-->

ডেঙ্গুর দাপট আরও দুই মাস

শিপংকর শীল
ডেঙ্গুর দাপট আরও দুই মাস

এডিস মশাবাহিত ডেঙ্গু জ্বর এখন আর শুধু বর্ষা মৌসুমের রোগ নয়। ধরন বদলে বছরজুড়ে দাপট দেখাচ্ছে এই ভাইরাস। এমনকি শীতেও প্রকোপ দেখা যায় রোগটির। আগে রাজধানী ঢাকায় বেশি দেখা দিলেও এখন ছড়িয়ে পড়েছে বিভাগীয় শহরগুলোতেও। জানুয়ারি থেকেই ডেঙ্গুজ্বরে আক্রান্ত ও মৃত্যুর ঘটনা শুরু হলেও বড় ধরনের আঘাত এসেছে আগস্ট, সেপ্টেম্বর ও অক্টোবরে। মৃত্যুহার বেশি হওয়ায় ডেঙ্গু রোগীদের মধ্যে বেড়েছে আতঙ্ক। ডেঙ্গু রোগী সামাল দিতে হিমশিম খাচ্ছে সরকারি হাসপাতাল। ডেঙ্গু প্রতিরোধ কর্মসূচিও প্রশ্নবিদ্ধ হয়ে পড়েছে। যদিও সংশ্লিষ্টরা দায় এড়ানোর চেষ্টা করছেন। এ বছর ডেঙ্গুতে তৃতীয় সর্বোচ্চ মৃত্যু হয়েছে। চলতি অক্টোবর মাসে দিনে মারা গেছে চারজন।

বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকরা বলছেন, দেশে ডেঙ্গু পরিস্থিতির অবনতি অব্যাহত রয়েছে। আক্রান্তের স্বল্প সময়ের মধ্যে মৃত্যুর ঘটনায় ডেঙ্গু রোগীর মধ্যে বিরাজ করছে মৃত্যু আতঙ্ক। গ্রামাঞ্চলের যেখানে সেখানে এডিস মশার লার্ভা পাওয়ার ঘটনা যেন আতঙ্কের মাত্রা বাড়িয়ে দিয়েছে। গ্রামাঞ্চলে লার্ভা ধ্বংস করার নির্দিষ্ট কোনো কাঠামো ও কর্তৃপক্ষ নেই। উপসর্গহীন ডেঙ্গু রোগীও পাওয়া যাচ্ছে। হঠাৎ করে প্লাটিলেট নেমে গেলেই কান্নাকাটি শুরু করে দিচ্ছেন রোগীর স্বজনরা। চিকিৎসকদের বোঝানোর পরও নিরাপদ মনে করছেন না অনেকে। সরকারি হাসপাতালে সিট না পেয়ে আতঙ্কে বেসরকারি হাসপাতালে ছুটছেন অনেক রোগী। তাদের অনেকে অসাধু চক্রের খপ্পরে পড়ে নিঃস্ব হয়ে যাচ্ছেন। অপ্রয়োজনীয় আইসিইউতে রেখে টাকা হাঁটিয়ে নেয়ার অভিযোগও উঠছে। জীবন বাঁচানোর আশায় সব মেনে নিচ্ছেন রোগীর স্বজনরা।

কীটতত্ত্ববিদ ও জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক ড. কবিরুল বাশার ভোরের আকাশকে বলেন, এ বছর বাংলাদেশে ডেঙ্গু পরিস্থিতি অন্য বছরের মতো নয়। সাধারণত প্রতি বছর নভেম্বর ও ডিসেম্বর মাসে ডেঙ্গুর প্রভাব একেবারেই কমে যায়। কিন্তু এবার তার ব্যতিক্রম ঘটছে। আগামী দুই মাসও ডেঙ্গুর প্রকোপ অনেক বেশি থাকবে। এমনকি জানুয়ারি মাস পর্যন্ত এর প্রভাব থাকবে।

তিনি জানান, তাদের একটি গবেষণা দল মাঠ পর্যায়ে এডিস মশার ঘনত্ব নিয়ে কাজ করেছে। সেখানে প্রায় প্রতিটি এলাকায় এডিস মশার ঘনত্ব ২০ এর ওপরে রয়েছে। কোথাও এমনটা দেখা দিলে ধরে নেয়া হয়, সেই এলাকায় এডিস মশাবাহিত রোগ বিশেষ করে ডেঙ্গু ও চিকনগুনিয়া হওয়ার একটি সম্ভাবনা রয়েছে।

এই কীটতত্ত্ববিদ বলেন, ‘জলবায়ু পরিবর্তন এবং সম্প্রতি সাগরে সৃষ্ট ঘূর্ণিঝড় দানার প্রভাবে দেশের বিভিন্ন স্থানে বৃষ্টি হয়েছে। সেই বৃষ্টির পানি বিভিন্ন ছোট-বড় পাত্রে কিংবা গর্তে আবারও পানি জমেছে। ফলে এসব পানিতে মা মশাগুলো ডিম পাড়বে। সেখান থেকেই এডিস মশার বিস্তার ঘটবে।’

ড. কবিরুল বাশার মনে করছেন, সমাজে যেহেতু এখনও ডেঙ্গু রোগী রয়েছে এবং এডিস মশার প্রজননেরও সময়টা বাড়ছে, এ কারণে এ বছর ডেঙ্গুর প্রকোপ আরও দীর্ঘ সময় বাংলাদেশে থাকবে।

দায় এড়ানোর চেষ্টা সংশ্লিষ্টদের: ডেঙ্গু পরিস্থিতি মোকাবেলায় অনেকটা অপারগতা প্রকাশ করেছে দায়িত্বপ্রাপ্ত প্রতিষ্ঠান ও ব্যক্তিরা! এমন প্রশ্ন ও ক্ষোভ আজ মানুষের মনে। অসহায় হয়ে পড়েছেন ডেঙ্গু রোগী ও তাদের স্বজনেরা। জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা বলছেন, চলতি বছরের শুরু থেকেই খারাপ পরিস্থিতির ইঙ্গিত পাওয়া গিয়েছিল। কিন্তু গুরুত্ব না দেয়ার কারণে ভয়াবহ রূপ নিয়েছে। মশক নিধনের ব্যর্থতার দায় কেউ নিচ্ছে না। জনসচেতনতা এখন ডেঙ্গু মোকাবিলার মূল হাতিয়ার বলে বক্তব্য দিয়ে যাচ্ছেন দায়িত্বপ্রাপ্ত প্রতিষ্ঠানের কর্তা ব্যক্তিরা। অথচ মশক নিধনসহ ডেঙ্গু মোকাবিলায় ইতোমধ্যে খরচ হয়ে গেছে কোটি কোটি টাকা।

ডেঙ্গু রোগের বাহক এডিস মশার বংশ বিস্তারের তিন স্তর হলো— লার্ভা, বাড়ন্ত ও উড়ন্ত। লার্ভা ধ্বংসে সফলতা দেখাতে পারছেন না দায়িত্বপ্রাপ্তরা। সীমিত সংখ্যক বাসাবাড়িতে অভিযান চালিয়ে জরিমানা আদায় করে লার্ভা নিয়ন্ত্রণে আনা যাবে না। ডেঙ্গু মোকাবিলায় বাড়াতে হবে জনসম্পৃক্ততা। সিটি করপোরেশনের মশক নিধন বিভাগের পাশাপাশি প্রত্যেক ওয়ার্ড কাউন্সিলরসহ এলাকার গণমান্য ব্যক্তিদের কর্মসূচিতে সম্পৃক্ত করতে হবে।

মশক নিধনের বিকল্প নেই: বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের মেডিসিন অনুষদের সাবেক ডিন ইমিরেটাস অধ্যাপক ডা. এ বি এম আবদুল্লাহ ভোরের আকাশকে বলেন, ‘আমাদের মশা মারার কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে। কিন্তু মশা মারার সঠিক পদ্ধতি ও ব্যবস্থাপনা এখনো গ্রহণ করা হয়নি। বৈজ্ঞানিক ও কারিগরি পদ্ধতি প্রয়োগ করে ধাপে ধাপে মশা নিয়ন্ত্রণ করতে হবে। কারণ এখনই হাসপাতালগুলোতে রোগী বাড়ছে। এই অবস্থা চলতে থাকলে সামনে বিপদ। তাই রোগী যাতে আর না বাড়ে সেজন্য পদক্ষেপ নিতে হবে। মশার নিয়ন্ত্রণ ছাড়া এটার সমাধান সম্ভব না। ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হওয়ার পর অন্যান্য রোগব্যাধিতেও আক্রান্ত হচ্ছেন অনেকে। যে কারণে মৃত্যুর সংখ্যা বাড়ছে।’

কীটতত্ত্ববিদ অধ্যাপক ড. মো. গোলাম সারোয়ার বলেন, শত্রুর সঙ্গে তো আপনি ভোঁতা অস্ত্র দিয়ে লড়াই করতে পারবেন না। আবার এই লড়াইয়ের জন্য আপনার পর্যাপ্ত সামরিক জ্ঞান থাকতে হবে। তা না হলে আপনার গুলি শত্রুর গায়ে না লেগে নিজের গায়েও লাগতে পারে। আমরা তো শত্রু চিনি— এডিস মশা। কিন্তু দেশে মশা মারার সঠিক ব্যবস্থাপনা তো নেই। ওষুধের প্রয়োগ, সঠিক সময় ও প্রশিক্ষিত জনবল— এই তিনটি ব্যবস্থা বৈজ্ঞানিক ও কারিগরি ব্যবস্থাপনায় থাকতে হবে। কিন্তু আমরা কী সেটা করতে পারছি? ফলে যা হওয়ার তাই হচ্ছে, ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাচ্ছে।

পরিস্থিতি কেন নিয়ন্ত্রণ করা যাচ্ছে না— এমন প্রশ্নে জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ ডা. বেনজীর আহমেদ বলেন, এই মৃত্যুর দুটি দিক আছে। একটি ভাইরাস এবং অপরটি মশা। প্রথমত এই ভাইরাসের অন্তত পাঁচটি ভ্যারিয়েন্ট আছে। কেউ যদি একবার কোন একটি ভ্যারিয়েন্টে আক্রান্ত হন, তাহলে তার শরীরে শুধু ওই ভ্যারিয়েন্টের ইমিউনিটি তৈরি হয়। কিন্তু অন্য ভাইরাসে আক্রান্ত হলে অবস্থা আরও খারাপের দিকে যাচ্ছে।

স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, চলতি বছর ১ জানুয়ারি থেকে ২৭ অক্টোবর পর্যন্ত ডেঙ্গু সংক্রমণে মারা গেছেন ২৭৭ জন। এখন পর্যন্ত একক বছরে মৃত্যুর সংখ্যা বিচারে এটা তৃতীয় সর্বোচ্চ। এ বছর জানুয়ারি থেকে এখন পর্যন্ত সবমিলিয়ে ৫৬ হাজার ৯১১ ডেঙ্গু রোগী হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন।

চলতি বছর সর্বোচ্চ আক্রান্ত ও মৃত্যু দেখা যাচ্ছে অক্টোবরে। অক্টোবরের প্রথম ২৭ দিনেই মারা গেছেন ১১৪ জন। এর আগের মাস সেপ্টেম্বরে ৮০ জনের মৃত্যু হয়েছে। এছাড়া আগস্টে ২৭ জন, জুলাইয়ে ১২ জন, জুনে ৮ জন, মে মাসে ১২ জন, এপ্রিলে ২ জন, মার্চে ৫ জন, ফেব্রুয়ারিতে ৩ জন, জানুয়ারিতে ১৪ জন মারা যান।

বাংলাদেশের ইতিহাসে ডেঙ্গুতে সর্বোচ্চ সংক্রমণ ও মৃত্যু হয় ২০২৩ সালে। ওই বছর ৩ লাখ ২১ হাজার ১৭৯ মানুষ ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হন। মৃত্যু হয় ১ হাজার ৭০৫ জনের। গত বছরের সেপ্টেম্বরে এক মাসে ডেঙ্গুতে সবচেয়ে বেশি ৩৯৬ জনের মৃত্যু হয়। ওই সময় ডেঙ্গু নিয়ে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছিলেন ৭৯ হাজার ৫৯৮ জন। সেপ্টেম্বরে মারা যান ৮০ জন।

 

ভোরের আকাশ/রন

মন্তব্য

Beta version