আতিয়া রহমান ও ডা. শামীম হায়দার তালুকদার: মানুষ বেঁচে থাকার জন্য খাবার গ্রহণ করে। বেঁচে থাকার জন্য যে খাবার গ্রহণ করা হয় তা অবশ্যই পুষ্টিকর হতে হবে। বিভিন্ন বয়সে খাদ্যাভাস বিভিন্নরকম হয়ে থাকে। বয়স অনুযায়ী চাহিদাও ভিন্ন থাকে। খাদ্যাভাসের ভিন্নতা নির্ভর করে থাকে কর্মব্যস্ততা, দৈহিক পরিশ্রম, ওজন, উচ্চতা ইত্যাদির ওপর কিন্তু বেশিরভাগ মানুষ তাদের চাহিদা অনুযায়ী পুষ্টিকর খাদ্য নিশ্চিত করতে পারে না। যেকোনো বয়সে ভালো পুষ্টির অবস্থা বজায় রাখা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। বিশেষ করে বার্ধ্যকের কারণে পুষ্টি অবস্থা ঠিক রাখা কঠিন হয়ে পড়ে। তাদের জন্য জেরিয়াট্রিক পুষ্টি যা বার্ধক্য এবং রোগের প্রভাব কমাতে সাহায্য করে সেইসাথে এটি প্রবীণ জনসংখ্যার শারীরিক, মনস্তাত্ত্বিক এবং মনোসামাজিক অবস্থাগুলো পরিচালনা করতে সহায়তা করে। প্রবীণ জনসংখ্যাকে সংজ্ঞায়িত করা যেতে পারে যাদের বয়স ৬৫ বছরের বেশি। প্রবীণদের দুভাবে শ্রেণিবদ্ধ করা যেতে পারে যেমন : প্রারম্ভিক প্রবীণ (৬৫ থেকে ৭৪ বছর বয়সের মধ্যে) এবং প্রয়াত প্রবীণ (৭৫ বছরের বেশি বয়সের)। উন্নয়নশীল দেশগুলোতে, প্রবীণ জনসংখ্যার পুষ্টির অবস্থা মূল্যায়ন করার জন্য আরও গবেষণা করা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। সম্প্রদায়ের সচেতনতা এবং হস্তক্ষেপের জন্য প্রবীণ জনসংখ্যার জন্য আন্তর্জাতিক খাদ্যতালিকা নির্দেশিকা প্রয়োজন। এটি ভবিষ্যদ্বাণী করা হয়েছে যে, ২০০০ থেকে ২০৩০ পর্যন্ত বিশ্বের জনসংখ্যার প্রায় ৫৫০-৯৩০ মিলিয়নের জনসংখ্যার বয়স ৬০ বছরের বেশি হতে পারে। বাংলাদেশে যাদের বয়স ৬০ বছর বা তার বেশি তাদের প্রবীণ ব্যক্তি হিসেবে বিবেচনা করা হয়। জনসংখ্যার বার্ধক্য এখন একটি বৈশ্বিক সমস্যা এবং এটি বাংলাদেশের একটি উদীয়মান সমস্যা। এটা স্পষ্ট যে, বাংলাদেশে ৬০ বছর বা তার বেশি বয়সী প্রবীণ মানুষের সংখ্যা ২০০৭ সালে প্রায় ৯.৪১ মিলিয়ন ছিল এবং ১৯৫১ সালে বাংলাদেশে প্রবীণদের এই ক্রমবর্ধমান প্রবণতা শুরু হয়েছিল। সারা বিশ্বে, বিশটি দেশে সবচেয়ে বেশি প্রবীণ জনসংখ্যা রয়েছে এবং বাংলাদেশ তাদের মধ্যে একটি।
গবেষকরা বলেছেন, যে বাংলাদেশে ২০২৫ সালের মধ্যে প্রবীণ জনসংখ্যার ৪৪ ভাগ অর্জন করবে। বাংলাদেশের ১৬০ মিলিয়ন জনসংখ্যার মধ্যে, ৬০ বছরের বেশি বয়সী জনসংখ্যা ৭ ভাগ এবং এটি ২০৫০ সালের মধ্যে ১৬ ভাগ বৃদ্ধি পাবে। এশীয় দেশগুলোতে পুরুষ প্রবীণ জনসংখ্যার তুলনায় মহিলা প্রবীণ জনসংখ্যা বেশি এবং তারা অপুষ্টির শিকার। কিন্তু সামগ্রিকভাবে, উভয় গ্রুপই অপুষ্টির জন্য অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ চরম দারিদ্র্যের কারণে বাংলাদেশের বেশিরভাগ প্রবীণ মানুষ তাদের পুষ্টির চাহিদা মেটাতে অক্ষম এবং এটি শহর ও গ্রাম উভয় এলাকায় বসবাসকারী দরিদ্র পরিবারের একটি সাধারণ দৃশ্য। দারিদ্র্য, মজুরি বৈষম্য, প্রয়োজনীয় জিনিসপত্রের অভাব, আশ্রয় এবং বয়সসীমা পূর্ণ হলে চাকরি থেকে বাধ্যতামূলক অবসরের কারণে বাংলাদেশের অধিকসংখ্যক প্রবীণ লোকের আর্থ-সামাজিক অবস্থা খুবই খারাপ হয়ে থাকে। প্রবীণ ব্যক্তিদের পুষ্টির অবস্থা এবং খাদ্য গ্রহণের ধরন বিভিন্ন পরিবর্তন যেমন শারীরিক, মানসিক, সামাজিক বা স্বাস্থ্য-সম্পর্কিত পরিবর্তন দ্বারা প্রভাবিত হতে পারে। এই পরিবর্তনগুলো সত্ত্বেও, সঠিক পুষ্টি এবং একটি স্বাস্থ্যকর জীবনধারা শুধু প্রবীণ জনগোষ্ঠীর মধ্যে পুষ্টির অবস্থা এবং জীবনযাত্রার মান উন্নত করতে পারে। বেশ কয়েকটি গবেষণায় দেখা গেছে, প্রবীণ ব্যক্তিদের সাথে যুক্ত কিছু চিকিৎসা জটিলতা পাওয়া গেছে।
প্রবীণ ব্যক্তিদের কার্যকরভাবে সচল থাকার জন্য, ভালো ও পুষ্টিকর খাবার অপরিহার্য। বার্ধক্যে একজন ব্যক্তির স্বাস্থ্য সমস্যাগুলো দুর্বল পুষ্টির অবস্থা প্রকাশ করে। বয়স, লিঙ্গ, স্বাস্থ্য বা পুষ্টি অবস্থাই শারীরিক কার্যকারিতাকে সরাসরি প্রভাবিত করে। অ্যানোরেক্সিয়া এবং ক্যাচেক্সিয়া প্রায়ই সম্পর্কিত শব্দ আর ক্যাচেক্সিয়া হলো এক ধরনের রোগ যা ক্যাটাবলিজম প্রক্রিয়াকে উত্তেজিত করে প্রোটিন এবং শক্তি সঞ্চয়কে হ্রাস করে। পেশির শক্তি হ্রাস হলে সেটা সারকোপেনিয়া নামে পরিচিত এবং এর ফলে শারীরিক ক্রিয়াকলাপের সীমাবদ্ধতা নিয়ে আসে যা ক্যাচেক্সিয়া এবং অ্যানোরেক্সিয়া দ্বারা সৃষ্ট হয়। অনাহারের ফলে সারকোপেনিয়া আরও খারাপ হতে পারে। সাধারণ কাজগুলো যেমন সিঁড়ি বেয়ে হাঁটা বা চেয়ার থেকে উঠার ক্ষমতা ইত্যাদি কমে আসে। শারীরিক দুর্বলতা আর স্বাভাবিক কর্মক্ষমতা কমে যাওয়ার কারণে হাড় ভাঙার সম্ভাবনা থাকে। অনেক নিম্ন আয়ের দেশগুলোর বিপরীতে, যেখানে দরিদ্র পুষ্টির অবস্থা প্রায়ই দারিদ্র্যের সাথে যুক্ত থাকে, এই দৃশ্যটি অস্বাভাবিক এবং ব্যক্তিকে পর্যাপ্ত পুষ্টি পেতে বাধা দেয়। পর্যাপ্ত শারীরিক কার্যকারিতা রক্ষা করার জন্য প্রবীণ ব্যক্তিদের জন্য পুষ্টি অবস্থা ভালো থাকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
বাংলাদেশে পুষ্টি বিষয়ে সচেতনতার জন্য সরকার, সরকারি-বেসরকারি সংস্থা ইত্যাদি বিভিন্ন রকম সচেতনতামূলক প্রোগ্রামের আয়োজন করে থাকে। স্বাস্থ্য শিক্ষা ব্যুরো, স্বাস্থ্য অধিদপ্তর, স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয় মিলে প্রবীণদের স্বাস্থ্যের বিশেষ যত্ন নেয়ার জন্য পুষ্টি এবং স্বাস্থ্য সচেতনতামূলক কার্যক্রম করে থাকে। সরকারি সহায়তায় আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলো কাজ করে থাকে। পুষ্টি পরিস্থিতি বিবেচনা করে স্বাস্থ্য নীতি, পুষ্টি নীতি ইত্যাদি পরিবর্তন বা নতুন নীতি তৈরি করা হচ্ছে। বার্ধ্যকের জন্য যে শারীরিক সমস্যা হয়ে থাকে তা কী ধরনের খাবার খেলে বা কী পরিমাণে খেলে প্রয়োজনীয় পুষ্টি চাহিদা পূরণ হবে এসব বিষয়ে শিক্ষা দেয়ার ব্যবস্থা করা উচিত। আয়ু বৃদ্ধির সাথে সাথে প্রবীণ জনসংখ্যা বৃদ্ধি পাচ্ছে। দেশে প্রবীণদের পুষ্টির ওপর ভিত্তি করে স্বাস্থ্য, পুষ্টি এবং নিরাপত্তা কর্মসূচি করা উচিত। পুষ্টি নির্দেশিকা পরিবর্তন করা এবং পুষ্টি তথ্য, যোগাযোগ এবং প্রচারের জন্য শিক্ষা উপকরণ এগুলো উন্নয়ন করা। পুষ্টি শিক্ষা বা পরামর্শের জন্য মিডিয়া বিশেষ ভূমিকা রাখে। বিভিন্ন ধরনের ইলেকট্রনিক বিজ্ঞাপন, অ্যানিমেশন জাতীয় ভিডিও, সোশ্যাল মিডিয়া ইত্যাদি জায়গায় কাজ করা যেতে পারে। ৪র্থ স্বাস্থ্য জনসংখ্যা ও পুষ্টি সেক্টর কর্মসূচিতে সরকারের কিছু কার্যক্রম উল্লেখযোগ্য তা হলো : পুষ্টি সচেতনতা বৃদ্ধির কর্মসূচি, খাদ্যতালিকা সংক্রান্ত নির্দেশিকা প্রচার, ক্যালসিয়াম এবং ভিটামিন-ডি সম্পূরক, জেরিয়াট্রিক পুষ্টি কৌশল উন্নয়ন এবং অভিযোজন, ক্যালসিয়াম এবং ভিটামিন-ডি ওষুধ বিতরণ করার ইত্যাদি করা হয়েছে। পুষ্টিবিদগণদের ভাষ্য মতে, আমাদের দেশে যেহেতু দারিদ্র্যের সংখ্যা বেশি যার কারণে তারা নিজেদের পুষ্টি চাহিদা পূরণ করতে পারে না। সেহেতু সরকারের উচিত সরকারি হাসপাতালগুলোতে ভর্তি রোগীর পাশাপাশি বহির্বিভাগে আসা রোগীদের পুষ্টি পরামর্শ দেয়া যেতে পারে। এই পরামর্শ গ্রহণের মাধ্যমে আমাদের দেশের সব বয়সের মানুষ এবং বিভিন্ন রোগে আক্রান্ত ব্যক্তিকে তাদের পুষ্টি চাহিদা সম্পর্কে জানতে পারবে আর পুষ্টিকর খাদ্য গ্রহণে উৎসাহ দিতে পারবে। পুষ্টিনীতি, কর্মসূচি, পুষ্টি পরামর্শ ইত্যাদি প্রদান করার পাশাপাশি খাদ্য নিরাপত্তা দিতে হবে। একমাত্র নিরাপদ খাদ্য নিশ্চয়তা পরিপূর্ণ পুষ্টি নিশ্চয়তা দিতে পারে। তাহলে বার্ধ্যকের পুষ্টি সমস্যার পাশাপাশি দেশের অপুষ্টির সমস্যা সমাধান করতে পারবে।
লেখক
আতিয়া রহমান (সহকারী গবেষক)এমিনেন্স এসোসিয়েটস ফর সোশ্যাল ডেভেলোপমেন্ট
ডা. শামীম হায়দার তালুকদার (প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা)এমিনেন্স এসোসিয়েটস ফর সোশ্যাল ডেভেলোপমেন্ট
ভোরের আকাশ/আসা
মন্তব্য