-->
শিরোনাম

সেপ্টেম্বরেও থাকবে ডেঙ্গুর দাপট

নিখিল মানখিন
সেপ্টেম্বরেও থাকবে ডেঙ্গুর দাপট

নিখিল মানখিন: সেপ্টেম্বরেও থাকবে ডেঙ্গুর দাপট। গত দুই মাসের ডেঙ্গু পরিস্থিতি বিগত সময়ের সব পরিসংখ্যান পেছনে ফেলে নতুন রেকর্ড গড়েছে বলে জানিয়েছেন জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা। স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় ও স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের পরিসংখ্যানেও একই চিত্র বেরিয়ে এসেছে।

 

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, চলতি বছর জানুয়ারি থেকেই ডেঙ্গু জ্বরে আক্রান্ত ও মৃত্যুর ঘটনা শুরু হলেও বড় ধরনের আঘাত এসেছে জুলাই ও আগস্টে, যা এখনো অব্যাহত রয়েছে। মৃত্যুহার বেশি হওয়ায় ডেঙ্গু রোগীদের মধ্যে বেড়েছে আতঙ্ক। ডেঙ্গু রোগী সামাল দিতে হিমর্শিম খাচ্ছে সরকারি হাসপাতাল। আর বেসরকারি হাসপাতালের উচ্চ চিকিৎসা ব্যয় মেটাতে অসহায় রোগী ও তাদের স্বজনরা।

 

বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকরা বলছেন, ডেঙ্গু রোগীদের অধিকাংশই মৃত্যু আতঙ্কে থাকেন। উপসর্গহীন ডেঙ্গুরোগীও পাওয়া যাচ্ছে। হঠাৎ করে প্লাটিলেট নেমে গেলেই কান্নাকাটি শুরু করে দিচ্ছেন রোগীর স্বজনরা। চিকিৎসকদের বোঝানোর পরও নিরাপদ মনে করছেন না অনেকে। সরকারি হাসপাতালে সিট না পেয়ে আতঙ্কে বেসরকারি হাসপাতালে ছুটছেন অনেক রোগী। তাদের অনেকে অসাধু চক্রের খপ্পরে হয়ে পড়ছেন নিঃস্ব। অপ্রয়োজনীয় আইসিইউতে রেখে টাকা হাতিয়ে নেয়ার অভিযোগও উঠছে। জীবন বাঁচানোর আশায় সব মেনে নিচ্ছেন রোগীর স্বজনরা।

 

স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের পরিস্থিতির পরিসংখ্যানে দেখা গেছে, চলতি বছরের পহেলা জানুয়ারি থেকে ৩১ আগস্ট পর্যন্ত দেশে ডেঙ্গু জ্বরে আক্রান্ত হয়ে দিনে গড়ে প্রায় দু’জনের মৃত্যু হয়েছে। আর দেশের বিভিন্ন হাসপাতালে দৈনিক ভর্তি হয়েছেন গড়ে ৫১৬ জন।

 

কিন্তু গত দুই মাস জুলাই ও আগস্টের চিত্র খুবই ভয়াবহ। গত জুলাই মাসে দৈনিক গড়ে ১৪৫২ জন ডেঙ্গু রোগী হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন এবং দৈনিক মারা গেছেন গড়ে ৭ জন। এভাবে আগস্ট মাসে ডেঙ্গু জ্বরে আক্রান্ত হয়ে দৈনিক হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন ২৩৯৯ জন এবং মারা গেছেন দৈনিক গড়ে ১১ জন।

 

স্বাস্থ্য অধিদপ্তর জানায়, ২১ থেকে ২৫ বছর বয়সিদের ডেঙ্গু জ¦রে আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হওয়ার হার বেশি। এই হার ১৬ শতাংশ। ১৩ শতাংশ নিয়ে দ্বিতীয় স্থানে রয়েছে ১৬ থেকে ২০ বছর বয়সি এবং ২৬ থেকে ৩০ বছর বয়সিরা। তৃতীয় স্থানে রয়েছে ৩১ থেকে ৩৫ বছর বয়সিরা। তাদের আক্রান্তের হার ৯ শতাংশ। ৬৬ থেকে ৭৫ বছর বয়সিরা সর্বনিম্ন হারে ডেঙ্গু জ্বরে আক্রান্ত হচ্ছেন। তাদের আক্রান্তের হার ১ শতাংশ।

 

ডেঙ্গু জ্বরে আক্রান্ত হয়ে বয়সর্ভিত্তিক মৃত্যুসংখ্যার বিবেচনায় এগিয়ে রয়েছে ৩১ থেকে ৪০ বছর বয়সিরা। তাদের আক্রান্তের হার ১০ শতাংশ। ৯ শতাংশ নিয়ে দ্বিতীয় স্থানে রয়েছে ২১ থেকে ২৫ বছর বয়সিরা। আর ৮ শতাংশ নিয়ে যৌথভাবে তৃতীয় স্থানে রয়েছে ২৬ থেকে ৩০ বছর এবং ৪১ থেকে ৪৫ বছর বয়সিরা। সর্বনি¤œ হারে মৃত্যুর শিকার হচ্ছেন ৭৬ থেকে ৮০ বছর বয়সিরা। তাদের মৃত্যুর হার ২ শতাংশ।

 

ডেঙ্গু রোগীর চিকিৎসাসেবা নিয়ে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের পরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মো. নাজমুল হক সাংবাদিকদের বলেন, ডেঙ্গুতে মৃত্যুবরণ করা রোগীরা হাসপাতালে অত্যন্ত জটিল অবস্থায় আসেন। তাদের অনেকে শক সিনড্রোমে ভোগে মাল্টিপল অর্গান বিকল অবস্থায় হাসপাতালে ভর্তি হন। ফলে তাদের নিবিড় পরিচর্যা কেন্দ্রে রেখে চিকিৎসা দিতে হয় এবং তাদের অনেকে মৃত্যুবরণ করেন।

 

কী ধরনের রোগী হাসপাতালে ভর্তি নেয়া হচ্ছে এমন প্রশ্নে তারা বলেন, ডেঙ্গু রোগীদের চাপ ও শারীরিক অবস্থা বিবেচনা করে তুলনামূলক জটিল রোগীদের হাসপাতালে ভর্তি নেয়া হচ্ছে। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের চিকিৎসা গাইডলাইন অনুযায়ী বিপদচিহ্ন রয়েছে এমন রোগীদেরই ভর্তি নেয়া হচ্ছে। ডেঙ্গু হলেই হাসপাতালে আসতে হবে না। খারাপ অবস্থা নিয়ে হাসপাতালে আসা রোগীর সংখ্যা বেড়েছে বলে জানান তারা।

 

মুগদা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের পরিচালক ডা. মো. নিয়াতুজ্জামান বলেন, হাসপাতালে ভর্তি হলেই বেশ কয়েকদিন থাকতে হচ্ছে ডেঙ্গু রোগীদের। আক্রান্তের স্বল্প সময়ের মধ্যে মৃত্যুর ঘটনা রোগীদের মধ্যে আতঙ্ক সৃষ্টি করেছে। পুরোপুরি সুস্থ না হলে হাসপাতাল ছাড়তে চায় না রোগীরা। আর নিরাপদ মনে না হলে ছাড়পত্র দিতে স্বস্তিবোধ করছেন না চিকিৎসকরাও। তাছাড়া দৈনিক ভর্তি হওয়া রোগী এবং ছাড়পত্রপ্রাপ্ত ডেঙ্গু রোগীর সংখ্যার মধ্যেই খুব বেশি পার্থক্য থাকে না।

 

স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের সংক্রমণ রোগ নিয়ন্ত্রণ শাখার (সিডিসি) সাবেক পরিচালক অধ্যাপক ডা. বেনজির আহমেদ ভোরের আকাশকে বলেন, এ বছর আক্রান্ত ও মৃত্যুসংখ্যা বিবেচনায় ইতোমধ্যে আগের সব রেকর্ড ভেঙেছে। হাসপাতালে ভর্তি হওয়া রোগী সংখ্যার ভিত্তিতেই ডেঙ্গু আক্রান্তের সংখ্যা হিসাব করছে অধিদপ্তর। হাসপাতালে যেতে হয় না এমন ডেঙ্গু রোগীর সংখ্যা তো রয়েই গেছে।

 

তিনি আরো বলেন, এবার ডেঙ্গু রোগীদের হাসপাতালে ভর্তি হওয়ার চিত্র বেশ লক্ষণীয়। শারীরিক অবস্থার অবনিত ঘটলেই চিকিৎসক ও হাসপাতালের শরণাপন্ন হচ্ছেন রোগীরা। প্রতিদিনই বড় সংখ্যার রোগী ভর্তি হচ্ছে। হাসপাতাল থেকে ছাড়পত্র প্রাপ্ত রোগীর সংখ্যা কম। ফলে চিকিৎসাধীন রোগীর সংখ্যা কমছে না।

 

তিনি বলেন, ডেঙ্গু হলেই রোগীর হাসপাতালে যাওয়া উচিত। হাসপাতালে রোগীর পিসিভি, প্লাটিলেটসহ সব শারীরিক অবস্থা পরীক্ষা করবে। প্রয়োজনে ডে কেয়ার সার্ভিস দেবে। এরপর শারীরিক অবস্থা দেখে হাসপাতালে ভর্তি নেবে নাকি বাসায় থাকবে সে সিদ্ধান্ত নেবে। কিন্তু এটি যদি আমরা রোগীর ওপর ছেড়ে দিই, তাহলে অবস্থার অবনতি হবে। রোগী তার প্রকৃত অবস্থা বুঝতে পারবে না। যেমন, ডায়রিয়া ডেঙ্গুর একটি লক্ষণ। যা রোগীদের একটা বড় অংশই জানে না।

 

কিন্তু সে ডায়রিয়া হয়ে শকে চলে যেতে পারে। তাই এই দ্বৈত অবস্থা তৈরি না করে ডেঙ্গু হলেই রোগীকে হাসপাতালে সেবা দেয়ার ব্যবস্থা করা হোক। ডিএনসিসি হাসপাতালের মতো ফিল্ড হাসপাতাল চালু করা হোক। প্রয়োজনে চিকিৎসক-নার্স বাড়িয়ে দেয়া হোক, যেন তারা সমানভাবে প্রত্যেককে গুরুত্ব দিতে পারেন।

 

ডেঙ্গুরোগ বিশেষজ্ঞ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ব বিদ্যালয়ের মেডিসিন অনুষদের সাবেক ডিন এবং প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ব্যক্তিগত চিকিৎসক ইমেরিটাস অধ্যাপক ডা. এবিএম আব্দুল্লাহ ভোরের আকাশকে বলেন, ‘ডেঙ্গু পরিস্থিতির অবনতি অব্যাহত থাকায় প্রতিটি হাসপাতালেই কম-বেশি চাপ সৃষ্টি হয়েছে। জ্বর হলেই হাসপতালে ভর্তির প্রয়োজন নেই। যাদের জ্বর রয়েছে তাদের প্রথম দায়িত্ব ডেঙ্গু পরীক্ষা করা।

 

ডেঙ্গু শনাক্ত হলে চিকিৎসকের পরামর্শ অনুযায়ী বাসায় অবস্থান করে প্রচুর পানি ও তরল জাতীয় খাবার খেতে হবে। চিকিৎসকের পরামর্শে ওষুধ খাবেন। ফার্মেসি থেকে নিজের ইচ্ছামতো অ্যান্টিবায়োটিক খাওয়া থেকে বিরত থাকবেন। তাহলেই অনেক জটিলতা কমে যাবে। গাইডলাইনে কিছু বিপদচিহ্ন উল্লেখ করা হয়েছে। যেগুলো দেখা দিলে হাসপাতালে যেতে হবে। মানুষকে এ বিষয়ে বেশি বেশি জানানোর উদ্যোগ নিতে হবে।’

 

অধ্যাপক এবিএম আব্দুল্লাহ বলেন, যারা এবার আক্রান্ত বা মারা যাচ্ছেন তারা আগে যেকোনো সময় ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়েছেন। প্রথমবার ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হলে অবস্থা সিভিয়ার হয় না। জ্বর বা সাধারণ কিছু সমস্যায় কাটিয়ে তারা সুস্থ হয়ে যান। কিন্তু দ্বিতীয়, তৃতীয় বা চতুর্থবার হলে রোগীর অবস্থা সিভিয়ার হয়। এবার তাইই ঘটছে। ফলে আক্রান্ত ও মৃত্যুর সংখ্যা বেশি। বিশেষ করে শিশু ও বয়স্ক ব্যক্তিরা, যাদের কোমরবিডিটি রয়েছে। এসব কারণেই হাসপাতালে চিকিৎসাধীন ডেঙ্গু রোগীর সংখ্যা কমছে না বলে জানান অধ্যাপক এবিএম আব্দুল্লাহ।

 

ভোরের আকাশ/নি 

মন্তব্য

Beta version