নিখিল মানখিন: অনেক আগেই দেশের সব ক’টি জেলায় বিস্তার লাভ করেছে ডেঙ্গুর সংক্রমণ। বাইরের এলাকাগুলোয় দৈনিক শনাক্ত ডেঙ্গু রোগীর সংখ্যা ঢাকা সিটিকে ছাড়িয়ে গেছে। মোট সংখ্যা বিবেচনায়ও ঢাকা সিটির রোগী সংখ্যাকে প্রায় ছুঁয়ে ফেলেছে।
জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ডেঙ্গুর চলমান ভয়ানক পরিস্থিতি সেপ্টেম্বর পর্যন্ত অব্যাহত থাকতে পারে। তারপর পরিস্থিতির কিছুটা উন্নতি ঘটতে পারে। তবে গত বছর ডিসেম্বরেও উল্লেখযোগ্য ডেঙ্গু রোগী এবং মৃত্যুর ঘটনা ঘটেছে। চলতি বছর এ পর্যন্ত মার্চ ছাড়া প্রত্যেক মাসেই নতুন নতুন রোগী শনাক্ত এবং মৃত্যুর ঘটনা রয়েছে। এ অবস্থায় ঢাকা সিটির বাইরে ডেঙ্গু রোগীর সংখ্যা অব্যাহত বৃদ্ধি দেশের ডেঙ্গু পরিস্থিতিকে আরো জটিল ও দীর্ঘায়িত করে তুলতে পারে। কারণ ঢাকার বাইরে মশকনিধন কার্যক্রম সফল করা সম্ভব হবে না।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের পরিসংখ্যান অনুযায়ী, জুলাই থেকে বাইরের এলাকাগুলোয় দৈনিক শনাক্ত ডেঙ্গু রোগীর সংখ্যা ঢাকা সিটিকে ছাড়িয়ে যায়। চলতি বছর ২ জুলাই দৈনিক শনাক্ত ডেঙ্গু রোগীর সংখ্যা ছিল ঢাকা সিটিতে ২২৪ ও সিটির বাইরে ২৮৫। দৈনিক শনাক্ত ডেঙ্গু রোগীর সংখ্যা গত ৩১ জুলাই ঢাকা সিটি ও সিটির বাইরে ছিল যথাক্রমে ১ হাজার ১৬৮ ও ১ হাজার ৫২৬ জন।
এভাবে গত ১১ আগস্ট এ তুলনামূলক পরিসংখ্যান ছিল যথাক্রমে ৮৫৩ ও ১ হাজার ১৯৩ জন। এভাবে মোট ডেঙ্গুর রোগীর বিবেচনায়ও বাইরের এলাকাগুলোয় ঢাকা সিটিকে প্রায় ধরে ফেলেছে। গত ১১ আগস্ট পর্যন্ত মোট শনাক্ত ৮০ হাজার ৭৪ ডেঙ্গু রোগীর মধ্যে ঢাকা সিটিতে ছিল ৪০ হাজার ৭৬৪ ও সিটির বাইরে ৩৯ হাজার ৩১০ জন।
কীটতত্ত্ববিদ ও জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ব বিদ্যালয়ের প্রাণিবিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক ড. কবিরুল বাশার ভোরের আকাশকে বলেন, প্রতিদিনই বাড়ছে ডেঙ্গু রোগী এবং মৃত্যুর সংখ্যা। দুর্ভাগ্যজনকভাবে বাংলাদেশের সব ইতিহাস ভেঙে ২০২৩ সাল ডেঙ্গুতে মৃত্যুর রেকর্ড হলো। এমন রেকর্ড আমরা চাই না।
তিনি বলেন, ডেঙ্গু একসময় শুধু ঢাকার রোগ ছিল, কিন্তু বর্তমানে বাংলাদেশের প্রতিটি জেলায় ডেঙ্গু বিস্তৃত হয়েছে। ধীরে ধীরে ঢাকার বাইরে ডেঙ্গু রোগীর সংখ্যা বাড়ছে। ডায়াগনস্টিক সেন্টারে ডেঙ্গু টেস্ট করার দীর্ঘ লাইন বলে দিচ্ছে ডেঙ্গুর ভয়াবহতা। তিনি বলেন, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে আমাদের ল্যাবে আমরা একটি ফোরকাস্টিং মডেল তৈরি করি যার মাধ্যমে আর্লি ওয়ার্নিং দেয়া যায়।
কয়েক বছরে যতগুলো ফোরকাস্টিং আমরা করেছি, তার প্রতিটি সঠিক হয়েছে। তাপমাত্রা, আর্দ্রতা, বৃষ্টিপাত, এডিস মশার ঘনত্ব এবং ডেঙ্গু রোগীর সংখ্যা এ কয়েকটি প্যারামিটারকে মাল্টিভেরিয়েট অ্যানালাইসিস করে কম্পিউটার সিমুলেশনের মাধ্যমে ফোরকাস্টিং মডেল তৈরি করা হয়।
ড. কবিরুল বাশার বলেন, বর্তমান মডেলে আমরা যেটি দেখতে পাচ্ছি, তাতে আগস্ট-সেপ্টেম্বরজুড়েই ডেঙ্গুর প্রকোপ থাকবে। ঢাকার পাশাপাশি ঢাকার বাইরে ডেঙ্গু রোগীর সংখ্যা বাড়বে। ডেঙ্গুর বাহক এডিস মশাকে নিয়ন্ত্রিত পর্যায়ে না রাখতে পারলে পরিস্থিতি আরো খারাপ হবে। আগামী দুটি মাস যেহেতু ডেঙ্গুঝুঁকি বেশি তাই এডিস মশা নিধন ও হাসপাতাল ব্যবস্থাপনায় কার্যক্রমগুলো আরো বেগবান করা প্রয়োজন।
এ মুহূর্তে এডিস মশা নিয়ন্ত্রণ কার্যক্রম গতানুগতিক পদ্ধতিতে করলে হবে না। হটস্পট ধরে ধরে উড়ন্ত মশা নিধন কার্যক্রম বাড়াতে হবে। সব জায়গায় প্রজননস্থল ধ্বংস (সোর্স রিডাকশন) করতে হবে। মশার লার্ভা ধ্বংসে নতুন প্রজন্মের বায়ো লার্ভিসাইড বিটিআইর প্রয়োগ করতে হবে। এ কাজে স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ের অঙ্গ প্রতিষ্ঠান বিশেষ করে সিটি করপোরেশনের পাশাপাশি জনগণ ও সামাজিক সংগঠনকেও সম্পৃক্ত হতে হবে।
ডেঙ্গু বিশেষজ্ঞ, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ব বিদ্যালয়ের মেডিসিন অনুষদের সাবেক ডিন এবং প্রধানমন্ত্রীর বর্তমান ব্যক্তিগত চিকিৎসক অধ্যাপক ডা. এবিএম আব্দুল্লাহ ভোরের আকাশকে বলেন, দেশের ডেঙ্গু পরিস্থিতির অবনতি অব্যাহত রয়েছে। গত কয়েক বছর ধরে সারা বছরই ডেঙ্গু রোগী শনাক্ত এবং মৃত্যুর ঘটনা ঘটছে। চলতি বছরে জানুয়ারিতেই পাঁচ শতাধিক ডেঙ্গু রোগী হাসপাতালে ভর্তি হন এবং মৃত্যু ঘটে ছয়জনের।
এ পর্যন্ত মার্চ মাস ছাড়া প্রত্যেক মাসেই নতুন নতুন রোগী শনাক্ত এবং মৃত্যুর ঘটনা রয়েছে। তিনি বলেন, সারা দেশে ডেঙ্গুর বিস্তার আরো নতুন জটিলতা সৃষ্টি করতে পারে। বর্তমানে ঢাকা সিটির বাইরে বেশিসংখ্যক ডেঙ্গু রোগী শনাক্ত হচ্ছে। সিটির মধ্যে মশকনিধন কার্যক্রম চালানোর একটা সুনির্দিষ্ট কাঠামো থাকে। কিন্তু গ্রামাঞ্চলে খোলামেলা জায়গাগুলোয় তা সম্ভব নয়। ফলে ঢাকা সিটির বাইরে ডেঙ্গু রোগীর সংখ্যা অব্যাহত বৃদ্ধি দেশের ডেঙ্গু পরিস্থিতিকে আরো জটিল ও দীর্ঘায়িত করে তুলতে পারে।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের পরিচালক (এমআইএস) অধ্যাপক মো. শাহাদাত হোসেন ভোরের আকাশকে বলেন, ‘আগস্টে ডেঙ্গু আক্রান্তের হার বেশি হতে পারে। ঢাকা সিটিতে ডেঙ্গু সংক্রমণ স্থিতিশীল থাকলেও ঢাকার বাইরে আক্রান্তের হার এখনো বাড়ছে। তিনি বলেন, ডেঙ্গু আক্রান্তের যে পরিস্থিতিÑ যেহেতু ঢাকার বাইরে রোগী বাড়ছে, সেহেতু আগস্ট মাসে এ হারে যদি সংক্রমণ বাড়ে এবং যদি স্থিতিশীলতা না আসে, তাহলে এ আগস্ট মাসে ডেঙ্গু আক্রান্তের হার অন্য সময়ের তুলনায় সবচেয়ে বেশি হতে পারে।’
শনিবার স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালেক মানিকগঞ্জ ২৫০ শয্যা জেনারেল হাসপাতালে ডেঙ্গু ইউনিট পরিদর্শন শেষে সাংবাদিকদের বলেন, ‘এখনো ডেঙ্গু বাড়তি রয়েছে, এখন পর্যন্ত সারা দেশে ৮০ হাজার ডেঙ্গু রোগী পেয়েছি। গত বছর কম ছিল, এর আগে একটু বেশি ছিল। এ বছর ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুবরণ করেছেন ৩৭৩ জন। এটা আমি মনে করি, অনেক বেশি। ডেঙ্গু রোগী বেড়েছে দশগুণ।’
ভোরের আকাশ/নি
মন্তব্য