সারাদেশে ব্যাঙের ছাতার মতো গড়ে উঠেছে হাসপাতাল ও ক্লিনিক। নেই নিবন্ধন, সেবা নিম্নমানের। ভাড়াটে চিকিৎসক ও টেকনিশিয়ান দিয়ে চলে কার্যক্রম। সেবা ও রোগী মৃত্যুর ঘটনা নিয়ে অভিযোগের শেষ নেই। নিজেদের তৈরি নিয়মে চলে সব কিছু। রোগী মৃত্যুর পর স্বাস্থ্য বিভাগ শুরু করে অভিযানের খেলা।
চিকিৎসা বিশেষজ্ঞরা বলছেন, নিবন্ধনহীন এমন অবৈধ হাসপাতাল, ক্লিনিক ও ডায়াগনস্টিক সেন্টার নির্মূল অভিযান নিয়ে বছরের পর ধরে চলছে হাস্যকর খেলা। রোগী মারা গেলে বা অপ্রীতিকর ঘটনা ঘটলেই অভিযানের বিষয়টি আলোচনায় আসে। ঢাকঢোল পিটিয়ে শুরু হয় অভিযান। লোক দেখানো অভিযানের কয়েকদিন পরই তা চলে যায় আলোচনার বাইরে। দেশের বিশেষ পরিস্থিতির সুযোগে এমন চিকিৎসা প্রতিষ্ঠানের মালিকদের অবৈধ ব্যবস্থা বেশ জমে উঠেছে।
অভিযোগ উঠেছে, অবৈধ হাসপাতাল, ক্লিনিক ও ডায়াগনস্টিক সেন্টারের বিরুদ্ধে অভিযান নিয়ে চলছে লুকোচুরি! ঘোষণা দিয়ে অভিযানে নেমে সফলতা পাচ্ছে না স্বাস্থ্য অধিদপ্তর। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ঘোষণা দিয়ে কয়েকদিনের অভিযানে অবৈধ ও অনিবন্ধিত চিকিৎসা প্রতিষ্ঠানগুলোর কার্যক্রম থামানো যাবে না। থানা থেকে বিভাগীয় পর্যায় পর্যন্ত নিয়মিত অভিযান চালাতে হবে। বন্ধ করে দেয়া অবৈধ প্রতিষ্ঠান আবার চালু করা হয়েছে কিনা, তা মনিটরিং করতে হবে। অনেক ক্ষেত্রে প্রশাসন ও প্রভাবশালীদের যোগসাজশে অবৈধ প্রতিষ্ঠানগুলো দেদার ব্যবসা চালিয়ে যাচ্ছে বলে জানিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের অভিযান এবং পরবর্তী অবস্থা বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, সরকারি নির্দেশনা মানছেন না অনিবন্ধিত চিকিৎসা প্রতিষ্ঠানের মালিকরা। ২০২২ সালের গত আগস্ট ও সেপ্টেম্বরে ঢাকঢোল পিটিয়ে অবৈধ হাসপাতাল, ক্লিনিক ও ডায়াগনস্টিক সেন্টারের বিরুদ্ধে কয়েক দফা অভিযানে নামে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর। কিন্তু বিগত বছরগুলোর অভিযানের মতোই এবারো তেমন সফলতা আসেনি। অভিযানে বন্ধ করে দেয়া চিকিৎসা প্রতিষ্ঠানগুলোর পূর্ণাঙ্গ তালিকা পর্যন্ত প্রকাশ করতে পারেনি স্বাস্থ্য অধিদপ্তর। অবৈধ চিকিৎসা প্রতিষ্ঠান বন্ধ করতে কঠোর নির্দেশনা বহুবার দিয়েছে অধিদপ্তর। কিন্তু তাদের গৃহীত সিদ্ধান্তগুলো বাস্তবায়নে হতাশ হয়েছে দেশবাসী। নির্দেশনা দিয়েই দায়িত্ব শেষ করেন সংশ্লিষ্টরা। ২০২২ সালের পর কয়েকটি উদ্যোগ নিয়েও ব্যর্থ হয়েছে সরকার। এভাবে বছরের পর বছর ধরে অনিবন্ধিত অসংখ্য চিকিৎসা প্রতিষ্ঠান মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে থাকে। তাই স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের এমন নির্দেশনার ওপর দেশবাসী আস্থা রাখতে পারছে না বলে আশঙ্কা প্রকাশ করেন বিশেষজ্ঞরা।
২০২৩ সালের ৩০ ডিসেম্বর রাজধানীর বাড্ডার ইউনাইটেড মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে খতনা করাতে গিয়ে মারা যায় শিশু আয়ান আহমেদ। এ ঘটনার পর হাইকোর্টের নির্দেশে অবৈধ হাসপাতালের একটি তালিকা আদালতে জমা দেয় স্বাস্থ্য অধিদপ্তর। সেই তালিকায় নাম রয়েছে ১ হাজার ২৭টি প্রতিষ্ঠানের। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের অন্য এক তালিকায় দেখা গেছে, ঢাকা বিভাগে অবৈধ হাসপাতাল ও ক্লিনিক রয়েছে ২০৬টি, ময়মনসিংহ বিভাগে ২৬৩টি, বরিশাল বিভাগে ১৬২টি, রাজশাহী বিভাগে ৮৬টি, সিলেট বিভাগে ১৮টি, রংপুর বিভাগে ১২৭টি, চট্টগ্রাম বিভাগে ১৯৪টি এবং খুলনা বিভাগে ১১৬টি।
২০২৪ সালের ২০ ফেব্রুয়ারি রাজধানীর মালিবাগ চৌধুরীপাড়ার জেএস ডায়াগনস্টিক সেন্টারে খতনা করাতে গিয়ে মারা যায় ১০ বছর বয়সী শিশু আহনাফ তাহমিন আয়হাম। ২১ ফেব্রুয়ারি স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের পরিদর্শন দল গিয়ে দেখতে পায় ডায়াগনস্টিকের লাইসেন্স নিয়ে হাসপাতাল কার্যক্রম পরিচালনা করে আসছিল প্রতিষ্ঠানটি। এমনকি তারা কখনো হাসপাতালের নিবন্ধনের জন্য আবেদনই করেনি। সেদিনই ডায়াগনস্টিক সেন্টারটি বন্ধ করে দেয় স্বাস্থ্য অধিদপ্তর। বাড্ডার ইউনাইটেড মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে আয়ানের মৃত্যু ও মালিবাগের ওই ডায়াগনস্টিক সেন্টারে শিশু আয়হামের মৃত্যুর ঘটনা বেশ নাড়া দিয়েছে।
চলতি বছরের ৬ ফেব্রুয়ারি স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের জারি করা নির্দেশে নিবন্ধনহীন বেসরকারি স্বাস্থ্যসেবা প্রতিষ্ঠানের কার্যক্রম বন্ধ করে ১০ কর্মদিবসের মধ্যে অধিদপ্তরে জানাতে বলা হয়েছিল। বেঁধে দেওয়া সেই সময় শেষ হয় ১৮ ফেব্রুয়ারি। এই সময়ে কতটি অবৈধ ক্লিনিক বন্ধ করা হয়েছে- এ বিষয়ে জানতে চাইলে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের তৎকালীন পরিচালক (অতিরিক্ত দায়িত্ব) ডা. আবু হোসেন মো. মঈনুল আহসান বলেন, ‘সারা দেশের জেলা ও উপজেলা পর্যায়ের স্বাস্থ্য কর্মকর্তারা বন্ধ প্রতিষ্ঠানের তালিকা লিখিতভাবে অধিদপ্তরে পাঠাবেন। সেটি আসার পর বলতে পারব কতগুলো বন্ধ হয়েছে।’
অবৈধ ক্লিনিক বন্ধে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের নির্দেশনা কতটুকু বাস্তবায়ন হয়েছে- এ প্রশ্নে তিনি বলেন, অধিদপ্তরের তৈরি করা তালিকা ধরে সম্প্রতি দেশের বিভিন্ন স্থানে থাকা অবৈধ হাসপাতালগুলোর বিষয়ে খোঁজ নিয়ে বাস্তবতা দেখা যায়নি। সরেজমিনে দেখা যায়, অনেক জায়গায় দিব্যি কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছে অবৈধ এসব প্রতিষ্ঠান।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের অবৈধ ক্লিনিকের তালিকায় থাকা এমন একটি প্রতিষ্ঠান টাঙ্গাইলের রেহেনা মডার্ন হসপিটাল। টাঙ্গাইল শহরে শেখ হাসিনা মেডিকেল কলেজের সামনেই গড়ে ওঠা ক্লিনিকের নেই স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের নিবন্ধন। তারপরও দিব্যি কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছে জেলা সিভিল সার্জনের কার্যালয় থেকে মাত্র আধা কিলোমিটার দূরত্বে থাকা অবৈধ এই হাসপাতাল।
রেহেনা মডার্ন হসপিটালের ১০০ গজের মধ্যে রয়েছে মেডিপ্লাস হসপিটাল অ্যান্ড হরমোন সেন্টার। কোনো হরমোন বিশেষজ্ঞ না থাকলেও ক্লিনিকের নাম হরমোন সেন্টার। এই কারণেই ক্লিনিকে রোগীর ভিড় কিছুটা বেশি। এখানকার বেশির ভাগ চিকিৎসকও শেখ হাসিনা মেডিকেল কলেজের। কথা হয় প্রতিষ্ঠানের পরিচালক মো. আতিকুল ইসলামের সঙ্গে। তিনি বলেন, স্থানীয় প্রশাসনের অনুমতি নিয়েই প্রতিষ্ঠান পরিচালিত হয়।
শুধু এই দুটি প্রতিষ্ঠানই নয়, টাঙ্গাইল শহরের সদর রোডে অবস্থিত আল-মদিনা চক্ষু হাসপাতাল অ্যান্ড ফ্যাকো সেন্টার, সাবালিয়ার টাঙ্গাইল মেডিপ্যাথ হাসপাতাল অ্যান্ড ডায়াগনস্টিক সেন্টার, হাই কেয়ার ল্যাব, সুপার হসপিটাল অ্যান্ড ডায়াগনস্টিক সেন্টার, হেলথ এইড নামের ক্লিনিকও কোনো ধরনের আবেদন না করেই হাসপাতালের কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছে। এদিকে ময়মনসিংহ নগরীর কৃষ্টপুর মহল্লায় বহুতল ভবনের প্রথম ও দ্বিতীয় তলায় কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছে শাওন ডায়াগনস্টিক ল্যাব। সেখানে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করা হলেও এই ল্যাবে আসা রোগীদের অস্ত্রোপচার করা হয় তৃতীয় তলায় প্রতিষ্ঠিত মনির উদ্দিন প্রাইভেট হাসপাতালে।
গত বছরের মাঝামাঝি সময়ে প্রতিষ্ঠানটির নাম ছিল নিউ মনির উদ্দিন প্রাইভেট হাসপাতাল অ্যান্ড ডায়াগনস্টিক সেন্টার। চিকিৎসক ছাড়া অস্ত্রোপচার করায় হাসপাতালটি সিলগালা করা হয়। এরপর নাম পরিবর্তন করে তিন মাস ধরে আবারও কার্যক্রম চালাচ্ছে অবৈধ এই প্রতিষ্ঠানটি।
জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সারাদেশে অলিগলিতে চিকিৎসাসেবার নামে অবাধে অবৈধ ব্যবসা করে যাচ্ছে অসংখ্য অনিবন্ধিত হাসপাতাল, ক্লিনিক ও ডায়াগনস্টিক। এসব অবৈধ প্রতিষ্ঠানে সরকারি নিয়ন্ত্রণ থাকে না। বিভিন্ন সময় দায়িত্বপ্রাপ্ত সরকারি কর্মকর্তা ও অবৈধ চিকিৎসা প্রতিষ্ঠানের মালিকদের যোগসাজশ ও লেনদেনের অভিযোগ পাওয়া গেছে। কোথাও কোথাও ডায়াগনস্টিক সেন্টারের অনুমোদন নিয়ে সাজিয়ে বসেছে হাসপাতাল ও ক্লিনিকের ব্যবসা। ভর্তি করা হয় রোগী। ভাড়া করে আনা হয় চিকিৎসক। মানহীন আইসিইউ সাজিয়ে চালায় রমরমা বাণিজ্য। এমন ফাঁদে পড়ে নানা হয়রানির শিকার হয়ে আসছে অনেক রোগী। সাইন বোর্ড সর্বস্ব এসব প্রতিষ্ঠানে নিয়মনীতির বালাই নেই।
জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা আরো জানান, জবাবদিহি না থাকায় অবৈধ ডায়াগনস্টিক সেন্টারগুলোতে চলে অরাজকতা। থাকে না মানবতার উপস্থিতি। এসব সেন্টারে হাতুড়ে টেকনিশিয়ান দ্বারাই চালানো হয় রোগ নির্ণয়ের যাবতীয় পরীক্ষা। তারা মনগড়া রিপোর্ট তৈরি করে ঠকাচ্ছে নিরীহ মানুষকে। একই রোগ পরীক্ষায় একেকটি ডায়াগনস্টিক সেন্টার থেকে একেক রকম রিপোর্ট পাওয়ার অনেক ঘটনা রয়েছে। রোগী মারার কারখানা হিসেবে পরিচিতি লাভ করেছে অনেক ডায়াগনস্টিক সেন্টার। এসব সেন্টার থেকে প্রাপ্ত রিপোর্ট নিয়ে রোগী ও তাদের স্বজনরা চরম বিভ্রান্তিতে পড়েন। নানা সমালোচনার মধ্যেও সরকারি হাসপাতালের এক শ্রেণির ডাক্তারের সহায়তায় ডায়াগনস্টিক সেন্টার মালিকদের যথেচ্ছ টেস্টবাণিজ্য চলছে বছরের পর বছর। ডায়াগনস্টিক প্রতারণার শিকার মানুষজন বারবার অভিযোগ তুলেও প্রতিকার পাচ্ছেন না।
ভোরের আকাশ/রন
মন্তব্য