নিখিল মানখিন: নভেম্বরেও দেশের ডেঙ্গু পরিস্থিতির উন্নতির লক্ষণ দেখছেন না বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকরা। তারা বলছেন, অক্টোবরেও থাকবে ডেঙ্গুর দাপট। গত চার মাসের ডেঙ্গু পরিস্থিতি বিগত সময়ের সব পরিসংখ্যান পেছনে ফেলে নতুন রেকর্ড গড়েছে। স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় ও স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের পরিসংখ্যানেও একই চিত্র বেরিয়ে এসেছে। চলতি বছর জানুয়ারি থেকেই ডেঙ্গুজ্বরে আক্রান্ত ও মৃত্যুর ঘটনা শুরু হলেও বড় ধরনের আঘাত এসেছে জুলাই থেকে অক্টোবরে। যা এখনো অব্যাহত রয়েছে। চলতি বছর ডেঙ্গুতে মোট মৃত্যু ১৪১৭ জনের মধ্যে গত চার মাসেই (জুলাই-নভেম্বর) মারা গেছেন ১৩০১ জন। যা ডেঙ্গুতে মোট মৃত্যুর ৯১ শতাংশ।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তর জানায়, চলতি বছর ডেঙ্গুতে আক্রান্ত ও মৃতের সংখ্যা জানুযারিতে যথাক্রমে ৫৬৬ জন ও ৬ জন, ফেব্রুয়ারিতে ১৬৬ জন ও ৩ জন, মার্চে আক্রান্ত ১১১ জন, এপ্রিলে ১৪৩ জন ও ২ জন, মে মাসে ১০৩৬ জন ও ২ জন, জুনে ৫৯৫৬ জন ও ৩৪ জন, জুলাইয়ে ৪৩ হাজার ৮৫৪ জন ও ২০৪ জন, আগস্টে ৭১ হাজার ৫৯৮ জন ও ৩৯৬ জন, সেপ্টেম্বরে ৭৯ হাজার ৫৯৮ জন ও ৩৯৫ জন, অক্টোবরে ৬৭ হাজার ৭৬৯ জন ও ৩৫৯ জন এবং নভেম্বরের ছয়দিনে আক্রান্ত ১০ হাজার ৬২৩ জন ও মারা গেছেন ৬৯ জন।
বছরজুড়ে ডেঙ্গু: বছরজুড়ে থাকছে ডেঙ্গু আতঙ্ক। মৌসুম মানছে না ডেঙ্গুর প্রাদুর্ভাব। এতদিন জুন থেকে অক্টোবর পর্যন্ত পাঁচ মাস সময়কে ডেঙ্গুর মৌসুম বলে উল্লেখ করে আসছিলেন বিশেষজ্ঞরা। কিন্তু গত কয়েক বছর ধরে সারা বছরই ডেঙ্গুতে আক্রান্ত ও মৃত্যুর ঘটনা ঘটছে। বছরের প্রথম পাঁচ মাসে মোট আক্রান্ত সংখ্যার ভিত্তিতে ২০২২ সালের তুলনায় ২০২৩ সালের ডেঙ্গুতে মুত্যুহার ১৩ গুণ এবং আক্রান্ত বেড়েছে ৫ গুণ।
জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা বলছেন, গত ২০১৯ সালে দেশের ইতিহাসে সবচেয়ে ভয়াবহ রূপ নিয়ে হাজির হয়েছিল ডেঙ্গু। কিন্তু ২০১৯ সালে এক লাখের বেশি ডেঙ্গুজ্বরে আক্রান্ত হয়ে মারা যান ১৭৯ জন। আর ২০২২ সালে ৬২ হাজার ৩৮২ জনের বেশি আক্রান্ত হয়ে মারা যান ২৮০ জন।
অর্থাৎ ২০১৯ সালে আক্রান্তের তুলনায় মৃত্যুহার কম এবং ২০২২ সালে আক্রান্তের তুলনায় মৃত্যুর হার বেশি ছিল। আর ২০২৩ সালের প্রথম মাসেই উদ্বেগজনক ডেঙ্গু রোগী এবং মৃত্যুর ঘটনা যেন দেশের ডেঙ্গু পরিস্থিতির অবনতির আগাম বার্তা দিয়েছে। মোট আক্রান্তের বিবেচনায় ২০১৯ সালে মৃত্যুহার শূন্য দশমিক ১৭, ২০২২ সালে শূন্য দশমিক ৪৪ এবং ২০২৩ সালের গত পাঁচ মাসের পরিসংখ্যান অনুযায়ী ১ দশমিক ৪১ শতাংশ। গত পাঁচ মাসে ডেঙ্গুজ্বরে আক্রান্ত হয়ে মারা যাওয়ার হার গত ১৫ বছরের রেকর্ড ভেঙেছে।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তর জানায়, ২০২২ সালের জানুয়ারিতে ১২৬ জন, ফেব্রæয়ারিতে ২০ জন, মার্চে ২০ জন, এপ্রিলে ২৩ জন, মে মাসে ১৬৩ জন, জুনে ৭৩৭ জন, জুলাইয়ে ১,৫৭১ জন, আগস্টে ৩,৫২১ জন, সেপ্টেম্বরে ৯,৯১১ জন, অক্টোবরে ২১ হাজার ৯৩২ জন, নভেম্বরে ১৯ হাজার ৩৩৪ জন এবং ডিসেম্বরে ৫ হাজার ২৪ জন ডেঙ্গুজ্বরে আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন। আর ওই বছর পহেলা জানুয়ারি থেকে ৩১ ডিসেম্বর পর্যন্ত ডেঙ্গুতে মারা গেছেন মোট ২৮০ জন। তাদের মধ্যে জুনে ১ জন, জুলাইয়ে ৭ জন, আগস্টে ১১ জন, সেপ্টেম্বরে ৩৪ জন, অক্টোবরে ৮৬ জন, নভেম্বরে ১১৩ জন এবং ডিসেম্বরে মারা গেছেন ২৭ জন।
এভাবে আর ২০২১ সালে ডেঙ্গুজ্বরে আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছিলেন জানুয়ারিতে ৩২ জন, ফেব্রæয়ারিতে ৯ জন, মার্চে ১৩ জন, এপ্রিলে ৩ জন, মেতে ৪৩ জন, জুনে ২৭২ জন। ওই বছর জুলাইয়ে প্রথম ডেঙ্গু রোগীর মৃত্যু ঘটে। এভাবে ২০২১ সালে ডেঙ্গুতে আক্রান্ত ও মৃত্যু হয়েছে যথাক্রমে জুলাইয়ে ২ হাজার ২৮২ জন ও ১২ জন, আগস্টে ৭ হাজার ৬৯৬ জন ও ৩৪ জন, সেপ্টেম্বরে ৭ হাজার ৮৪১ জন ও ২৩ জন, অক্টোবরে ৫ হাজার ৪৫৮ জন ও ২২ , নভেম্বরে ৩ হাজার ৫৬৭ জন ও ৭ জন এবং ডিসেম্বরে ১ হাজার ২০৭ জন ও ৭ জন।
এভাবে আর ২০১৯ সালে ডেঙ্গুজ্বরে আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছিলেন জানুয়ারিতে ৩৮ জন, ফেব্রুয়ারি ১৮ জন, মার্চে ১৭ জন। ওই বছর ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে প্রথম মৃত্যুর ঘটনা ঘটে এপ্রিলে। এভাবে ২০১৯ সালে ডেঙ্গুতে আক্রান্ত ও মৃত্যু হয়েছেন যথাক্রমে এপ্রিলে ৫৮ জন ও ২ জন, মে মাসে আক্রান্ত ১৯৩ জন, জুনে ১৮৮৪ জন ও ৬ জন, জুলাইয়ে ১৬ হাজার ২৫৩ ও ৩৫ জন, আগস্টে ৫২ হাজার ৬৩৬ জন ও ৮৩ জন, সেপ্টেম্বরে ১৬ হাজার ৮৫৬ জন ও ২৫ জন, অক্টোবরে ৮ হাজার ১৪৩ জন ও ১১, নভেম্বরে ৪ হাজার ১১ জন ও ২ জন এবং ডিসেম্বরে আক্রান্ত হয়েছেন ১ হাজার ২৪৭। তবে বেসরকারি পরিসংখ্যানে প্রকৃত ডেঙ্গু আক্রান্তের সংখ্যা আরো বেশি হবে বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা।
স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালেক বলেন, ডেঙ্গু রোগীর সংখ্যা এবার ৫ গুণ। ডেঙ্গু রোগীর সংখ্যা বাড়ায় যথেষ্ট ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে। হাসপাতাল যাতে প্রস্তুত থাকে, চিকিৎসক এবং নার্সদের প্রশিক্ষণ দেয়া হবে। হাসপাতালে করোনা এবং ডেঙ্গুর জন্য আলাদা ব্যবস্থা রাখা হয়েছে। এরই মধ্যে আড়াই হাজার নার্স-ডাক্তারকে প্রশিক্ষণ দেয়া হয়েছে।
ডেঙ্গু রোগ বিশেষজ্ঞ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের মেডিসিন অনুষদের সাবেক ডিন ও প্রধানমন্ত্রীর ব্যক্তিগত চিকিৎসক অধ্যাপক ডা. এবিএম আব্দুল্লাহ ভোরের আকাশকে বলেন, সারা বছরই ডেঙ্গুর প্রাদুর্ভাব দেখা যাচ্ছে। এ বছর জানুয়ারিতেই রেকর্ড সংখ্যক ডেঙ্গু রোগী শনাক্ত হওয়ার পাশাপাশি ডেঙ্গু রোগীর মৃত্যু ঘটেছে। বিষয়টি সতর্কবার্তা হিসেবেই নিতে হবে। ডেঙ্গুর মৌসুম এখনো শুরু হয়নি। সাধারণত জুলাই থেকে অক্টোবর পর্যন্ত ডেঙ্গুর প্রাদুর্ভাব বেশি হয়ে থাকে। গত পাঁচ মাসের অবনতির ধারা অব্যাহত থাকলে পিক মৌসুমে ডেঙ্গু পরিস্থিতি ভয়াবহ হওয়ার শঙ্কা উড়িয়ে দেয়া যায় না।
তিনি আরো বলেন, যারা এবার আক্রান্ত বা মারা যাচ্ছেন তারা আগে যেকোনো সময় ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়েছেন। প্রথমবার ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হলে অবস্থা সিভিয়ার হয় না। জ্বর বা সাধারণ কিছু সমস্যায় কাটিয়ে তারা সুস্থ হয়ে যান। কিন্তু দ্বিতীয়, তৃতীয় বা চতুর্থবার হলে রোগীর অবস্থা সিভিয়ার হয়। এবার তাইই ঘটছে। ফলে আক্রান্ত ও মৃত্যুর সংখ্যা বেশি। বিশেষ করে শিশু ও বয়স্ক ব্যক্তিরা, যাদের কোমরবিডিটি রয়েছে। এসব কারণেই হাসপাতালে চিকিৎসাধীন ডেঙ্গু রোগীর সংখ্যা কমছে না বলে জানান অধ্যাপক এবিএম আব্দুল্লাহ।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের সংক্রামণ রোগ নিয়ন্ত্রণ শাখার (সিডিসি) সাবেক পরিচালক অধ্যাপক ডা. বে-নজির আহমেদ ঢাকা ভোরের আকাশকে বলেন, এ বছর আক্রান্ত ও মৃত্যু সংখ্যা বিবেচনায় ইতোমধ্যে আগের সব ক’টি রেকর্ড ভেঙেছে। হাসপাতালে ভর্তি হওয়া রোগী সংখ্যার ভিত্তিতেই ডেঙ্গু আক্রান্তের সংখ্যা হিসাব করছে অধিদপ্তর। হাসপাতালে যেতে হয় না এমন ডেঙ্গু রোগীর সংখ্যা তো রয়েই গেছে।
তিনি আরো বলেন, এবার ডেঙ্গু রোগীদের হাসপাতালে ভর্তি হওয়ার চিত্র বেশ লক্ষণীয়। শারীরিক অবস্থার অবনিত ঘটলেই চিকিৎসক ও হাসপাতালের শরণাপন্ন হচ্ছেন রোগীরা। প্রতিদিনই বড় সংখ্যার রোগী ভর্তি হচ্ছে। হাসপাতাল থেকে ছাড়পত্র প্রাপ্ত রোগীর সংখ্যা কম। ফলে চিকিৎসাধীন রোগীর সংখ্যা কমছে না।
তিনি বলেন, ডেঙ্গু হলেই রোগীর হাসপাতালে যাওয়া উচিত। হাসপাতালে রোগীর পিসিভি, প্লাটিলেটসহ সব শারীরিক অবস্থা পরীক্ষা করবে। প্রয়োজনে ডে কেয়ার সার্ভিস দেবে। এরপর শারীরিক অবস্থা দেখে হাসপাতালে ভর্তি নেবে নাকি বাসায় থাকবে সে সিদ্ধান্ত নেবে। কিন্তু এটি যদি আমরা রোগীর ওপর ছেড়ে দিই, তাহলে অবস্থার অবনতি হবে। রোগী তার প্রকৃত অবস্থা বুঝতে পারবে না।
যেমন, ডায়রিয়া ডেঙ্গুর একটি লক্ষণ। যা রোগীদের একটা বড় অংশই জানে না। কিন্তু সে ডায়রিয়া হয়ে শকে চলে যেতে পারে। তাই এই দ্বৈত অবস্থা তৈরি না করে ডেঙ্গু হলেই রোগীকে হাসপাতালে সেবা দেয়ার ব্যবস্থা করা হোক। ডিএনসিসি হাসপাতালের মতো ফিল্ড হাসপাতাল চালু করা হোক। প্রয়োজনে চিকিৎসক-নার্স বাড়িয়ে দেয়া হোক, যেন তারা সমানভাবে প্রত্যেককে গুরুত্ব দিতে পারেন।
ভোরের আকাশ/নি
মন্তব্য