-->
শিরোনাম

তথ্য জালিয়াতি করে চাকরি

ইমরান খান
তথ্য জালিয়াতি করে চাকরি

ইমরান খান: নিজের বয়স, বাবা, মায়ের নাম ও ঠিকানাসহ বিভিন্ন ধরনের জাল তথ্য দিয়ে পুলিশে চাকরি করছেন তিন শতাধিক ব্যক্তি। এদের মধ্যে বেশিরভাইগই লোকই ভুল তথ্য দিয়ে নিয়োগ পেয়েছেন পুলিশে কনস্টেবল হিসেবে। চাকরি নিশ্চিত হওয়ার পর তথ্য সার্ভিস বুক অনুযায়ী তথ্য পরিবর্তন করতে নির্বাচন কমিশনে আবেদনও করেছেন অনেকে। তাদের কারো তথ্য সংশোধন হয়েছে, আবার কারো আবেদন এখনো প্রক্রিয়াধীন।

 

২০১৯ সালে ভুল তথ্য দিয়ে চাকরি পাওয়া ১৮ কনস্টেবলের নিয়োগ বাতিল হয় ২০২১ সালে। নিয়োগে পুলিশ ভেরিকেশনের দায়িত্বপালনকারী ছয় উপ-পরিদর্শর্কের বিরুদ্ধে বিভাগীয় মামলা করা হয়। তবে এই জালিয়াতির সঙ্গে জড়িত ঊর্ধ্বতন পুলিশ কর্মকর্তারদের বিষয়ে কোনো তদন্ত হয়েছে কিনা তা আজও জানা যায়নি।

অভিযোগ রয়েছে ভুল ঠিকানা ব্যবহার করে কনস্টেবল হিসেবে নিয়োগ হয়েছে ইব্রাহিম। বর্তমানে তিনি রাজধানীর মিরপুর বিভাগের রূপনগর থানায় কনস্টেবল পদে কর্মরত। ২০১৩ সালের ৩০ মার্চ পুলিশের চাকরিতে যোগ দেন তিনি। পুলিশের চাকরি নেয়ার সময় দেয়া তথ্য অনুযায়ী তার স্থায়ী ঠিকানা নারায়ণগঞ্জের আড়াইহাজার থানার উলুকান্দি এলাকায়।

 

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, তার স্থায়ী ঠিকানা টাঙ্গাইলের দুর্গাপুর ইউনিয়নের বেড়ীপটল গ্রামে। সেখান থেকে চাকরির কোটা শেষ হওয়ায় চাকরি নেয়ার জন্য স্থায়ী ঠিকানা হিসেবে নারায়ণগঞ্জের আড়াইহাজার থানার উলুকান্দি গ্রাম দেখাতে হয়েছে ইব্রাহিমকে। সরকারি চাকরি বাগিয়ে নিতে নারায়ণগঞ্জের আড়াইহাজার থানার উলুকান্দি গ্রামের ঠিকানা ব্যবহার করলেও সে এলাকায় তাকে কেউই চেনেন না।

 

স্থানীয়রা জানান, কনেস্টবল ইব্রাহিমকে কখনো ওই এলাকায় দেখা যায়নি। এমনকি তার ছবি দেখানো হলেও কেউ তাকে চিনতে পারেননি। এদের মধ্যে এক চা বিক্রেতা ইব্রাহিমের ছবি দেখে বলেন, এই লোক এই এলাকার না। তবে ওই এলাকার বাসিন্দা না হলেও ৪, ৫ ও ৬নং ওয়ার্ডের সংরক্ষিত মহিলা কাউন্সিলরের প্রত্যায়নপত্র সংগ্রহ করেছিলেন কনস্টেবল ইব্রাহিম।

 

এ বিষয়ে উলুকান্দির ৪, ৫ ও ৬নং ওয়ার্ডের সংরক্ষিত মহিলা কাউন্সিলর সুফিয়া ভোরের আকাশকে বলেন, আমার ভাইয়ের চাকরির সুবাদে অন্য জেলার কিছু লোককে আমার এলাকার বাসিন্দা হিসেবে দেখিয়ে কিছু কাগজপত্রে আমি স্বাক্ষর করেছিলাম। এ বিষয়টি নিয়ে লেখালেখি না করতে প্রতিবেদককে বারবার অনুরোধ করেন এই নারী কাউন্সিলর।

 

এই বিষয়ে টাংগাইলের পটল উপজেলার দুর্গাপুর ইউনিয়নের ৮নং ওয়ার্ডের মেম্বার নুর মোহাম্মদ বলেন, কনেস্টেবল ইব্রাহিম আমার আপন চাচাতো ভাই। আমরা এখানকার স্থানীয়। আমার ও আমার বাবা, দাদাসহ সকলের জন্মস্থান এখানেই। ইব্রাহিম যখন পুলিশে চাকরি নেয় তখন তাদের আর্থিক অবস্থা ভালো ছিল না। তাদের সাত ভাইয়ের মধ্যে ইব্রাহিম ৫ নাম্বার। চাকরিতে ইব্রাহিম যে ঠিকানা ব্যবহার করেছে আমার জানামতে ওই ঠিকানায় তার কোনো আত্মীয় বা নিজের বাড়ি নেই। সে কিভাবে ওটাকে স্থানীয় ঠিকানা হিসেবে ব্যবহার করেছে সেটা আমার জানা নেই।

 

এ বিষয়ে কথা হয় কনস্টেবল ইব্রাহিমের সঙ্গে। ভুল তথ্য দিয়ে চাকরি নেয়ার বিষয়টি জানতে চাইলে তিনি দৈনিক ভোরের আকাশকে বলেন, ভাই এগুলো বাদ দেন। থানায় আসেন একসাথে চা খেতে খেতে কথা বলি। ফোনে কোনো বক্তব্য দেবেন না বলে জানিয়ে ফোন রেখে দেন। এরপর রূপনগর থানায় গিয়ে তাকে ফোনে বা সরাসরি পাওয়া যায়নি।

 

শুধু ইব্রাহিম নয় তথ্য জালিয়াতি করে সরকারি চাকরি করে আসা তিন শতাধিক কর্মচারীর তথ্য গোপনের নথিপত্র এসেছে ভোরের আকাশের হাতে। তাদের একজন চাঁদ মোহাম্মদ। নিজের পুরো নাম পরিবর্তন করে তিনিও পুলিশের কনস্টেবল হিসেবে চাকরি করছেন। সার্ভিস বুকে তার নাম মারুফ হোসেন। জন্মতারিখ ১৫ জানুয়ারি ১৯৯৭ সাল। অথচ জাতীয় পরিচয়পত্রের ভান্ডারের তথ্য, ভোটার হওয়ার সময় তিনি ছিলেন উচ্চমাধ্যমিক পাস।

 

তথ্য বলছে, পুলিশ সদর দপ্তরের দীর্ঘ অনুসন্ধানের পর ২০২১ সালে জালিয়াতি করে পুলিশে চাকরি নেয়া ১৮ কনস্টেবলের নিয়োগ বাতিল করা হয়। ওই ১৮ কনস্টেবল হলেন, হুমায়ূন কবীর, আকরাম হোসেন, রিপন হোসেন, সজীব, সবুজ হোসেন, রাসেল, সোহেল রানা, মানিক মিয়া, সাদরুল, রাসেল শেখ, রিপন সরকার, আপিরুল ইসলাম, তোফায়েল খান, সুমন আহম্মেদ, রায়হান আলী, কবির মিয়া, ফিরোজ আলী ও সুজন আহম্মেদ।

 

জানা গেছে, ১৮ জন কনস্টেবলের বেশিরভাগেরই স্থায়ী ঠিকানা সিরাজগঞ্জ জেলায়। এছাড়া কয়েকজন বগুড়া, নেত্রকোনা, টাঙ্গাইল, জামালপুরসহ অন্যান্য জেলারও স্থায়ী বাসিন্দা। অন্য জেলার বাসিন্দা হওয়ার পরও অবৈধ ঘুষ লেনদেনের মাধ্যমে জেলা কোটায় নিয়োগ পেয়েছিল তারা। আবেদনের আগে তারা সবাই নারায়ণগঞ্জের রূপগঞ্জ থানাধীন পুটিনার বাগলা, আড়াইহাজার থানাধীন সাহেববাজারের পূর্বকান্দি, ফতুল্লা থানাধীন বক্তাবলী এলাকার মধ্যনগর এলাকায় এক খন্ড করে জমি কেনেন।

 

পরে তদন্ত করে ১৮ কনস্টেবল নিয়োগের বিষয়ে জালিয়াতির প্রমাণ পাওয়ার পর তাদের সবাইকে চাকরি থেকে বরখাস্ত করা হয়। তাদের নিয়োগ বাতিল হলেও এই জালিয়াতির সঙ্গে জড়িত ঊর্ধ্বতন কোনো পুলিশ কর্মকর্তার বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়নি। তারা সবাই আছেন বহাল তবিয়তে। তবে নিয়োগে পুলিশ ভেরিকেশনের দায়িত্বপালনকারী ছয় উপপরিদর্শর্কের বিরুদ্ধে বিভাগীয় মামলা দায়ের করা হয়েছে।

 

এভাবে তথ্য জালিয়াতি বা তথ্য গোপন করে চাকরি পেলে তা প্রশাসন ও সংশ্লিষ্ট সংস্থার জন্য সুখকর নয় বলে মনে করেন সরকারি কর্মকমিশনের সাবেক চেয়ারম্যান ড. মোহাম্মদ সাদিক। তিনি বলেন, তথ্য গোপন, জালিয়াতি ও বিকৃতি করে সরকারি চাকরিতে যোগ দেয়া শাস্তিযোগ্য অপরাধ। চাকরির শুরুতেই যারা এ ধরনের কাজ করে, তাদের মধ্যে অপরাধপ্রবণতা থাকতে পারে। নিয়োগকারীদের অধিকতর তথ্য যাচাই-বাছাই করতে হবে।

 

এ বিষয়ে জানতে চাইলে ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) মুখপাত্র গণমাধ্যম ও জনসংযোগ বিভাগের উপকমিশনার ফারুক হোসেন বলেন, এটাতো পুলিশ সদর দপ্তরের আরএমসিপি শাখা দেখে। এটি আমাদের (ডিএমডি) বিষয় না। পুলিশ সদর দপ্তরের ডিআইজি এডমিন আমিনুল ইসলামের সঙ্গে একাধিকবার যোগাযোগের চেষ্টা করেও তাকে পাওয়া যায়নি।

 

ভোরের আকাশ/নি 

মন্তব্য

Beta version