-->
শিরোনাম

ডেঙ্গুর ভয়াবহতা অব্যাহত

নিখিল মানখিন
ডেঙ্গুর ভয়াবহতা অব্যাহত

নিখিল মানখিন: অক্টোবরেও থাকবে ডেঙ্গুর দাপট। মাসের গত ৬ দিনের নাজুক পরিস্থিতি এবং স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়সহ বিশেষজ্ঞদের বক্তব্যে এ কথাই বেরিয়ে এসেছে। গত তিন মাসের ডেঙ্গু পরিস্থিতি বিগত সময়ের সব পরিসংখ্যান পেছনে ফেলে নতুন রেকর্ড গড়েছে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, চলতি বছর জানুয়ারি থেকেই ডেঙ্গুজ্বরে আক্রান্ত ও মৃত্যুর ঘটনা শুরু হলেও বড় ধরনের আঘাত এসেছে জুলাই, আগস্টে ও সেপ্টেম্বরে।

 

এই তিন মাসের মধ্যে ভয়াবহ রূপ নেয় সেপ্টেম্বরের পরিস্থিতি। যা এখনো অব্যাহত রয়েছে। মৃত্যুহার বেশি হওয়ায় ডেঙ্গুরোগীদের মধ্যে বেড়েছে আতঙ্ক। ডেঙ্গু রোগী সামাল দিতে হিমর্শিম খাচ্ছে সরকারি হাসপাতাল। আর বেসরকারি হাসপাতালের উচ্চ চিকিৎসাব্যয় মেটাতে অসহায় রোগী ও তাদের স্বজনেরা।

 

বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকরা বলছেন, দেশে ডেঙ্গু পরিস্থিতির অবনতি অব্যাহত রয়েছে। ডেঙ্গুতে মৃত্যু ও আক্রান্তের সংখ্যা সর্বকালের রেকর্ড ভেঙেছে। আক্রান্তের স্বল্প সময়ের মধ্যে মৃত্যুর ঘটনায় ডেঙ্গুরোগীর মধ্যে বিরাজ করছে মৃত্যু আতঙ্ক। গ্রামাঞ্চলের যেখানে সেখানে এডিস মশার লার্ভা পাওয়ার ঘটনা যেন আতঙ্কের মাত্রা বাড়িয়ে দিয়েছে। গ্রামাঞ্চলে লার্ভা ধ্বংস করার নির্দিষ্ট কোনো কাঠামো ও কর্তৃপক্ষ নেই। উপসর্গহীন ডেঙ্গুরোগীও পাওয়া যাচ্ছে। হঠাৎ করে প্লাটিলেট নেমে গেলেই কান্নাকাটি শুরু করে দিচ্ছেন রোগীর স্বজনরা।

 

চিকিৎসকদের বোঝানোর পরও নিরাপদ মনে করছেন না অনেকে। সরকারি হাসপাতালে সিট না পেয়ে আতঙ্কে বেসরকারি হাসপাতালে ছুটছেন অনেক রোগী। তাদের অনেকে অসাধু চক্রের খপ্পড়ে হয়ে পড়ছেন নিঃস্ব। অপ্রয়োজনীয় আইসিইউ’তে রেখে টাকা হাতিয়ে নেয়ার অভিযোগও উঠছে। জীবন বাঁচানোর আশায় সব মেনে নিচ্ছেন রোগীর স্বজনরা।

 

বৃষ্টি না কমলে ডেঙ্গু কমবে না : গত বুধবার বিকেলে এডিস সার্ভের ফলাফল নিয়ে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর কর্তৃক ভার্চুয়াল ব্রিফিংয়ে অধিদপ্তরের অতিরিক্ত মহাপরিচালক (পরিকল্পনা ও উন্নয়ন) অধ্যাপক ডা. আহমেদুল কবির বলেন, তাপমাত্রা না কমলে হয়তো ডেঙ্গু সংক্রমণটা কমবে না। ডেঙ্গু এখন তাপমাত্রার ওপর নির্ভরশীল। বৃষ্টি না থামলে কমার সম্ভাবনা দেখছি না। ডেঙ্গু সংক্রমণ প্রকৃতির ওপর নির্ভরশীল না হলেও এডিস মশার বংশ বৃদ্ধিটা ঠিকই প্রকৃতির ওপর নির্ভর করছে।

 

মশা না কমলে ডেঙ্গু রোগীও কমবে না: মঙ্গলবার দুপুরের দিকে ঢাকা মেডিক্যাল কলেজের পাশে ডা. মিলন অডিটোরিয়ামে ‘ডেঙ্গু ড্রপস’ অ্যাপের উদ্বোধনকালে স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালেক বলেন, এ বছর ডেঙ্গু রোগীর সংখ্যা বেশি। এটি সত্যিই উদ্বেগজনক। মশা নিয়ন্ত্রণ করা না গেলে নিস্তার মিলবে না ডেঙ্গু রোগ থেকে। মশা নির্মূল করতে হবে। মশা বাড়লে ডেঙ্গু রোগীর সংখ্যা বাড়বে। তাই সবাইকে সজাগ থাকতে হবে। আশপাশ পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন রাখতে হবে। এরইমধ্যে আমাদের স্বাস্থ্যসেবা ডেঙ্গু চিকিৎসায় অগ্রগতি লাভ করেছে।

 

ডেঙ্গুর বিস্তার আবহাওয়ার ওপর নির্ভর করে : স্থানীয় সরকারমন্ত্রী

সম্প্রতি রাজধানীর একটি অনুষ্ঠানে স্থানীয় সরকারমন্ত্রী মো. তাজুল ইসলাম বলেন, শুধু বাংলাদেশে নয়, জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে বিশ্বজুড়ে ডেঙ্গুর প্রাদুর্ভাব বাড়ছে। এডিস মশার প্রজনন এবং ডেঙ্গুর বিস্তার সম্পূর্ণভাবে আবহাওয়ার ওপর নির্ভর করে। ক্লাইমেট চেঞ্জের কারণে এটি হচ্ছে। শুধু আমাদের দেশে নয়, আজকে পৃথিবীর ১৪৮টি দেশে ডেঙ্গু মাত্রাতিরিক্ত পর্যায়ে গিয়েছে।

 

সচেতন হলেই নিয়ন্ত্রণ সম্ভব : ডিএনসিসি মেয়র

সম্প্রতি ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের (ডিএসসিসি) মেয়র শেখ ফজলে নূর তাপস বলেন, ‘জনগণ সচেতন হয়ে দায়িত্বশীল ভ‚মিকা পালন করলে ডেঙ্গু পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব। আমরা বলব না যে, শতভাগ ডেঙ্গু মশা নির্মূল করতে পারি। তবে মানুষ সচেতন হলে আমরা এটি নিয়ন্ত্রণ করতে পারব।

 

দায় এড়ানোর চেষ্টা সংশ্লিষ্টদের

ডেঙ্গু পরিস্থিতি মোকাবিলায় অনেকটা অপারগতা প্রকাশ করেছে দায়িত্বপ্রাপ্ত প্রতিষ্ঠান ও ব্যক্তিরা! এমন প্রশ্ন ও ক্ষোভ আজ মানুষের মনে। অসহায় হয়ে পড়েছেন ডেঙ্গু রোগী ও তাদের স্বজনেরা। জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা বলছেন, চলতি বছরের শুরু থেকেই খারাপ পরিস্থিতির ইঙ্গিত পাওয়া গিয়েছিল। কিন্তু গুরুত্ব না দেয়ার কারণে ভয়াবহ রূপ নিয়েছে। মশক নিধনের ব্যর্থতার দায় কেউ নিচ্ছে না। জনসচেনতাই এখন ডেঙ্গু মোকাবিলার মূল হাতিয়ার বলে বক্তব্য দিয়ে যাচ্ছেন দায়িত্বপ্রাপ্ত প্রতিষ্ঠানের কর্তা ব্যক্তিরা। অথচ মশক নিধনসহ ডেঙ্গু মোকাবিলায় ইতোমধ্যে খরচ হয়ে গেছে কোটি কোটি টাকা।

 

জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা বলছেন, পরামর্শ ও নির্দেশনায় সীমাবদ্ধ এডিস মশা নিধন! লার্ভা পর্যায়ে ধ্বংস করতে না পারলে উড়ন্ত এডিস মশা নিয়ন্ত্রণ এবং ডেঙ্গু মোকাবিলায় সফলতা পাওয়া সম্ভব হবে না বলে জানিয়ে দিয়েছেন স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালেক। ডেঙ্গুরোগের বাহক এডিস মশার বংশবিস্তারের তিন স্তর হলো- লার্ভা, বাড়ন্ত ও উড়ন্ত। লার্ভা ধ্বংসে সফলতা দেখাতে পারছেন না দায়িত্বপ্রাপ্তরা। সীমিতসংখ্যক বাসাবাড়িতে অভিযান চালিয়ে জরিমানা আদায় করে লার্ভা নিয়ন্ত্রণে আনা যাবে না। ডেঙ্গু মোকাবিলায় বাড়াতে হবে জনসম্পৃক্ততা। সিটি করপোরেশনের মশক নিধন বিভাগের পাশাপাশি প্রত্যক ওয়ার্ড কাউন্সিলরসহ এলাকার গণমান্য ব্যক্তিদের কর্মসূচিতে সম্পৃক্ত করতে হবে।

 

মশক নিধনের বিকল্প নেই : বিশেষজ্ঞরা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের মেডিসিন অনুষদের সাবেক ডিন এবং প্রধানমন্ত্রীর ব্যক্তিগত চিকিৎসক ইমেরেটাস অধ্যাপক ডা. এবিএম আবদুল্লাহ ভোরেরন আকাশকে বলেন, ‘আমাদের মশা মারার কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে। কিন্তু মশা মারার সঠিক পদ্ধতি ও ব্যবস্থাপনা এখনো গ্রহণ করা হয়নি। বৈজ্ঞানিক ও কারিগরি পদ্ধতি প্রয়োগ করে ধাপে ধাপে মশা নিয়ন্ত্রণ করতে হবে। কারণ এখনই হাসপাতালগুলোতে রোগী বাড়ছে। এই অবস্থা চলতে থাকলে সামনে বিপদ। তাই রোগী যাতে আর না বাড়ে সেজন্য পদক্ষেপ নিতে হবে। মশার নিয়ন্ত্রণ ছাড়া এটার সমাধান সম্ভব না। ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হওয়ার পর অন্য রোগব্যাধিতেও আক্রান্ত হচ্ছেন অনেকে। যে কারণে মৃত্যুর সংখ্যা বাড়ছে।

 

জাতীয় প্রতিষেধক ও সামাজিক চিকিৎসা প্রতিষ্ঠানের (নিপসম) কীটতত্ত্ব বিভাগের প্রধান কীটতত্ত্ববিদ অধ্যাপক ড. মো. গোলাম সারোয়ার বলেন, শত্রুর সঙ্গে তো আপনি ভোঁতা অস্ত্র দিয়ে লড়াই করতে পারবেন না। আবার এই লড়াইয়ের জন্য আপনার পর্যাপ্ত সামরিক জ্ঞান থাকতে হবে। তা না হলে আপনার গুলি শত্রুর গায়ে না লেগে নিজের গায়েও লাগতে পারে। আমরা তো শত্রু চিনি। এডিস মশা। কিন্তু দেশে মশা মারার সঠিক ব্যবস্থাপনা তো নেই। ওষুধের প্রয়োগ, সঠিক সময় ও প্রশিক্ষিত জনবল- এই তিনটি ব্যবস্থা বৈজ্ঞানিক ও কারিগরি ব্যবস্থাপনায় থাকতে হবে। কিন্তু আমরা কী সেটা করতে পারছি? ফলে যা হওয়ার তাই হচ্ছে, ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাচ্ছে।

 

পরিস্থিতি কেন নিয়ন্ত্রণ করা যাচ্ছে না, এমন প্রশ্নের জবাবে জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ ডা. বেনজীর আহমেদ বলেন, এই মৃত্যুর দুটি দিক আছে। একটি ভাইরাস এবং অপরটি মশা। প্রথমত এই ভাইরাসের অন্তত পাঁচটি ভ্যারিয়েন্ট আছে। কেউ যদি একবার কোন একটি ভ্যারিয়েন্টে আক্রান্ত হন, তাহলে তার শরীরে শুধু ওই ভ্যারিয়েন্টের ইউমিনিটি তৈরি হয়। কিন্তু অন্য ভাইরাসে আক্রান্ত হলে অবস্থা আরও খারাপের দিকে যাচ্ছে।

 

স্বাস্থ্য অধিদপ্তর জানায়, ডেঙ্গুজ্বরে আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হওয়া ও মৃতের সংখ্যা যথাক্রমে জানুয়ারিতে ৫৫৬ জন ও ৬ জন, ফেব্রুয়ারিতে ১৬৬ জন ও ৩ জন, মার্চে আক্রান্ত ১১১ জন, এপ্রিলে ১৪৩ জন ও ২ জন, মে মাসে ১০৩৬ জন ও ২ জন, জুনে ৫৯৫৬ জন ও ৩৬ জন, জুলাইয়ে ৪৩ হাজার ৮৫৪ জন ও ২০৪ জন, আগস্টে ৭১ হাজার ৯৭৬ জন ও ৩৪২ জন, সেপ্টেম্বরে ৭৯ হাজার ৫৯৪ জন ও ৩৯৬ জন এবং অক্টোবরের গত পাঁচ দিনে ভর্তি ১০ হাজার ৮৪১ জন এবং মৃত্যু ৫৭ জন।

 

ভোরের আকাশ/নি 

মন্তব্য

Beta version