিএম খুরশীদ আলম।

 

ঢাকার বড় ৮ হাসপাতালে ২১৭১ শয্যা : ঢাকার বড় আটটি হাসপাতালে ডেঙ্গু রোগীদের চিকিৎসায় ডেডিকেটেড ২ হাজার ১৭১টি শয্যা রয়েছে বলে জানান স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের অতিরিক্ত মহাপরিচালক (প্রশাসন) ডা. রাশেদা সুলতানা। তিনি বলেন, সব হাসপাতালে আমাদের ডেঙ্গু কর্নার আছে। ডেঙ্গুর ইনফরমেশন ডেক্স আছে। ডেঙ্গু ট্রিটমেন্টের জন্য আলাদা টিমও আছে। তারা ট্রিটমেন্ট দিচ্ছে। বেড কিন্তু সব হাসপাতালে আছে। ডিএনসিসিতে ৮০০ বেড, মুগদায় ৬০০, ঢাকা মেডিকেলে ১২০, স্যার সলিমুল্লাহ মেডিকেলে ১৯৫, শিশু হাসপাতালে ৪৪, সোহরাওয়র্দীতে ১২০, কুর্মিটোলায় ২২০ ও কুয়েত মৈত্রী হাসপাতালে ডেঙ্গু রোগীদের জন্য ৭২ শয্যা রয়েছে।

 

ডেঙ্গুতে মৃত্যু ৮ জনের, নতুন করে হাসপাতলে ১৫৮৯ জন

 

রোববার সকাল ৮টা থেকে সোমবার সকাল ৮টা পর্যন্ত ডেঙ্গু নিয়ে ১ হাজার ৫৮৯ জন হাসপাতালে ভর্তি হয়েছে। এই সময়ে মৃত্যু হয়েছে ৮ জনের। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের হেলথ ইমার্জেন্সি অপারেশন সেন্টার ও কন্ট্রোল রুম থেকে এ তথ্য জানানো হয়েছে। কন্ট্রোল রুম জানায়, নতুন ভর্তিদের মধ্যে ৮৪৭ জন ঢাকায় এবং ঢাকার বাইরে ৭৪২ জন।

 

বর্তমানে দেশের সরকারি ও বেসরকারি হাসপাতালে চিকিৎসাধীন রয়েছেন ৫ হাজার ৪৪১ জন। এর মধ্যে ঢাকায় ৩ হাজার ৩৪৭ জন এবং ঢাকার বাইরে ২ হাজার ৯৪ জন।

 

ডেঙ্গু নিয়ে চলতি বছর সারা দেশের হাসপাতালে ভর্তি হয়েছে ২২ হাজার ৪৬৭ জন। এর মধ্যে ঢাকায় ১৪ হাজার ৬৯৭ জন এবং ঢাকার বাইরে ৭ হাজার ৭৭০ জন।

 

এ পর্যন্ত হাসপাতাল থেকে ছাড়পত্র পেয়েছে ১৬ হাজার ৯১২ জন। এর মধ্যে ঢাকায় ১১ হাজার ২৬৩ জন এবং ঢাকার বাইরে ৫ হাজার ৬৪৯ জন।

 

ডেঙ্গুতে চলতি বছরের এ পর্যন্ত প্রাণ গেছে ১১৪ জনের। এর মধ্যে চলতি মাসেই মৃত্যু হয়েছে ৬৭ জনের। জুনে মৃত্যু হয়েছে ৩৪ জনের। বাকি কয়েকজন তার আগের মাসগুলোতে মারা গেছেন।

 

ভোরের আকাশ/আসা

মন্তব্য

Beta version