নিখিল মানখিন: দেশে গড়ে উঠেছে প্রাথমিক চিকিৎসাসেবার মজবুত অবকাঠামো। বিভাগীয়, জেলা ও উপজেলা পর্যায়ের চিকিৎসা প্রতিষ্ঠানগুলোতে প্রাথমিক চিকিৎসাসেবা বিভাগ বা কর্নার রয়েছে। আর গ্রামাঞ্চলে গড়ে তোলা হয়েছে কমিউনিটি ক্লিনিক। উল্লেখযোগ্য মানুষ ফার্মেসিগুলোতে প্রাথমিক চিকিৎসাসেবা গ্রহণ করে থাকেন বলে বিভিন্ন গবেষণা প্রতিবেদনে বেরিয়ে এসেছে।
চিকিৎসকরা বলছেন, ইনজুরি, পানিতে ডুবে যাওয়া, সড়ক দুর্ঘটনা, অগ্নিকান্ড, সেলফ হার্ম, সুইসাইড, রক্তচাপ ও ডায়াবেটিস পরিমান প্রতিটি ক্ষেত্রে প্রাথমিক চিকিৎসার প্রয়োজনীয়তা রয়েছে।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের রোগ নিয়ন্ত্রণ বিভাগের সাবেক পরিচালক ও আইইডিসিআরের সাবেক প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক ডা. বেনজির আহমেদ ভোরের আকাশকে বলেন, ‘প্রাথমিক চিকিৎসা বা ফার্স্ট এইড জরুরি চিকিৎসা সেবার একটি অংশ। কখনো কখনো রোগী প্রাথমিক চিকিৎসা পেলে, পরবর্তী জটিলতা এমনকি মৃত্যুঝুঁকি এড়াতে পারেন। সাপের কামড় থেকে শুরু করে সড়ক দুর্ঘটনা, আগুনে পুড়ে যাওয়ার মতো ঘটনায় প্রাথমিক চিকিৎসা জীবন রক্ষাকারী ভূমিকা পালন করে।’
প্রাথমিক চিকিৎসার জীবন রক্ষাকারী ভূমিকা তুলে ধরে তিনি বলেন, ‘কোনো কারণে কারো রক্তপাত হলে প্রাথমিক চিকিৎসা প্রদানের মাধ্যমে যদি তার রক্তপাত বন্ধ করা যায় তবে তিনি বেঁচে যাবেন। যদি কোনো রোগীর শিরা ও ধমনী কেটে যায় এবং তার রক্তপাত বন্ধ না করা যায়, তবে ছয় থেকে আট মিনিটের মধ্যে তার মৃত্যু হবে। একই সঙ্গে পুড়ে যাওয়া ব্যক্তিকে সঠিক সময় প্রথমিক চিকিৎসা না দেয়া গেলে বড়সড় ক্ষতির আশঙ্কা থেকে যায়। এমনকি কারো হৃদযন্ত্র বন্ধ হয়ে গেলেও প্রাথমিক চিকিৎসার মাধ্যম তা সচল করা যায়।’
কারা প্রথমিক শিক্ষা দিতে পারবেন এমন প্রশ্নের জবাবে অধ্যাপক বেনজির বলেন, ‘প্রাথমিক চিকিৎসা যে কেউ দিতে পারেন। চিকিৎসকদেরও প্রাথমিক চিকিৎসা দিতে হয়, জরুরি বিভাগে যখন কোনো রোগী আসে তখন চিকিৎসকরা তাকে প্রাথমিক চিকিৎসা প্রদান করেন। এছাড়াও মাঠ পর্যায়ের স্বাস্থ্যকর্মী, রেড ক্রিসেন্ট ও স্কাউটসহ বিভিন্ন স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনগুলোও প্রাথমিক চিকিৎসা প্রদান করেন।
এমনকি অ্যাম্বুলেন্সের চালক ও তার সহযোগীকে প্রাথমিক চিকিৎসার ট্রেনিং প্রদান করা হয়। সাধারণ মানুষও প্রাথমিক চিকিৎসা প্রদান করতে পারেন। এ লক্ষ্যে সরকার এবং বিভিন্ন সংস্থা প্রথমিক চিকিৎসা বিষয়ক প্রশিক্ষণ প্রদান করছে।’
প্রাথমিক চিকিৎসার বিষয়ে আরো জনসচেতনতা তৈরির প্রয়োজন জানিয়ে তিনি বলেন, ‘প্রাথমিক চিকিৎসার বিষয়ে সবক্ষেত্রে সচেতনতা নেই। এখনো মানুষ অনেক ভুল প্রথমিক চিকিৎসা প্রদান করে।
যেমন সাপে কামড়ের ক্ষেত্রে প্রথমিক চিকিৎসা গ্রহণ না করেই সাপুড়ের কাছে যায়, ফলে অনেক সময় রোগী বিষক্রিয়ায় মৃত্যুবরণ করে। কুকুরে কামড় দিলে অন্তত ১৫ মিনিট পানি দিয়ে ধুতে হয় এটা প্রাথমিক চিকিৎসা। এটি এখন অনেক ক্ষেত্রেই ব্যবহৃত হচ্ছে। আগে কুকুরে কামড়ের চিকিৎসায় কলাপড়া, লবণপড়া খাওয়ানোর যে রীতি ছিল তা থেকে মানুষ অনেকটাই বেরিয়ে এসেছে। অর্থাৎ কিছু ক্ষেত্রে ধ্যান-ধারণায় পরিবর্তন এসেছে, অনেক ক্ষেত্রে আনা প্রয়োজন।’
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের মেডিসিন অনুষদের সাবেক ডিন এবং প্রধানমন্ত্রীর বর্তমান ব্যক্তিগত চিকিৎসক অধ্যাপক ডা. এবিএম আব্দুল্লাহ ভোরের আকাশকে বলেন, দেশে গড়ে উঠেছে প্রাথমিক চিকিৎসাসেবার মজবুত অবকাঠামো। বিভাগীয়, জেলা ও উপজেলা পর্যায়ের চিকিৎসা প্রতিষ্ঠানগুলোতে প্রাথমিক চিকিৎসাসেবা বিভাগ বা কর্নার রয়েছে। আর গ্রামাঞ্চলে গড়ে তোলা হয়েছে কমিউনিটি ক্লিনিক। ইনজুরি, পানিতে ডুবে যাওয়া, সড়ক দুর্ঘটনা, অগ্নিকান্ড, সেলফ হার্ম, সুইসাইড, রক্তচাপ ও ডায়াবেটিস পরিমান প্রতিটি ক্ষেত্রে প্রাথমিক চিকিৎসার প্রয়োজনীয়তা রয়েছে।
তিনি আরো বলেন, প্রাথমিক চিকিৎসা বা ফার্স্ট এইড চিকিৎসার মূল উদ্দেশ্য হচ্ছে তাৎক্ষণিকভাবে ব্যবস্থা গ্রহণ করে মৃত্যু কমিয়ে আনা। তবে আমাদের দেশে ফার্স্ট এইড বক্স পরিচিত হলেও কী করে প্রাথমিক চিকিৎসা বা ফার্স্ট এইড চিকিৎসাসেবা নিশ্চিত করা যায় সে সম্পর্কে ধারণা নেই অনেকেরই। অথচ সংকটের সময়ে মানুষকে বাঁচাতে প্রাথমিক চিকিৎসাসেবা দেয়ার জন্য দরকার জনসচেতনতা।
প্রাথমিক চিকিৎসার প্রশিক্ষণ যদি থাকে, তাহলে তাৎক্ষণিকভাবে তার উপকার পাওয়া সম্ভব। এটি জীবন রক্ষায় সহায়ক ভ‚মিকা পালন করতে পারে, সামলানো যায় রোগী। দুর্ঘটনাজনিত যেকোনো কারণে শারীরিক ক্ষতি বা আঘাত পেলে সাধারণত এই অস্থায়ী চিকিৎসাসেবা অনেকাংশেই রোগীকে সুস্থ হতে সাহায্য করে। ক্ষতির পরিমাণ বা সংকটময় অবস্থাকে আরো সংকটাপন্ন অবস্থায় যেতে বাধা দেয়ার ক্ষেত্রে প্রাথমিক চিকিৎসাসেবা কার্যকরী ভূমিকা পালন করে। পানিতে ডুবে যাওয়া, সাপে কাটা, রক্তপাত বন্ধ করার ব্যবস্থা, চেতনাহীন ব্যক্তির চেতনা ফিরিয়ে আনার মতো জরুরি কাজ করে রোগীকে সংকটময় মুহূর্ত থেকেই উদ্ধার করে প্রাথমিক চিকিৎসাসেবা।
পাবলকি হেলথ ফাউন্ডেশনের নির্বাহী পরিচালক ডা. তৌফিক জোয়ার্দার বলেন, ‘আমাদের দেশে বিগত বছরগুলোতে আলোচনা হয়েছে ইনফেকশাস ডিজিজকেন্দ্রিক এবং স¤প্রতি সেখানে যোগ হয়েছেন অসংক্রামক রোগকেন্দ্রিক আলোচনা। কিন্তু ইনজুরি যে একটি ডিজিজ বা এটাও যে হেলথ ক্রাইসিস, এর কারণে প্রচুর মানুষ আক্রান্ত হতে পারে সে ধারণা যতদিন আমাদের থাকবে না, তা থেকে বেঁচে ওঠার জন্যই ফার্স্ট এইডের যে প্রয়োজনীয়তা সেটাও আমরা প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দিতে পারব না। ফার্স্ট এইড কেবল নির্দিষ্ট কারো জন্য নয়। প্রত্যেকের জন্য প্রযোজ্য। তাই ফার্স্ট এইডের যে কনসেপ্ট এটা স্কুল জীবন থেকেই প্রশিক্ষণ থাকা দরকার।
কমিউনিটি ক্লিনিকে প্রাথমিক চিকিৎসা: কমিউনিটি ক্লিনিক নির্দেশিকা অনুযায়ী, কমিউনিটি ক্লিনিকে সেবাগ্রহীতা ও সেবার মান বেড়েই চলেছে। প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবা ও চিকিৎসাসেবায় বিশ্বের মডেল হয়ে দাঁড়িয়েছে বাংলাদেশের কমিউনিটি হেলথ কেয়ার প্রকল্প। সার্বিক প্রজনন স্বাস্থ্য পরিচর্যার আওতায় অন্তঃসত্ত্বা মহিলাদের প্রসব পূর্ব (প্রতিষেধক টিকাদান) এবং প্রসব পরবর্তী (নবজাতকের সেবা) সেবা দেন। সময়মতো প্রতিষেধক টিকাদান (যক্ষা, ডিপথেরিয়া, হুপিং কফ, পোলিও, ধনুষ্টংকার, হাম, হেপাটাইটিস-বি, নিউমোনিয়া) শিশু ও কিশোর-কিশোরীদের জন্য প্রয়োজনীয় স্বাস্থ্য ও চিকিৎসাসেবা দেয়া হয়।
জনগণের জন্য বিশেষ মহিলা ও শিশুদের অপুষ্টি দূরীকরণের জন্য ফলপ্রসূ ব্যবস্থা গ্রহণ ও সেবা প্রদান করা হয়। ম্যালেরিয়া, যক্ষা, কুষ্ঠ, কালাজ্বর, ডায়রিয়াসহ সংক্রামক রোগ প্রতিরোধ ব্যবস্থা এবং সেগুলোর সীমিত চিকিৎসা সুবিধা রয়েছে। সাধারণ জখম, জ্বর, ব্যথা, কাটা- পোড়া, দংশন, বিষক্রিয়া হাঁপানি চর্মরোগ, ক্রিমি এবং চোখ, দাঁত ও কানের সাধারণ রোগের ক্ষেত্রে লক্ষণভিত্তিক প্রাথমিক চিকিৎসা প্রদান করা হয়।
অস্থায়ী পরিবার পরিকল্পনা পদ্ধতি সংক্রান্ত বিভিন্ন উপকরণ, যেমন কনডম, পিল, ইসিপি সর্বক্ষণিক সরবরাহ ও বিতরণ নিশ্চিত করা হয়। জটিল রোগীদের প্রয়োজনীয় প্রাথমিক সেবা প্রদান করে দ্রুত উচ্চতর পর্যায়ে রেফার করা হয়। সদ্য বিবাহিত ও অন্তঃসত্ত্বা মহিলাদের নিবন্ধীকরণ ও সম্ভাব্য প্রসব তারিখ সংরক্ষণ করতে হয়। মহিলা ও কিশোর-কিশোরীদের রক্তস্বল্পতা শনাক্ত এবং প্রয়োজনীয় চিকিৎসা প্রদান করতে হয়। প্রয়োজনীয় প্রশিক্ষণ এবং ব্যবস্থাদি থাকা সাপেক্ষে স্বাভাবিক প্রসব পরিচালনা করা হয়।
কমিউনিটি হেলথ কেয়ার প্রোভাইডার ওষুধপত্র ও এমএসআরসহ আবশ্যক দ্রব্যাদির প্রয়োজনীয়তা নির্ণয় করেন। ওষুধপত্র ও এমএসআর সংগ্রহের জন্য ইউনিয়ন মেডিকেল অফিসারের মাধ্যমে উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা এবং পরিবার কল্যাণ সামগ্রী প্রদানের জন্য উপজেলা পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা বরাবর ইনডেন্ট প্রদান করে থাকেন। যেসব গর্ভবতী মহিলা কমিউনিটি ক্লিনিক হতে প্রসবপূর্ব ও প্রসবোত্তর সেবা গ্রহণ করেননি এবং যে সব নারী/ পুরুষ ইপিআই, যক্ষা, কুষ্ঠ বিষয়ে কমিউনিটি ক্লিনিক হতে সেবা গ্রহণ করেননি, স্বাস্থ্য সহকারী ও পরিবার কল্যাণ সহকারীরা তাদের খুঁজে বের করে কমিউনিটি ক্লিনিকের সেবা ব্যবস্থায় ফিরিয়ে আনার চেষ্টা করেন।
প্রাথমিক চিকিৎসা বক্স: চিকিৎসকরা জানান, ফার্স্ট এইড বা প্রাথমিক চিকিৎসার মূল উদ্দেশ্য হলো তাৎক্ষণিক ত্বরিত ব্যবস্থায় অনাকাক্সিক্ষত মৃত্যুকে কমিয়ে আনা। এ জন্য ফার্স্ট এইড বক্সের কিছু উপকরণের পাশাপাশি প্রাথমিক চিকিৎসার প্রশিক্ষণও প্রয়োজন। আমাদের দেশে ফার্স্ট এইড বক্স পরিচিত হলেও প্রশিক্ষণ বা সেই জরুরি মুহূর্তে করণীয় বিষয়গুলো খুব একটা পরিচিত নয়। যেকোনো পরিস্থিতিতে আমরা উপস্থিত বুদ্ধি খাটিয়ে ব্যবস্থা নিয়ে থাকি। তা কখনো কখনো সুফল বয়ে আনে বা কারো জীবন রক্ষা করতে সহায়তা করে। কিন্তু প্রাথমিক চিকিৎসা বিষয়ে কারো ভালো জ্ঞান বা প্রশিক্ষণ থাকলে সে দক্ষতা ও আত্মবিশ্বাসের সঙ্গে কোনো অসুস্থতা বা আঘাতের পর করণীয় ঠিক করতে পারে; যা জীবন রক্ষা করতে পারে। বাড়িতে একটি ফার্স্ট এইড বক্স থাকলে তা কাজেই লাগবে।
ফার্স্ট এইড বক্স হলো একটি বহনযোগ্য বক্স। এতে অনেক কিছুই থাকতে পারে। যেগুলো নিয়ে প্রাথমিকভাবে ছোটখাটো দুর্ঘটনার মোকাবিলা করা যাবে। যাতে একজন মানুষ কোনোভাবে আহত বা হঠাৎ করে অসুস্থ হলে তাকে জরুরি প্রাথমিক চিকিৎসা দেয়া যায়। কিছু সরঞ্জাম ব্যবহার করে দ্রুত সিদ্ধান্ত নেয়া যেতে পারে, এখন কী করতে হবে রোগীর জন্য। আবার কিছু থাকে, যা দিয়ে প্রাথমিকভাবে অবস্থা সামাল দিয়ে কিছু সময় পাওয়া যায়, যেটা ব্যবহার করে দুর্ঘটনায় পড়া মানুষকে নিরাপদ জায়গায় নিয়ে যাওয়া যায়।
পরিবেশ পরিস্থিতি বুঝে ফার্স্ট এইড বক্স একটু ভিন্ন হতে পারে, তবে অতিপ্রয়োজনীয় জিনিসপত্র সব কটিতে প্রায় একই থাকে। সেগুলো হলো গজ ব্যান্ডেজ, তুলা বা কটন, ক্রেপ ব্যান্ডেজ, সার্জিক্যাল ব্যান্ডেজ, কাঁচি, চিমটা (ফরসেপ), সার্জিক্যাল গ্লাভস , টর্চ, জীবাণুনাশক বা অ্যান্টিসেপটিক, থার্মোমিটার, ওষুধ,পানি বিশুদ্ধকরণ ট্যাবলেট, পালস অক্সিমিটার, রক্তচাপ মাপার যন্ত্র, গ্লুকোমিটার।
ভোরের আকাশ/নি
মন্তব্য