-->
শিরোনাম
বিশ্ব আর্থ্রাইটিস দিবস আজ

দেশের ২৫ শতাংশ মানুষ আর্থ্রাইটিসে আক্রান্ত

নিখিল মানখিন
দেশের ২৫ শতাংশ মানুষ আর্থ্রাইটিসে আক্রান্ত

নিখিল মানখিন: দেশের প্রায় ২৫ শতাংশ মানুষ কোনো না কোনো ধরনের বাতরোগে (আর্থ্রাইটিস) আক্রান্ত। তবে এখনো অনেকে এই বিষয়ে ধারণা রাখেন না। দেশের গ্রামাঞ্চলের ৬০ বছরের বেশি বয়সী ৫২ শতাংশ মানুষ আর্থ্রাইটিসে ভুগছেন। এতে পুরুষ ৪৩ দশমিক ৪ শতাংশ এবং নারী ৫৬ দশমিক ৬ শতাংশ। বাত ব্যথায় আক্রান্ত প্রবীণদের মধ্যে ৪৩ দশমিক ৪ শতাংশের কোমর ব্যথা এবং ৩৭ দশমিক ৪ শতাংশের হাঁটুতে বেশি ব্যথা রয়েছে।

 

বাত ব্যথায় আক্রান্তদের বয়স্কদের মধ্যে ৪ শতাংশের মধ্যে রিউমাটয়েড আর্থ্রাইটিস। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের ইন্টারনাল মেডিসিন ও রিউমাটোলজি বিভাগের গবেষণা প্রতিবেদনে এ তথ্য জানানো হয়েছে। গবেষণায় নেতৃত্ব দেন অধ্যাপক ডা. মঈনুল হাসান।

 

তিনি বলেন, বাংলাদেশের জনসংখ্যার বড় অংশ কোনো না কোনো ধরনের জটিল বাতরোগে ভুগছেন। কিন্তু বাংলাদেশের বিশাল জনগোষ্ঠীর চিকিৎসার জন্য শুধু বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ে একটিমাত্র রিউমাটোলজি বিভাগ চালু আছে। রোগীদের চিকিৎসা দেয়ার জন্য মাত্র ৫০ থেকে ৬০ জন রিউমাটোলজিস্ট (এমডি কোর্স সম্পন্ন চিকিৎসক) রয়েছেন।

 

বিশেষজ্ঞরা বলেন, অস্থিসন্ধি বা হাড়ের জোড়ার প্রদাহজনিত রোগের নাম আর্থ্রাইটিস। এ রোগের চিকিৎসার অগ্রগতি রোগের অবস্থা ও কারণের ওপর নির্ভর করে। শুরুতেই বা কম উপসর্গ অবস্থার রোগ নির্ণয় করতে পারলে এর অগ্রগতি ভালো হয়। কিন্তু রোগ নির্ণয় করতে দেরি হলে অথবা শেষ ধাপে পৌঁছে গেলে রোগের অবনতি হতে থাকে। এটি নির্দিষ্ট একটি রোগ নয়। রিউমাটয়েট আর্থ্রাইটিস, অস্টিও আর্থ্রাইটিসসহ অনেক ধরনের রোগের সমন্বয় হলো আর্থ্রাইটিস। তাই আর্থ্রাইটিস যে কারণের জন্য হয়েছে সে কারণকে রোগ নির্ণয় পূর্বক চিকিৎসা করা হলে সফলতা পাওয়ার সম্ভাবনা বেশি। তবে সবচেয়ে বেশি হয় অস্টিওআর্থ্রাইটিস ও রিউমাটয়েড আর্থ্রাইটিস।

 

‘আর্থ্রাইটিস ফাউন্ডেশন’ আটল্যান্টা’-এর তথ্য অনুযায়ী বর্তমানে মানুষের অক্ষমতার প্রথম এবং প্রধান কারণ হলো আর্থ্রাইটিস। বাংলাদেশের প্রায় ২৫ শতাংশ মানুষ কোনো না কোনো ধরনের বাতরোগে আক্রান্ত। তবে এখনো অনেকে এই বিষয়ে ধারণা রাখে না। এটি অনেকগুলো রোগের প্রধান লক্ষণ। সবচেয়ে বেশি হয় অস্টিওআর্থ্রাইটিস ও রিউমাটয়েড আর্থ্রাইটিস।

 

আর্থ্রাইটিস: বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের রিউমাটোলজি বিভাগের চেয়ারম্যান অধ্যাপক ডা. মিনহাজ রহিম চৌধুরী বলেন, আর্থ্রাইটিস বলতে সাধারণত অস্থিসন্ধি বা জয়েন্টের প্রদাহকেই বোঝানো হয়। এটি নির্দিষ্ট একটি রোগ নয়। তবে সবচেয়ে বেশি হয় অস্টিওআর্থ্রাইটিস ও রিউমাটয়েড আর্থ্রাইটিস। তিনি বলেন, রিউমাটয়েট আর্থ্রাইটিস, স্পনডাইলো আর্থ্রাইটিস, অস্টিও আর্থ্রাইটিসসহ ১২০টি বড় ধরনের রোগসহ প্রায় সাতশ রোগের সমন্বয় হলো আর্থ্রাইটিস। বাংলাদেশের ২৫ শতাংশ মানুষ কোনো না কোনো ধরনের র্আর্থ্রাইটিস বা বাত-ব্যথায় ভুগছেন। তাদের মধ্যে ২৪ শতাংশের কর্মক্ষমতা কম।

 

রিউমাটয়েড আর্থ্রাইটিস ও অস্টিও আর্থ্রাইটিস: রিউমাটয়েড আর্থ্রাইটিস ও অস্টিও আর্থ্রাইটিস এর মধ্যে পার্থক্য তুলে ধরে ঢাকা ন্যাশনাল মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতালের অর্থোপেডিকস ও ট্রমা বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ডা. মিজানুর রহমান কল্লোল বলেন, রিউমাটয়েড আর্থ্রাইটিস একটি অটোইমিউন রোগ এবং এটা সচরাচর প্রথম জীবনে হয়। অন্য দিকে অস্টিও আর্থ্রাইটিস একটি বয়স সম্পর্কিত রোগ, যা কার্টিলেজের ক্ষয় বা ছিঁড়ে যাওয়ার জন্য হয়। রিউমাটয়েড আর্থ্রাইটিস সাধারণত ২৫ থেকে ৫০ বছর বয়সের মধ্যে ঘটে থাকে, তবে এটা শিশুদেরও আক্রান্ত করে। অস্টিও আর্থ্রাইটিস সাধারণত ৪০ বছরের বেশি বয়সী লোকদের আক্রান্ত করে।

 

রিউমাটয়েড আর্থ্রাইটিসে প্রায় সমানভাবে শরীরের দুপাশের অর্থাৎ ডান ও বাম দিকের অস্থিসন্ধিগুলো আক্রান্ত হয়। অন্য দিকে অস্টিও আর্থ্রাইটিসে শরীরের পৃথক পৃথক অস্থিসন্ধি আক্রান্ত হয় অথবা প্রথম দিকে শরীরের শুধু এক পাশের অস্থিসন্ধিগুলো আক্রান্ত হয়। রিউমাটয়েড আর্থ্রাইটিসে আক্রান্ত অস্থিসন্ধিগুলো লাল ও গরম হয় এবং ফুলে যায়। অন্য দিকে অস্টিও আর্থ্রাইটিসে অস্থিসন্ধিগুলো সাধারণত লাল ও গরম হয় না। রিউমাটয়েড আর্থ্রাইটিস অনেক অস্থিসন্ধিকে আক্রান্ত করে, সাধারণত হাত ও পায়ের ছোট জোড়াগুলো বেশি আক্রান্ত হয়।

 

এটা কনুই, কাঁধ, কবজি, হিপ, হাঁটু ও গোড়ালির গাঁটকেও আক্রান্ত করে। অন্য দিকে অস্টিও আর্থ্রাইটিস সাধারণত শরীরের ওজন বহনকারী অস্থিসন্ধিগুলোকে এবং যেসব অস্থিসন্ধি বেশি ব্যবহৃত হয় (যেমন হাঁটু হিপ) সেসব অস্থিসন্ধিকে বেশি আক্রান্ত করে। রিউমাটয়েড আর্থ্রাইটিস শরীরের সব তন্ত্রকে আক্রান্ত করতে পারে। সেই সঙ্গে সার্বিক অসুস্থতা বোধ হয় এবং অবসন্নতা দেখা দিতে পারে, শরীরের ওজন কমে যেতে পারে।

 

অন্য দিকে অস্টিও আর্থ্রাইটিসে সাধারণত আক্রান্ত জোড়াগুলোতে অস্বস্তিবোধ হয়। রিউমাটয়েড আর্থ্রাইটিসে সকালবেলা দীর্ঘ সময় আক্রান্ত জোড়াগুলো শক্ত থাকে। অন্য দিকে অস্টিও আর্থ্রাইটিসে আক্রান্ত জোড়াগুলো সকালবেলা অল্প সময় শক্ত থাকে। রিউমাটয়েড আর্থ্রাইটিসে মারাত্মক অবসন্নতা দেখা দেয়। অন্য দিকে অস্টিও আর্থ্রাইটিসে তেমন অবসন্নতা দেখা দেয় না।

 

প্রতিরোধ ও চিকিৎসা: ঢাকা ন্যাশনাল মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতালের সহকারি অধ্যাপক ডা. রফিক আহমেদ বলেন, বেদনানাশক ওষুধ সেবনই আর্থ্রাইটিস চিকিৎসার মূল কথা নয়। অনেক সময় অর্থোপেডিক (হাড় ও জোড়া রোগ বিশেষজ্ঞ) সার্জন, নিউরোমেডিসিন ও নিউরোসার্জনের পরামর্শের প্রয়োজন হয়। প্রায় প্রতিটি মেডিকেল কলেজেই ফিজিওথেরাপি সেন্টার, ক্লিনিকগুলোতেও ফিজিওথেরাপি বিভাগ রয়েছে। আর্থ্রাইটিস যে কারণের জন্য হয়েছে সে কারণকে রোগ নির্ণয় পূর্বক চিকিৎসা করা হলে সফলতা পাওয়ার সম্ভাবনা বেশি। চিকিৎসার পূর্বশর্ত রোগ নির্ণয় করা, রোগ নির্ণয়ের পূর্বশর্ত পরীক্ষা-নিরীক্ষা করা।

 

ডা. রফিক আহমেদ আরো বলেন, যত দ্রুত সম্ভব চিকিৎসকের পরামর্শ নিন।রোগের ধরন এবং নিরাময় সম্পর্কে জানার চেষ্টা করুন। ব্যথার ওষুধ বেশি ব্যবহার না করে জীবনযাত্রার মান পরিবর্তন করুন। মানসিক চাপ থেকে মুক্ত থাকুন। অতিরিক্ত বিশ্রামের পরিবর্তে কাজে ব্যস্ত থাকার চেষ্টা করুন। ব্যায়াম করাকে একটি নিয়মিত অভ্যাসে পরিণত করুন। অবসর সময় প্রিয়জনের সঙ্গে অতিবাহিত করুন। টেবিলে বসে ঝুঁকে পড়াশোনা করবেন না। নরম গদি-তোশক এবং উঁচু বালিশ বেশি ব্যবহার করবেন না। দেহের মেদ কমান-পুষ্টিকর খাবার খান। টেনশন কমান। প্রতিদিনই হালকা কিছু ব্যায়াম করুন।নিয়মিত কায়িক পরিশ্রম করুন। শীতকালে ঠান্ডায় এবং বর্ষায় স্যাঁতসেঁতে আবহাওয়ায় বয়স্করা সাবধানে থাকবেন।চিকিৎসকের পরামর্শ মতো দৈনন্দিন জীবনযাপন এবং ওষুধ সেবন করবেন।

 

চিকিৎসা সেন্টার সীমিত, সচেতন হতে হবে: সুচিকিৎসার পাশাপাশি আর্থ্রাইটিস সম্পর্কে সচেতন হওয়ার পরামর্শ দিয়েছেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক ডা. মো. শারফুদ্দিন আহমেদ। তিনি বলেন, সবাইকে সচেতন হতে হবে। শুরুতেই ভালো চিকিৎসা নিতে হবে। কারণ ব্যথার কষ্টে থাকা মানুষ কোনো কাজ করতে পারে না। ফলে এটি দেশের অর্থনীতির জন্যও ক্ষতিকর। একবার আক্রান্ত হলে আর্থ্রাইটিস থেকে পুরোপুরি মুক্তি পাওয়া কঠিন বলে জানান ডা. শারফুদ্দিন আহমেদ।

 

ভোরের আকাশ/নি 

মন্তব্য

Beta version