-->

শিশুদের ভাষা বিলম্ব

উদ্বেগে বাবা-মা

ভোরের আকাশ প্রতিবেদক
শিশুদের ভাষা বিলম্ব

মনিরুল ইসলাম ও সায়লা ইসলাম দম্পতির প্রথম সন্তান সাইমুম ইসলাম। পাঁচ বছর পেরিয়ে গেছে। কিন্তু এখনো সঠিকভাবে কথা বলতে পারে না সাইমুম। অথচ তিন বছর বয়সেই সাধারণ বাক্য ও প্রশ্নের উত্তর দিতে পারার কথা শিশুটির। শরিফ শিকদার ও নওশীন আক্তারের দ্বিতীয় সন্তান আবরার হোসেন। আবরারের বয়স তিন শেষে চারে গিয়ে পড়ল। অথচ এখনো কথা বলছে না সে। এই শিশুরা ভাষা বিলম্ব বা স্পিচ ডিলে রোগে আক্রান্ত। দেরিতে কথা বলা শিশুর সংখ্যা দিন দিন বাড়ছে। বাড়ছে বাবা-মায়ের উদ্বেগ। প্রিয় সন্তানের মুখের ডাক শুনতে হাসপাতালে ছুটছেন বাবা-মা। সম্প্রতি রাজধানীর বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ে (বিএসএমএমইউ) ইনস্টিটিউট অব পেডিয়াট্রিক নিউরো ডিজঅর্ডার অ্যান্ড অটিজম (ইপনা) ও শিশু নিউরোলজি বিভাগের সামনে দেখা যায় সাইমুম ও আবরারকে। কথা হয় তাদের বাবা-মায়ের সঙ্গে।

সাইমুমরা থাকে রাজধানীর আজিমপুরে। তার বাবা মনিরুল ইসলাম পরিকল্পনা কমিশনে চাকরি করেন। মা সংসার সামলান। কেন কথা বলছে না সাইমুম? মনিরুল ইসলাম বলেন, আমরা গ্রামে বড় হয়েছি একটি ভিন্ন পরিবেশে। কিন্তু ঢাকায় একক পরিবারে বাস করি। আমি চাকরি করি। স্ত্রী সারাদিন ফোনে ব্যস্ত থাকে। ছেলেকে সঠিকভাবে সময় দেয়নি। আমার ছেলে সারাদিন কার্টুন দেখায় ব্যস্ত থাকে। এজন্য কথা বলতে পারে না। কিছু দরকার হলে ইশারা-ইঙ্গিতে বলে। মাঝে মধ্যে জেদ ও কান্নাকাটি করে। আমরা নিজেরাই সন্তানের এ অবস্থার জন্য দায়ী। এখন হাসপাতালে এসেছি, দেখা যাক কী হয়। একই হাসপাতালে এসেছিলেন শরিফ শিকদার, তার স্ত্রী নওশীন আক্তার ও দ্বিতীয় সন্তান আবরার হোসেন। আবরারের বয়স তিন শেষে চারে গিয়ে পড়ল। অথচ এখনো কথা বলছে না।

আবরাররা থাকে মোহাম্মদপুরের কাটাসুর এলাকায়। ওর একটি বড় বোন আছে, নাম মাহিন। মাহিন একটু দেরিতে কথা বলেছিল। তাই আবরারের বাবা-মা মনে করছিলেন, সেও দেরিতে কথা বলবে। আশা আর সম্ভাবনার দুয়ারে কড়া নাড়তে নাড়তে একদিন বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের শরণাপন্ন হন তারা। জানতে পারেন, আবরারের আচরণ, ভাষা ও সামাজিক দক্ষতার বিকাশেও সীমাবদ্ধতা আছে। শুধু সন্তানের দেরিতে কথার বিষয়টি দেখতে গিয়ে আরও অনেক কিছুই খেয়াল করেননি তারা।

বিএসএমএমইউর শিশু নিউরোলজি বিভাগের চেয়ারম্যান অধ্যাপক ডা. কানিজ ফাতেমা বলেন, বর্তমানে ভয়াবহভাবে স্পিচ ডিলে বেড়ে চলেছে। এজন্য প্রধানত দায়ী মোবাইল ফোন। পাঁচ বছরের আগে শিশুদের হাতে মোবাইল দেওয়া উচিত নয়। পাঁচ বছরের আগে শিশুরা এর সঠিক ব্যবহারও জানে না। বাবা-মা বাসায় থাকলেও কোয়ালিটি সময় দেয় না শিশুদের। শূন্য থেকে পাঁচ বছর খুবই গুরুত্বপূর্ণ সময়। এই সময়ে শিশুদের বেশি বেশি সময় দিতে হবে। তিনিবলেন, তবে এখন মানুষের মধ্যে একটা সচেতনতা তৈরি হয়েছে, সেটা হলো তিন বছরে কথা না বললে আমাদের কাছে আসে। কিন্তু ফোনের কারণে শিশুদের যে স্পিচ ডিলে হচ্ছে অনেক বাবা-মা এটা জানেন না। অটিজমের কারণেও শিশুদের স্পিচ ডিলে হয়। তবে মোবাইল ফোনের কারণে বেইনে শিশুদের সমস্যা হচ্ছে। ফলে এখন নিউরোলজি বিভাগে ১০০ রোগীর মধ্যে ১০ জনের স্পিচ ডিলে ধরা পড়ছে। সংখ্যাটা কিন্তু একেবারে কম নয়, ভয়াবহ। তাই অভিভাবকদের উচিত শিশুদের সুস্থ পরিবেশে বড় করা।

একটি শিশু যখন পৃৃথিবীতে আসে, তখন পরিবারের সবার মনে এক অনাবিল আনন্দের আবির্ভাব হয়। ঠিকমতো বুকের দুধ পাচ্ছে কি না, নাভি পড়ল কি না, কবে দাঁত উঠল, তাকালে হাসে কি না, কবে ঘাড় সোজা করে বসল, হাঁটি হাঁটি পা করে আদরের শিশু কবে একটা দৌড় দিয়ে কোলে আসবে তা নিয়ে যেন আগ্রহের কমতি নেই সবার। সবচেয়ে বেশি অধীর আগ্রহ নিয়ে যে বিষয়টি আনন্দের কেন্দৃবিন্দুতে থাকে তা হলো শিশুর মুখের ভাষা। সোসাইটি অব স্পিচ অ্যান্ড ল্যাঙ্গুয়েজ থেরাপিস্টের (এসএসএলটি) সভাপতি ফিদা আল-শামসের তথ্যমতে, বিকাশের ধাপ অনুযায়ী একটি শিশু তার জন্মের চার-ছয় মাস বয়সের মাঝে আধো আধো বোলে মা, বা, উ, আ, ইত্যাদি ধ্বনি উচ্চারণ করা শুরু করে। নয় থেকে ১৮ মাস বয়সের মধ্যে প্রথম অর্থবোধক শব্দ বলা শুরু করে এবং মোটামুটি আট থেকে দশটি অর্থবোধক শব্দ বলতে পারে। শিশুর যখন ২৪ মাস বা দুই বছর বয়স তখন ৫০টির মতো শব্দ বলতে পারে। এর মধ্যেই শিশু দুই শব্দবিশিষ্ট ছোট ছোট বাক্য ব্যবহার করা শুরু করে। শিশুর মুখের হাসি আর সঙ্গে তাদের খেলায় সে মাতিয়ে রাখে গোটা পরিবার। কিন্তু সব ক্ষেত্রে এমনটি ঘটে না। এখন অনেক শিশুই দেরিতে কথা বলছে বা কথা বলতেই পারছে না। ভাষা বিলম্ব বা স্পিচ ডিলে রোগে আক্রান্ত হচ্ছে আদরের শিশুরা। নানা কারণে এমনটি হচ্ছে। যেমন: বাবা-মায়ের ব্যস্ততার কারণে গৃহপরিচারিকার তত্ত্বাবধানে বড় হওয়া। এই সময় গৃহপরিচারিকা বাসার নানান কাজে ব্যস্ত থাকে আর শিশুটি মনের ভাব প্রকাশ করার মতো কোনো মানুষ খুঁজে পায় না। এমনকি কবুতরের খাঁচার মতো সারাদিন বহুতল ভবনের কোনো রুমে বন্দি অবস্থায় থাকে শিশু। ফলে সূর্যের আলোরও দেখা পায় না তারা। বিষাক্ত পরিবেশের কারণে শিশুর কণ্ঠে সঠিক সময়ে নির্গত হয় না মা, বা, দা, উ, আ ইত্যাদি ধ্বনি। আর শিশুটিকে মগ্ন রাখার জন্য তার সামনে রাখা হয় টেলিভিশন, কম্পিউটার, ল্যাপটপ বা ট্যাবলেট পিসি। হাতে ধরিয়ে দেওয়া হয় মোবাইল ফোন। পরিণতিতে এসব যন্ত্রের মাঝেই সারাদিন বুঁদ হয়ে থাকে শিশুটি। এছাড়া জিনগত ত্রুটি, কানে কম শোনা, বিকাশজনিত বিলম্ব, মনোসামাজিক দৈন্যতা, অটিজমসহ বিভিন্ন স্নায়ু বিকাশজনিত বৈকল্যও শিশুর কথা না বলা অথবা দেরিতে কথা বলার পেছনে কারণ হিসেবে ক্রিয়াশীল।

 

ভোরের আকাশ/রন

মন্তব্য

Beta version