-->
শিরোনাম

মশকনিধনে সংশ্লিষ্টদের অপারগতা

নিখিল মানখিন
মশকনিধনে সংশ্লিষ্টদের অপারগতা

নিখিল মানখিন: ডেঙ্গু পরিস্থিতি মোকাবিলায় অনেকটা অপারগতা প্রকাশ করেছে দায়িত্বপ্রাপ্ত প্রতিষ্ঠান ও ব্যক্তিরা! এমন প্রশ্ন ও ক্ষোভ আজ মানুষের মনে। অসহায় হয়ে পড়েছেন ডেঙ্গু রোগী ও তাদের স্বজনরা।

 

জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা বলছেন, চলতি বছরের শুরু থেকেই খারাপ পরিস্থিতির ইঙ্গিত পাওয়া গিয়েছিল। কিন্তু গুরুত্ব না দেয়ার কারণে ভয়াবহ রূপ নিয়েছে। মশকনিধনের ব্যর্থতার দায় কেউ নিচ্ছে না। জনসচেতনতাই এখন ডেঙ্গু মোকাবিলার মূল হাতিয়ার বলে বক্তব্য দিয়ে যাচ্ছেন দায়িত্বপ্রাপ্ত প্রতিষ্ঠানের কর্তাব্যক্তিরা। অথচ মশকনিধনসহ ডেঙ্গু মোকাবিলায় ইতোমধ্যে খরচ হয়ে গেছে কোটি কোটি টাকা।

 

জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা বলছেন, পরামর্শ ও নির্দেশনায় সীমাবদ্ধ এডিস মশকনিধন! লার্ভা পর্যায়ে ধ্বংস করতে না পারলে উড়ন্ত এডিস মশা নিয়ন্ত্রণ এবং ডেঙ্গু মোকাবিলায় সফলতা পাওয়া সম্ভব হবে না বলে জানিয়েছেন স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালেক। ডেঙ্গু রোগের বাহক এডিস মশার বংশবিস্তারের তিন স্তর হলো লার্ভা, বাড়ন্ত ও উড়ন্ত। লার্ভা ধ্বংসে সফলতা দেখাতে পারছেন না দায়িত্বপ্রাপ্তরা। সীমিতসংখ্যক বাসাবাড়িতে অভিযান চালিয়ে জরিমানা আদায় করে লার্ভা নিয়ন্ত্রণে আনা যাবে না। ডেঙ্গু মোকাবিলায় বাড়াতে হবে জনসম্পৃক্ততা। সিটি করপোরেশনের মশকনিধন বিভাগের পাশাপাশি প্রত্যেক ওয়ার্ড কাউন্সিলরসহ এলাকার গণ্যমান্য ব্যক্তিদের কর্মসূচিতে সম্পৃক্ত করতে হবে।

 

দেশে ডেঙ্গু পরিস্থিতির অবনতি অব্যাহত রয়েছে। ডেঙ্গুতে মৃত্যু ও আক্রান্তের সংখ্যা সর্বকালের রেকর্ড ভেঙেছে। আক্রান্তের স্বল্প সময়ের মধ্যে মৃত্যুর ঘটনায় ডেঙ্গু রোগীর মধ্যে বিরাজ করছে মৃত্যু আতঙ্ক। গ্রামাঞ্চলের যেখানে সেখানে এডিস মশার লার্ভা পাওয়ার ঘটনা যেন আতঙ্কের মাত্রা বাড়িয়ে দিয়েছে। গ্রামাঞ্চলে লার্ভা ধ্বংস করার নির্দিষ্ট কোনো কাঠামো ও কর্তৃপক্ষ নেই।

 

উপসর্গহীন ডেঙ্গু রোগীও পাওয়া যাচ্ছে। হঠাৎ করে প্লাটিলেট নেমে গেলেই কান্নাকাটি শুরু করে দিচ্ছেন রোগীর স্বজনরা। চিকিৎসকদের বোঝানোর পরও নিরাপদ মনে করছেন না অনেকে। সরকারি হাসপাতালে সিট না পেয়ে আতঙ্কে বেসরকারি হাসপাতালে ছুটছেন অনেক রোগী। তাদের অনেকে অসাধু চক্রের খপ্পড়ে হয়ে পড়ছেন নিঃস্ব। অপ্রয়োজনীয় আইসিইউতে রেখে টাকা হাটিয়ে নেয়ার অভিযোগও উঠছে। জীবন বাঁচানোর আশায় সব মেনে নিচ্ছেন রোগীর স্বজনরা।

 

মশকনিধনে সিটি করপোরেশন ও পৌরসভাগুলোকে আরো তৎপর হওয়া প্রয়োজন বলে মনে করেন স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণমন্ত্রী জাহিদ মালেক। তিনি বলেন, মশা একবার উড়ে গেলে তো নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যায়। লার্ভা পর্যায়ে মশাকে ধ্বংস করতে পারলে আগামীতে ডেঙ্গু কম থাকবে।

 

স্বাস্থ্যমন্ত্রী আরো বলেন, শুধু যে মৌসুমে ডেঙ্গু দেখা দিচ্ছে, তখনই শুধু স্প্রে করলাম, সারা বছর স্প্রে করলাম না, তাতে কাজ হবে না। সে জন্য সারা বছর কাজ করতে হবে। যে ওষুধটা দেয়া হচ্ছে, সেটা সঠিক মান ও পরিমাণের হতে হবে, যাতে ওষুধগুলো কার্যকর হয়ে মশাটা মারা যাবে। আর ঢাকায়ই পূর্ণ মনোযোগ দিলে হবে না, ডেঙ্গু পুরো দেশে ছড়িয়ে পড়েছে। কাজেই সব পৌরসভা ও সিটি করপোরেশনে সেখানেও অনেক কার্যকর পদক্ষেপ নিতে হবে। ঢাকার মতো অন্য জেলা ও সিটি করপোরেশনে পদক্ষেপ নিতে হবে। বাড়িগুলো পরিষ্কার করতে হবে।

 

তিনি বলেন, অ্যাকশন তো সিটি করপোরেশনকে নিতে হবে। সেই অ্যাকশনটুকু সময় মতো দেখতে চাই। মশা একবার উড়ে গেলে তো নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যায়। লার্ভা পর্যায়ে মশাকে ধ্বংস করতে পারলে আগামীতে ডেঙ্গু কম থাকবে। সারা বছর এ কার্যক্রম চলমান থাকা প্রয়োজন। সিটি করপোরেশনকে সারা বছর করা প্রয়োজন। গত ৪ সেপ্টেম্বর স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালেক বলেছেন, মশা নির্মূল না করা পর্যন্ত ডেঙ্গু রোগী ও মৃত্যুর সংখ্যা কমবে না। ডেঙ্গু রোগ নিয়ন্ত্রণে আনতে হলে আমাদের সবাইকে একযোগে কাজ করতে হবে। আমরা এখন এটা সমন্বিতভাবে করার চেষ্টা করছি।

 

গত ৭ সেপ্টেম্বর বিকেলে সচিবালয়ে স্থানীয় সরকারমন্ত্রী মো. তাজুল ইসলাম সাংবাদিকদের বলেন, মশা মারার দায়িত্ব মন্ত্রণালয়ের একার না। জনগণকে সম্পৃক্ত করে এ কাজ করা হয়। স্বাস্থ্যমন্ত্রী বলেছেন, চিকিৎসার দায়িত্ব ওনার, কথাটা ঠিকই বলেছেন। মশা মারার ব্যাপারে দায়িত্বে আছি আমরা এবং জনগণ। আমরা একা না।

 

মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে আন্তরিকতার কোনো ঘাটতি নেই দাবি করে তিনি বলেন, নেতৃত্ব স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ের। আমরা জনগণকে সম্পৃক্ত করে এ কাজটা করি এবং করছি। মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে উদ্যোগ ও আন্তরিকতার কোথাও ঘাটতি নেই। জনগণের অংশগ্রহণের মধ্য দিয়ে মশকনিধন কার্যক্রমের সফলতা অর্জন করা যেতে পারে। ঢাকার জনগণ যদি অংশগ্রহণ না করত, তাহলে রাজধানীতে ২০ লাখ (শনাক্ত রোগী) হতো। এটা আমার ধারণা।

 

সম্প্রতি রাজধানীতে একটি অনুষ্ঠানে ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের (ডিএনসিসি) মেয়র মো. আতিকুল ইসলাম বলেন, এডিস মশা মারার জন্য আসলে কামান বা বন্দুক দরকার নেই। ডেঙ্গু প্রতিরোধে সবচেয়ে বড় অস্ত্র হলো সচেতনতা। ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণে আমরা বিভিন্নভাবে চেষ্টা করে যাচ্ছি। মশকনিধনে নিয়মিত কার্যক্রম পরিচালনার পাশাপাশি প্রচারণা চালাচ্ছি।

 

সম্প্রতি ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের মেয়র ব্যারিস্টার শেখ ফজলে নূর তাপস বলেন, জনগণ সচেতন হলে এবং দায়িত্বশীল ভ‚মিকা পালন করলে ডেঙ্গু পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে রাখা সম্ভব হবে। একটি মশার উৎসই পুরো এলাকার জনস্বাস্থ্যের জন্য হুমকি তৈরি করতে পারে। একটি পাত্রে জমে থাকা পানির ভেতর প্রচুর পরিমাণে লার্ভা ও মশা জন্মানো সম্ভব। সুতরাং প্রথমত আমাদের দায়িত্বশীল ভ‚মিকা পালন করতে হবে। শতভাগ নির্মূল করতে পারব এটা আমরা বলছি না, কিন্তু জনগণ সচেতন হলে আমরা এটা নিয়ন্ত্রণে রাখতে পারব।

 

মশকনিধনের বিকল্প নেই বিশেষজ্ঞরা: বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের মেডিসিন অনুষদের সাবেক ডিন এবং প্রধানমন্ত্রীর ব্যক্তিগত চিকিৎসক ইমেরিটাস অধ্যাপক ডা. এবিএম আবদুল্লাহ ভোরেরন আকাশকে বলেন, ‘আমাদের মশা মারার কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে। কিন্তু মশা মারার সঠিক পদ্ধতি ও ব্যবস্থাপনা এখনো গ্রহণ করা হয়নি।

 

বৈজ্ঞানিক ও কারিগরি পদ্ধতি প্রয়োগ করে ধাপে ধাপে মশা নিয়ন্ত্রণ করতে হবে। কারণ এখনই হাসপাতালগুলোয় রোগী বাড়ছে। এ অবস্থা চলতে থাকলে সামনে বিপদ। তাই রোগী যাতে আর না বাড়ে, সেজন্য পদক্ষেপ নিতে হবে। মশার নিয়ন্ত্রণ ছাড়া এটার সমাধান সম্ভব না। ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হওয়ার পর অন্য রোগব্যাধিতেও আক্রান্ত হচ্ছেন অনেকে। যে কারণে মৃত্যুর সংখ্যা বাড়ছে।

 

জাতীয় প্রতিষেধক ও সামাজিক চিকিৎসা প্রতিষ্ঠানের (নিপসম) কীটতত্ত বিভাগের প্রধান কীটতত্ত¡বিদ অধ্যাপক ড. মো. গোলাম সারোয়ার বলেন, শত্রুর সঙ্গে তো আপনি ভোঁতা অস্ত্র দিয়ে লড়াই করতে পারবেন না। আবার এ লড়াইয়ের জন্য আপনার পর্যাপ্ত সামরিক জ্ঞান থাকতে হবে। তা না হলে আপনার গুলি শত্রæর গায়ে না লেগে নিজের গায়েও লাগতে পারে। আমরা তো শত্রু চিনি। এডিস মশা।

 

কিন্তু দেশে মশা মারার সঠিক ব্যবস্থাপনা তো নেই। ওষুধের প্রয়োগ, সঠিক সময় ও প্রশিক্ষিত জনবল এ তিনটি ব্যবস্থা বৈজ্ঞানিক ও কারিগরি ব্যবস্থাপনায় থাকতে হবে। কিন্তু আমরা কী সেটা করতে পারছি? ফলে যা হওয়ার তাই হচ্ছে, ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাচ্ছে।

 

মশা নিয়ন্ত্রণে আনতে হলে ওষুধ ছিটানোর পরিবর্তে এর উৎসস্থলকে ধ্বংস করা দরকার বলে মনে করেন স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের রোগ নিয়ন্ত্রণ বিভাগের প্রধান ডা. সানিয়া তাহমিনা। তিনি বলেন, গবেষণাসহ নানা ধরনের পদক্ষেপ নেয়া যেমন নিয়মিত বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার সঙ্গে যোগাযোগ রাখছেন তারা। যার অংশ হিসেবে মশা নিয়ন্ত্রণে গাইডলাইন বিষয়ে কোনো ভুল আছে কিনা, সে বিষয় পরামর্শ দিতে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা থেকে একজন সুদক্ষ এন্টোমলজিস্ট নিয়ে আসা হয়েছে।

 

ডা. সানিয়া তাহমিনা বলেন, এডিস মশা সহজে মরে গেলেও জন্মায় অনেক বেশি। সারা বছরই সমন্বিত প্রচেষ্টার মাধ্যমে অর্থাৎ সরকার, করপোরেশন, সামাজিক সংগঠন এবং ব্যক্তিগত উদ্যোগ প্রত্যেকটা জায়গা কাজে লাগিয়ে মশার উৎসস্থল ধ্বংস করতে হবে। তা না হলে হঠাৎ করে কাজ করে মশা নিয়ন্ত্রণ করা খুবই কঠিন ব্যাপার।

 

পরিস্থিতি কেন নিয়ন্ত্রণ করা যাচ্ছে না এমন প্রশ্নের জবাবে জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ ডা. বেনজীর আহমেদ বলেন, এ মৃত্যুর দুটি দিক আছে। একটি ভাইরাস এবং অপরটি মশা। প্রথমত এ ভাইরাসের অন্তত পাঁচটি ভ্যারিয়েন্ট আছে। কেউ যদি একবার কোনো একটি ভ্যারিয়েন্টে আক্রান্ত হন, তাহলে তার শরীরে শুধু ওই ভ্যারিয়েন্টের ইউমিনিটি তৈরি হয়। কিন্তু অন্য ভাইরাসে আক্রান্ত হলে অবস্থা আরো খারাপের দিকে যাচ্ছে।

 

তিনি আরো বলেন, এক গবেষণায় দেখা গেছে, ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে যাদের মৃত্যু হয়েছে তাদের মধ্যে অর্ধেকই মারা গেছেন হাসপাতালে আসার দুদিনের মধ্যে। অর্থাৎ দ্রুত পরিস্থিতির অবনতি হচ্ছে। এখন এ বিষয়ে যে গবেষণা দরকার সেটা তো নেই।

 

দ্বিতীয়ত, এডিস মশা থেকে ডেঙ্গু হচ্ছে। সেই মশা মারার কার্যক্রম তো আমরা দেখছি না। সিটি করপোরেশন মশা মারছে ফগার মেশিন দিয়ে। এ ফগার মেশিন কারা চালাচ্ছে? যাদের একটুও টেকনিক্যাল জ্ঞান নেই। কোনো বিশেষজ্ঞও তাদের গাইড করছে না। তাহলে কীভাবে হবে?

 

ভোরের আকাশ/নি 

মন্তব্য

Beta version