নিখিল মানখিন: গত কয়েক বছর ধরে ডেঙ্গুর সংক্রমণ শক্তিশালী হয়ে উঠছে। কিন্তু সেদিকে গুরুত্ব না দেয়ার কারণেই চলতি বছর দেশের ডেঙ্গু পরিস্থিতি প্রকট হয়ে পড়েছে বলে মনে করছেন জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা।
তারা বলছেন, বাংলাদেশে ডেঙ্গুর পিক সিজন সাধারণত আগস্ট থেকে অক্টোবর পর্যন্ত সময়কে ধরা হয়। এ বছর জানুয়ারি থেকে জুলাই পর্যন্ত সাত মাসেই সংক্রমণ ও মৃত্যুহারের বিবেচনায় বিগত ২২ বছরের রেকর্ড ছাড়িয়ে গেছে। গত কয়েক বছর ধরে সারাবছরই রেকর্ড সংখ্যক ডেঙ্গু রোগী এবং মৃত্যুর ঘটনা ঘটছে।
ডেঙ্গু জ্বরে আক্রান্ত হয়ে গত ২৪ ঘণ্টায় মারা গেছেন ১২ জন এবং হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন ২ হাজার ৮৪৪ জন। চলতি বছরে ৯ আগস্ট পর্যন্ত ডেঙ্গুতে মোট মৃতের সংখ্যা ৩৫২।
বুধবার দুপুরে ডেঙ্গু পরিস্থিতি নিয়ে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের হেলথ ইমাজেন্সি অপারেশন সেন্টার ও কন্ট্রোল রুমের ইনচার্জ ডা. মোহাম্মদ জাহিদুল ইসলাম স্বাক্ষরিত দৈনিক প্রতিবেদনে এ তথ্য জানানো হয়েছে।
প্রতিবেদনে বলা হয়, গত ২৪ ঘণ্টায় ঢাকা শহরে ডেঙ্গুতে মোট আক্রান্ত হয়েছেন ১ হাজার ৯২ জন এবং ঢাকার বাইরে ১ হাজার ৭৫২ জন। এ সময়ে মারা যাওয়া ১২ জনের মধ্যে সাতজন ঢাকা সিটির এবং সিটির বাইরের পাঁচজন। বর্তমানে মোট চিকিৎসাধীন ৯ হাজার ৪২৭ জনের মধ্যে ঢাকায় ভর্তি রোগী রয়েছে ৪ হাজার ৪২১ এবং ঢাকার বাইরে ৫ হাজার ৬ জন। চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে এ পর্যন্ত ৭৫ হাজার ৬৯ জন আক্রান্ত হয়েছেন। তাদের মধ্যে ৬৫ হাজার ১২৯০ জন হাসপাতাল থেকে ছুটি নিয়ে গেছেন।
জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ভয়ংকর হয়ে উঠেছে দেশের ডেঙ্গু পরিস্থিতি। এক সময়ে বাংলাদেশে ডেঙ্গু রোগটি মৌসুমি রোগ বলে মনে করা হলেও, গত কয়েক বছর ধরে সারা বছরজুড়ে প্রকোপ দেখা যাচ্ছে। এর ফলে এই রোগের চার ধরনের ভাইরাস আরো শক্তিশালী হয়ে উঠেছে এবং রোগটি দেশের সব জেলায় ছড়িয়ে পড়েছে। এ বছর দেশের ডেঙ্গু পরিস্থিতিতে বেশ কিছু নতুন বৈশিষ্ট্য লক্ষ্য করা যাচ্ছে।
গত কয়েক বছরের তুলনায় এবার ডেঙ্গু রোগীদের অবস্থার খুব তাড়াতাড়ি অবনতি হচ্ছে। আক্রান্ত হওয়ার স্বল্প সময়ের মধ্যে মৃত্যুর ঘটনাও ঘটছে। আর মৃত্যুহার খুবই আশঙ্কাজনক। এ পর্যন্ত ২১ থেকে ২৫ বছর বয়সিদের মধ্যে আক্রান্ত ও মৃত্যুহার বেশি। ডেঙ্গু রোগটি নিয়ে বড় ধরনের গবেষণা, নজরদারি নেই। এখন পর্যন্ত শুধু হাসপাতালে ভর্তি রোগীদের তথ্য স্বাস্থ্য কর্মকর্তাদের কাছে আসছে।
কিন্তু এর বাইরেও যে বিপুল মানুষ আক্রান্ত হচ্ছেন, ঘরে বসে চিকিৎসা নিচ্ছেন, তাদের তথ্য কোথাও নেই। মশা দমনেও দেশজুড়ে বড় ধরনের কোনো পদক্ষেপ নেয়া হচ্ছে না। এমনকি এখন মশা দমনে যেসব ওষুধ ব্যবহার করা হচ্ছে, সেগুলোর কার্যকারিতা আছে কিনা, তাও কারো জানা নেই।
এ বিষয়ে সরকারের রোগতত্ত্ব , রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (আইইডিসিআর) উপদেষ্টা ডা. মুশতাক হোসেন ভোরের আকাশকে বলেন, বাংলাদেশে ডেঙ্গুর পিক সিজন সাধারণত আগস্ট থেকে অক্টোবর পর্যন্ত সময়কে ধরা হয়। এ বছর জানুয়ারি থেকে জুলাই পর্যন্ত সাত মাসেই সংক্রমণ ও মৃত্যুহারের বিবেচনায় বিগত ২২ বছরের রেকর্ড ছাড়িয়ে গেছে। গত কয়েক বছর ধরে সারা বছরই রেকর্ড সংখ্যক ডেঙ্গু রোগী এবং মৃত্যুর ঘটনা ঘটছে।
গত কয়েক বছর ধরে ডেঙ্গুর এ রকম সংক্রমণ চলার পরেও সেটা ঠেকাতে বা নিয়ন্ত্রণ করতে কার্যকর কোনো ব্যবস্থা কেন নেয়া হয়নি?
এমন প্রশ্নের জবাবে ড. মুশতাক হোসেন বলছেন, ‘ ডঙ্গু মোকািেবলায় যে ধরনের ব্যবস্থা নেয়া হচ্ছে, সেটা অনেকটা গতানুগতিক ব্যবস্থা নেয়া হচ্ছে। সেই সঙ্গে এডিস মশার ঘনত্ব বেড়ে গেছে। শহরে-গ্রামে পলিথিন, প্লাস্টিকের বোতলের ব্যবহার বেড়ে যাওয়ায় পানি জমে যাওয়া, নগরায়ণের ফলে পানি আটকে থাকার কারণে ডেঙ্গু মশা বেড়েছে, ফলে রোগীও বেড়ে গেছে।
তিনি বলেন, আক্রান্তদের মধ্যে ডেঙ্গুর চারটি ধরন বা সেরোটাইপ পাওয়া যাচ্ছে। যারা এখন আক্রান্ত হচ্ছে, তাদের মধ্যে দ্বিতীয়বার আক্রান্ত হওয়ার সংখ্যাই বেশি। ২০০০ সালের আগে আগে আমরা দেখেছি, মানুষজন ডেঙ্গুর একটা ধরনে আক্রান্ত হতো। ফলে তাদের মধ্যে একটা প্রতিরোধ ক্ষমতা গড়ে উঠত। কিন্তু যখন মানুষ চারটা ধরনেই আক্রান্ত হতে শুরু করে, তখন প্রতিরোধ ক্ষমতা তেমন কাজ করে না। তখন সংক্রমিত হওয়ার ঝুঁকি তিনগুণ বেড়ে যায়।
বুধবার স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের পরিচালক (এমআইএস) অধ্যাপক মো. শাহাদাত হোসেন বলেন, আগস্টে ডেঙ্গু আক্রান্তের হার বেশি হতে পারে। ঢাকা সিটিতে ডেঙ্গু সংক্রমণ স্থিতিশীল থাকলেও ঢাকার বাইরে আক্রান্তের হার এখনো বাড়ছে। আগস্টের গত ৮ দিনেই ২০ হাজার ৩৯৩ জনের ডেঙ্গু শনাক্ত হয়েছে, যেখানে গত জুলাই মাসে ছিল ৪৩ হাজার ৮৫৪ জন।
তিনি বলেন, ডেঙ্গু আক্রান্তের যে পরিস্থিতি, যেহেতু ঢাকার বাইরে রোগী বাড়ছে সেহেতু আগস্ট মাসে এ হারে যদি সংক্রমণ বাড়ে এবং যদি স্থিতিশীলতা না আসে, তাহলে এ আগস্ট মাসে ডেঙ্গুতে আক্রান্তের হার অন্যান্য সময়ের তুলনায় সবচেয়ে বেশি হতে পারে।
শাহাদাত হোসেন বলেন, আমাদের স্বাস্থ্য ব্যবস্থাপনার যে ব্যাপারগুলো রয়েছে, হাসপাতালে ভর্তি রোগীর চিকিৎসা ও অন্যান্য ব্যবস্থাপনা, রোগীরা যেন হাসপাতালে এসে চিকিৎসা নিতে পারে, সেই ব্যবস্থাটি স্বাস্থ্য অধিদপ্তর এবং স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় থেকে সক্রিয়ভাবে মনিটরিং করা হচ্ছে। আমরা এ ব্যাপারে যথেষ্ট সতর্ক আছি।
রেকর্ডের পর রেকর্ড: বাংলাদেশে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, চলতি বছর ৯ আগস্ট পর্যন্ত ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়েছেন ৭৫ হাজার ৬৯ জন মানুষ। এ সময়ে মারা গেছেন ৩৫২ জন।২০২২ সালে দেশে মোট ৬২,০৯৮ জন মানুষ ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়েছিলেন, মারা গিয়েছিলেন ২৮১ জন। ২০০০ সাল থেকে ডেঙ্গুতে মৃত্যুর বার্ষিক হারের হিসাবে সেটাই ছিল সর্বোচ্চ।
বাংলাদেশে ২০২১ থেকে ২০২৩ সালে আটটি বিভাগের ডেঙ্গু আক্রান্ত ও মৃত্যুর পরিসংখ্যান থেকে দেখা গেছে, ঢাকা, চট্টগ্রাম এবং বরিশালে সংক্রমণের হার সবচেয়ে বেশি।২১ থেকে ২৫ বছর বয়সি রোগী ও মৃত্যুহার বেশি। চলতি বছর ৯ আগস্ট পর্যন্ত এই বয়সি রোগীদের আক্রান্ত হওয়ার হার ১৬ এবং মৃত্যুর হার ১০, যা এখন পর্যন্ত সর্বোচ্চ।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তর জানায়, ২০২৩ সালে ডেঙ্গুতে আক্রান্ত ও মৃতের সংখ্যা যথাক্রমে জানুয়ারিতে ৫৬৬ জন ও ৬ জন, ফেব্রুয়ারিতে ১৬৬ জন ও ৩ জন, মার্চে আক্রান্ত ১১১ জন, এপ্রিলে ১৪৩ জন ও ২ জন, জুনে ৫ হাজার ৯৫৬ জন ও ৩৪ জন, জুলাইয়ে ৪৩ হাজার ৮৫৪ জন ও ২০৪ জন। আর আগস্টের ৯ দিনে আক্রান্ত হয়েছেন ২৩ হাজার ২৩৭ জন এবং মারা গেছেন ১০১ জন।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তর আরো জানায়, ২০২২ সালের জানুয়ারিতে ১২৬, ফেব্রুয়ারিতে ২০ জন, মার্চে ২০ জন, এপ্রিলে ২৩ জন, মে মাসে ১৬৩ জন, জুনে ৭৩৭ জন, জুলাইয়ে ১ হাজার ৫৭১ জন, আগস্টে ৩ হাজার ৫৩১ জন, সেপ্টেম্বরে ৯ হাজার ৯১১ জন, অক্টোবরে ২১ হাজার ৯৩২ জন, নভেম্বরে ১৯ হাজার ৩৩৪ জন এবং ডিসেম্বরে ৫ হাজার ২৪ জন ডেঙ্গু জ্বরে আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন।
ওই বছরে দেশে ডেঙ্গুতে মোট ২৮১ জনের মৃত্যু হয়েছে। তাদের মধ্যে জুনে ১ জন, জুলাইয়ে ৯ জন, আগস্টে ১১ জন, সেপ্টেম্বরে ৩৪ জন, অক্টোবরে ৮৬ জন, নভেম্বরে ১১৩ জন এবং ডিসেম্বরে ২৭ জন মারা গেছেন বলে জানিয়েছে অধিদপ্তর। তবে বেসরকারি পরিসংখ্যানে প্রকৃত ডেঙ্গু আক্রান্তের সংখ্যা আরো বেশি হবে বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা। ঐক্যবদ্ধ প্রচেষ্টায় ডেঙ্গুর প্রজনন ধ্বংস সম্ভব বলে জানিয়েছেন স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায়মন্ত্রী তাজুল ইসলাম।
তিনি বলেন, জনপ্রতিনিধিরা যে পর্যায়েই কাজ করুন না কেন, জনগণের জীবন ও সম্পদ রক্ষার্থে তাদের ভূমিকা অপরিসীম। জলবায়ু পরিবর্তন ও বৈশ্বিক উষ্ণতা বৃদ্ধির কারণে ডেঙ্গুর মতো রোগের সংক্রমণ প্রতিরোধেও আমাদেরকে সেরকম সতর্ক ও সচেতন হতে হবে।
এডিস মশার লার্ভা পাওয়া গেলে বা লার্ভা জন্মানোর মতন পরিবেশ আছে এ রকম বাসাবাড়ি থেকে শুরু করে বিভিন্ন অফিস-আদালতকে বড় অঙ্কের জরিমানা করার ওপর গুরুত্ব দিতে হবে। নানাভাবে সতর্ক করার পরও মানুষের জীবনকে হুমকির মুখে ফেলার মতো অসচেতনতাকে ক্ষমা করার সুযোগ নেই। এডিস মশার প্রজনন ক্ষেত্র ধ্বংস না করে ডেঙ্গুর সংক্রমণ হ্রাস করার সহজ কোনো উপায় নেই। কারণ মশা যে কাউকেই কামড়াতে পারে।
ভোরের আকাশ/নি
মন্তব্য