-->
এডিস মশা নিধন

পরামর্শ ও নির্দেশনায় সীমাবদ্ধ

শিপংকর শীল
পরামর্শ ও নির্দেশনায় সীমাবদ্ধ

শিপংকর শীল: পরামর্শ ও নির্দেশনায় সীমাবদ্ধ এডিস মশা নিধন! লার্ভা পর্যায়ে ধ্বংস করতে না পারলে উড়ন্ত এডিস মশা নিয়ন্ত্রণ এবং ডেঙ্গু মোকাবিলায় সফলতা পাওয়া সম্ভব হবে না বলে জানিয়ে দিয়েছেন স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালেক। জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ডেঙ্গুরোগের বাহক এডিস মশার বংশবিস্তারের তিন স্তর হলো লার্ভা, বাড়ন্ত ও উড়ন্ত।

 

লার্ভা ধ্বংসে সফলতা দেখাতে পারছেন না দায়িত্বপ্রাপ্তরা। সীমিতসংখ্যক বাসাবাড়িতে অভিযান চালিয়ে জরিমানা আদায় করে লার্ভা নিয়ন্ত্রণে আনা যাবে না। ডেঙ্গু মোকাবিলায় বাড়াতে হবে জনসম্পৃক্ততা। সিটি করপোরেশনের মশক নিধন বিভাগের পাশাপাশি প্রত্যেক ওয়ার্ড কাউন্সিলরসহ এলাকার গণমান্য ব্যক্তিদের কর্মসূচিতে সম্পৃক্ত করতে হবে।

 

দেশে ডেঙ্গু পরিস্থিতির অবনতি অব্যাহত রয়েছে। ডেঙ্গুতে মৃত্যু ও আক্রান্তের সংখ্যা সর্বকালের রেকর্ড ভেঙেছে। আক্রান্তের স্বল্প সময়ের মধ্যে মৃত্যুর ঘটনায় ডেঙ্গুরোগীর মধ্যে বিরাজ করছে মৃত্যু আতঙ্ক। গ্রামাঞ্চলের যেখানে সেখানে এডিস মশার লার্ভা পাওয়ার ঘটনা যেন আতঙ্কের মাত্রা বাড়িয়ে দিয়েছে। গ্রামাঞ্চলে লার্ভা ধ্বংস করার নির্দিষ্ট কোনো কাঠামো ও কর্তৃপক্ষ নেই। উপসর্গহীন ডেঙ্গুরোগীও পাওয়া যাচ্ছে।

 

হঠাৎ করে প্লাটিলেট নেমে গেলেই কান্নাকাটি শুরু করে দিচ্ছেন রোগীর স্বজনরা। চিকিৎসকদের বোঝানোর পরও নিরাপদ মনে করছেন না অনেকে। সরকারি হাসপাতালে সিট না পেয়ে আতঙ্কে বেসরকারি হাসপাতালে ছুটছেন অনেক রোগী। তাদের অনেকে অসাধু চক্রের খপ্পরে হয়ে পড়ছেন নিঃস্ব। অপ্রয়োজনীয় আইসিইউতে রেখে টাকা হাটিয়ে নেয়ার অভিযোগও উঠছে। জীবন বাঁচানোর আশায় সব মেনে নিচ্ছেন রোগীর স্বজনরা।

 

স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের পরিস্থিতির পরিসংখ্যানে দেখা গেছে, চলতি বছরে পহেলা জানুয়ারি থেকে ৩১ আগস্ট পর্যন্ত দেশে ডেঙ্গু জ্বরে আক্রান্ত হয়ে দিনে গড়ে প্রায় দু’জনের মৃত্যু হয়েছে। আর দেশের বিভিন্ন হাসপাতালে দৈনিক ভর্তি হয়েছেন গড়ে ৫১৬ জন।

 

কিন্তু গত দু’মাস জুলাই ও আগস্টের চিত্র খুবই ভয়াবহ। গত জুলাই মাসে দৈনিক গড়ে ১৪৫২ জন ডেঙ্গু রোগী হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন এবং দৈনিক মারা গেছেন গড়ে ৭ জন। এভাবে আগস্ট মাসে ডেঙ্গু জ্বরে আক্রান্ত হয়ে দৈনিক হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন ২৩৯৯ জন এবং মারা গেছেন দৈনিক গড়ে ১১ জন।

 

আর সেপ্টেম্বরের গত পাঁচ দিনের পরিস্থিতি আরো ভয়াবহ রূপ নিয়েছে। গত ৫ দিনে ডেঙ্গু জ্বরে আক্রান্ত হয়ে মারা গেছেন মোট ৬৪ জন। অর্থাৎ দৈনিক গড়ে মারা গেছেন ১৩ জন। গত ৫ দিনে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন ১২ হাজার ১০৮ জন, যা দৈনিক গড়ে দাঁড়ায় ২ হাজার ৪২২ জন।

 

মশা নিধনে সিটি করপোরেশন ও পৌরসভাগুলোকে আরো তৎপর হওয়া প্রয়োজন বলে মনে করেন স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণমন্ত্রী জাহিদ মালেক। তিনি বলেছেন, মশা একবার উড়ে গেলে তো নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যায়। লার্ভা পর্যায়ে মশাকে ধ্বংস করতে পারলে আগামীতে ডেঙ্গু কম থাকবে।

 

স্বাস্থ্যমন্ত্রী আরো বলেন, শুধু যে মৌসুমে ডেঙ্গু দেখা দিচ্ছে, তখনই কেবল স্প্রে করলাম, সারাবছর স্প্রে করলাম না, তাতে কাজ হবে না। সে জন্য সারা বছর কাজ করতে হবে। যে ওষুধটা দেয়া হচ্ছে, সেটা সঠিক মান ও পরিমাণের হতে হবে, যাতে ওষুধগুলো কার্যকর হয়ে মশাটা মারা যাবে। আর ঢাকায়ই পূর্ণ মনোযোগ দিলে হবে না, ডেঙ্গু পুরো দেশে ছড়িয়ে পড়েছে। কাজেই সব পৌরসভা ও সিটি করপোরেশনেও অনেক কার্যকর পদক্ষেপ নিতে হবে। ঢাকার মতো অন্য জেলা ও সিটি করপোরেশনে পদক্ষেপ নিতে হবে। বাড়িগুলো পরিষ্কার করতে হবে।

 

তিনি বলেন, অ্যাকশন তো সিটি করপোরেশনকে নিতে হবে। সেই অ্যাকশনটুকু সময়মতো দেখতে চাই। মশা একবার উড়ে গেলে তো নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যায়। লার্ভা পর্যায়ে মশাকে ধ্বংস করতে পারলে আগামীতে ডেঙ্গু কম থাকবে। সারা বছর এই কার্যক্রম চলমান থাকা প্রয়োজন।

 

জাহিদ মালেক আরো বলেন, ডেঙ্গু ইতোমধ্যে সিটি করপোরেশনে কিছুটা কমেছে। আমরা দেখেছি অন্যান্য জেলায় অনেক বেড়েছে। আগে যা ছিল তা প্রায় দ্বিগুণের কাছাকাছি পৌঁছেছে। সবগুলো জেলায় বাড়তি এবং প্রত্যেক জেলায় পরীক্ষা করে দেখা গেছে ডেঙ্গুর লার্ভা পাওয়া যাচ্ছে বিভিন্ন জায়গায়। যারা আক্রান্ত হয়েছে বেশিরভাগই ঢাকা থেকে যারা গেছে তারা আক্রান্ত হয়ে অন্যান্য জেলায় গেছে, বাড়িতে গেছে। সেখানে আবারো মশার কামড়ে সেটা ছড়িয়েছে। মশা যে পর্যন্ত না কমবে সে পর্যন্ত ডেঙ্গু রোগী কমবে না এবং মৃত্যুও কমবে না। কমাতে হলে সকলে মিলে আমাদেরকে কাজ করতে হবে। আমরা সেই চেষ্টাই করছি।

 

জাহিদ মালেক বলেন, যে সমস্ত কীটনাশক ব্যবহার করা হচ্ছে সেগুলো যাতে ইফেকটিভ হয়, ভালো হয় এবং মশা যাতে মরে, মশার লার্ভা যাতে মরে সেই ধরনের ওষুধ ব্যবহার করা দরকার এবং নিশ্চিত হওয়া দরকার। ঢাকা সিটি করপোরেশনে উনারা করছেন, কমছে। তাতে বোঝা যায় যে মশা কমে আসছে। রোগীর সংখ্যা এখন একটু কমে আসছে। অন্যান্য জেলাতে স্প্রে বেশি করে করতে হবে। পৌরসভা এবং অন্যান্য সিটি করপোরেশনে সজাগ হতে হবে, আরো বেশি অ্যাকটিভ হতে হবে। তবেই আমাদের কমবে।

 

এডিস মশা নিয়ন্ত্রণে বিজ্ঞান সম্মত পদ্ধতি : এডিস মশা নিয়ন্ত্রণ করতে হলে শুধু ওষুধ ছিটানো নয় বরং নিতে হবে সমন্বিত মশক ব্যবস্থাপনার মতো বিজ্ঞান সম্মত পদক্ষেপ। ধ্বংস করতে হবে মশার আবাসস্থল। এমন মত দিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা।

 

তারা বলছেন, মশা কার্যকরভাবে নিয়ন্ত্রণ করতে হলে এই পদক্ষেপগুলো সারা বছরজুড়েই অব্যাহত থাকতে হবে। শুধু এডিস মশার প্রজনন মৌসুম শুরু হওয়ার আগে এ ধরণের পদক্ষেপ নিলে তা কাজে আসবে না।

 

জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণীবিদ্যা বিভাগের শিক্ষক ড. কবিরুল বাশার বলেন, সমন্বিত মশক ব্যবস্থাপনার আওতায় প্রথম টুলটি হচ্ছে পরিবেশগত ব্যবস্থাপনা। আমাদের পরিবেশের বিভিন্ন জায়গায়, এডিস মশা জন্মানোর জন্য যে পাত্র তৈরি হয় সেটি যাতে না হতে পারে তার জন্য ব্যবস্থা নিতে হবে।

 

দ্বিতীয়টি হচ্ছে জৈবিক ব্যবস্থাপনা বা বায়োলজিক্যাল কন্ট্রোল। এর জন্য অনেকগুলো উপাদান রয়েছে। যেমন সাইক্লক্স, ব্যাকটেরিয়া, উলভাকিয়া জাতীয় মশা এ ধরনের বেশ কয়েকটি প্রক্রিয়াতে মশা নিয়ন্ত্রণ করা যায়।

 

তৃতীয়টি হচ্ছে কেমিক্যাল কন্ট্রোল বা কীটনাশক। এটা অনেক রকম। একটা উড়ন্ত মশার জন্য। আরেকটি হচ্ছে বাচ্চা মশা বা লার্ভি মারার জন্য। লার্ভি মারার জন্য ওষুধ দিতে হয় পানিতে আর উড়ন্ত মশা মারার জন্য দিতে হয় বাইরে। তবে কীটনাশক ব্যবহার করে মশা মারার পদ্ধতি এডিস মশা এবং কিউলেক্স মশার জন্য ভিন্ন বলেন জানান তিনি।

 

তিনি বলেন, এটা সঠিক মাত্রায়, সঠিক সময়ে, সঠিক জায়গায় প্রয়োগ করতে হবে। আর আরেকটি হচ্ছে আইজিআর বা ইনসেক্ট গ্রোথ রেগুলেটর-এটিরও ব্যবহার করা যেতে পারে।

 

চার নম্বর হচ্ছে, কমিউনিটির লোকজনকে মশক নিধনে সম্পৃক্ত করতে হবে। কমিউনিটির লোকজন নিজেরা নিজেদের উদ্যোগে সমাজকে পরিষ্কার রাখবে, মশা বাহিত রোগ সম্পর্কে সচেতন হবে এবং সচেতন করবে।

 

তিনি বলেন, এই চারটি টুলস একসাথে কাজ না করলে এডিস মশা নিয়ন্ত্রণ হবে না। এই চারটি টুলস সারা বছর কাজে লাগাতে হবে। শুধুমাত্র এডিস মশার মৌসুমে না বা ডেঙ্গু যখন হবে সেই সময়ে না, সারা বছরই একটি সমন্বিত মশক ব্যবস্থাপনার আওতায় আমাদের শহরকে নিয়ে আসতে হবে।

 

তিনি বলেন, আমাদের দেশে এডিস মশার নিয়ন্ত্রণে এ ধরনের কোন পদ্ধতি অনুসরণ করা হয় না। শুধু কেমিক্যাল কন্ট্রোলটা ব্যবহার করা হয়। কীটনাশক দিয়ে মশা নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা চালানো হয়।

 

তার মতে, এডিস মশা জন্মস্থান আলাদা। সেই জন্মস্থানকে টার্গেট করা দরকার। সেটাও ঠিকমতো করা হয় না। আর এই কাজগুলো ঠিকমতো হচ্ছে কিনা তার জন্য মনিটরিং ও ইভালুয়েশন টিম থাকা দরকার। এই মনিটরিং ও ইভালুয়েশন টিমটা হতে হবে থার্ড পার্টি। স্বতন্ত্র কোনো টিম না হলে এর মনিটরিংটাও ঠিকমতো হবে না। মশা নিয়ন্ত্রণে আনতে হলে ওষুধ ছিটানোর পরিবর্তে এর উৎসস্থলকে ধ্বংস করা দরকার বলে মনে করেন স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের রোগ নিয়ন্ত্রণ বিভাগের প্রধান ডা. সানিয়া তাহমিনা।

 

তিনি বলেন, গবেষণাসহ নানা ধরনের পদক্ষেপ নেয়া যেমন নিয়মিত বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার সঙ্গে যোগাযোগ রাখছেন তারা। যার অংশ হিসেবে মশা নিয়ন্ত্রণে গাইডলাইন বিষয়ে কোনো ভুল আছে কিনা সে বিষয় পরামর্শ দিতে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা থেকে একজন সুদক্ষ এন্টোমলজিস্ট নিয়ে আসা হয়েছে।

 

ডা. সানিয়া তাহমিনা বলেন, এডিস মশা সহজে মরে গেলেও জন্মায় অনেক বেশি। সারা বছরই সমন্বিত প্রচেষ্টার মাধ্যমে অর্থাৎ সরকার, করপোরেশন, সামাজিক সংগঠন এবং ব্যক্তিগত উদ্যোগ প্রত্যেকটা জায়গা কাজে লাগিয়ে মশার উৎসস্থল ধ্বংস করতে হবে। তা নাহলে হঠাৎ করে কাজ করে মশা নিয়ন্ত্রণ করা খুবই কঠিন ব্যাপার।

 

ভোরের আকাশ/নি 

মন্তব্য

Beta version