ঢাকার প্রগতি সরণি সংলগ্ন নদ্দায় থাকে শিশু রাফসান। বয়স ছয়। সাড়ে পাঁচ তলা বাসা। তাদের ইউনিটের সামনে খোলা ছাদ। বিমানবন্দর খুব কাছে। একটু শব্দ পেলেই ছাদ বা জানালায় ছুটে যায় প্লেন-হেলিকপ্টারের ওড়াউড়ি দেখতে। গত ৫ আগস্টের পরের চিত্র উল্টো। হেলিকপ্টারের আওয়াজ হলেই আঁতকে ওঠে সে। মায়ের আঁচলে মুখ লুকায়। বাবাকে বাইরে যেতে দেয় না। রীতিমতো পা ধরে কান্না করে। বলে, বাইরে গেলে ওরা তোমাকে গুলি করে দেবে।
রাফসানের বাবা আরিফ আহমেদ বেসরকারি চাকরিজীবী। জুলাই-আগস্টের আন্দোলনের সময় অধিকাংশ দিন অফিস করতে হয়েছে। তিনি বলেন, নদ্দা, বসুন্ধরা এলাকা প্রতিদিন আন্দোলনে উত্তাল ছিল। বাড্ডায় আমার অফিস। আমার ছেলে গুলির মতো শব্দ পেলেই দরজা বন্ধ করে দিতো, এখনো শব্দ হলেই মনে করে গুলি হচ্ছে। আমাকেও বাইরে বের হতে দিতো না। মনে করতো আমাকে পুলিশ গুলি করে মেরে ফেলবে। আমরা টিভি-পত্রিকায় নিউজ দেখতাম। সেও দেখতো। এটা তার মনস্তত্ত্বে ব্যাপক প্রভাব ফেলেছে।
দেড় বছর বয়সী আবরার আওসাফ জাহিনের মানসিক অবস্থা আরও করুণ। কোটা সংস্কারের দাবিতে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সময় হেলিকপ্টার থেকে গুলির ঘটনা ভোলে না সে। ভাঙা ভাঙা উচ্চারণে সে এখনো হেলিকপ্টার দেখলেই বলে, গুলি...গুলি। জাহিনের মা নাদিয়া শারমিন বলেন, আন্দোলন চলাকালীন একদিন বিকেলে জাহিনকে নিয়ে ছাদে যাই। হঠাৎ একটি হেলিকপ্টার থেকে চারদিকে গুলি ছুড়তে শুরু করে। সেই থেকে আমার বাচ্চাটি ভয় পায়। ভয়ে সে হেলিকপ্টারের নাম কিংবা শব্দ শুনলেই ভয় পেয়ে আমার কাছে লুকাতে চায়। এমনকি টেলিভিশনে হেলিকপ্টার উড়তে দেখলেও ওর চোখেমুখে ভয় কাজ করে।
বাবার সঙ্গে বাইরে বের হয়ে আন্দোলনকারী ও পুলিশের সংঘর্ষের মধ্যে পড়ে প্রথম শ্রেণিতে পড়ুয়া সাফওয়ান বিন সাইফ। আন্দোলন দমাতে পুলিশ মুহুর্মুহু গুলি চালায়। বাবার সঙ্গে গলিতে ঢুকে কোনোরকমে নিজেদের রক্ষা করে। সেই থেকে সাইফ পুলিশ দেখলে কিংবা পুলিশের কথা শুনলেই আঁতকে ওঠে। শেষমেশ ট্রমা কাটাতে একজন বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের শরণাপন্ন হয়েছেন তার বাবা সাদ বারী। ২০ জুলাই রাজধানীর রায়েরবাগে ৮ তলা ভবনের বারান্দা থেকে মা-বাবার সঙ্গে বিক্ষোভ দেখার সময় গুলিবিদ্ধ হয়ে মারা যায় চার বছর বয়সী আবদুল আহাদ। ২৪ জুলাই নারায়ণগঞ্জে বাসার ছাদে গুলিবিদ্ধ হয়ে মারা যায় রিয়া গোপ (৬)। বাসায় এসব খবরের আলোচনা শুনে শিশুরা আরও আতঙ্কগ্রস্ত হয়।
কোটা সংস্কার আন্দোলন থেকে সৃষ্ট সহিংসতা ছড়িয়ে পড়লে সর্বস্তরের শিক্ষার্থীরা রাজপথের দখল নেয়। মধ্য জুলাই থেকে শুরু করে ৫ আগস্ট পর্যন্ত চলে কারফিউ, হামলা, হেলিকপ্টার থেকে গুলিবর্ষণ ও রাতের আঁধারে বাসা-বাড়িতে তল্লাশি। এসব ঘটনা বড়দের পাশাপাশি শিশুদের মনস্তত্ত্বে বড় প্রভাব ফেলে। আন্দোলন পরবর্তী সময়ে শিশুদের এ অবস্থার কারণে অনেক অভিভাবক এখনো দুশ্চিন্তায়।
মানসিক চিকিৎসকরা বলছেন, দেশে অস্থিরতা দেখা দিলে, সহিংসতার বিস্তার হলে নানা ধরনের অনিশ্চয়তার জন্ম হয়। এর প্রভাব শিশুদের ওপরও পড়ে, সেটা যেন সবার নজর এড়িয়ে না যায়। এমন সময়ে কীভাবে নিজেদের সন্তানদের সহায়তা করা যায়, তা বোঝাটা বাবা-মায়ের জন্য অনেক সময় কঠিন হয়ে পড়ে। কারণ, তারা নিজেরাও ট্রমার মধ্যে থাকেন।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ছাত্র-জনতার গণঅভ্যুত্থানে হামলা, নির্যাতন ও মামলা শিক্ষার্থীদের মনের ওপর চাপ তৈরি করেছে। আন্দোলনে জড়িত না হয়েও বিপুলসংখ্যক হতাহতের ঘটনা সম্পর্কে জেনে অনেক শিশু-শিক্ষার্থীও মানসিকভাবে আঘাত পেয়েছে। শিশুরা সরাসরি ঘটনাস্থলে থেকে সহিংসতা দেখেছে, কারও কাছ থেকে ভীতিকর অভিজ্ঞতা জেনেছে, গণমাধ্যম থেকে খবর জেনে সেসব চিত্র কল্পনা করেছে, গুরুতর আঘাত ও মৃত্যুর কথা ভেবেছে। ফলে তাদের মধ্যে ভয়, আতঙ্ক, দুঃখবোধ, অস্থিরতা, উৎকণ্ঠা, চমকে ওঠা, বিচ্ছিন্নতাবোধ, অসহায়ত্ব বোধ করার মতো আচরণিক প্রকাশ দেখা গেছে।
রাজধানীর মগবাজার এলাকায় গত ৪ আগস্ট স্কুলপড়ুয়া নাফিস হাসান সৈকত বাসার নিচে হাঁটছিল। বাসার বারান্দায় ছিলেন তার মা। হঠাৎ তার পাশে একজন মধ্যবয়সী লোকের মাথায় গুলি লেগে সঙ্গে সঙ্গে পড়ে যান। গুলি লাগার দৃশ্যটি মা-ছেলে দেখে ভীত হয়ে পড়েন। পরবর্তীতে মানসিক সমস্যা দেখা দেওয়ায় জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউটে চিকিৎসা নিচ্ছেন। সৈকতের মা বলেন, এমনভাবে গুলি এলো এবং একজন লোক পড়ে মারা গেলো তা চিন্তার বাইরে। ঘটনাটি আমার ও ছেলের চোখের সামনে যেন বারবার ভাসছিল। ঘুমের মধ্যে, খেতে গেলে কিংবা একা একা থাকলে ওই গুলি লাগার ঘটনা মনে পড়ে। স্বাভাবিক কাজ করতে পারছিলাম না। একমাস পর জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউটে চিকিৎসকের শরণাপন্ন হই আমরা। চিকিৎসকের পরামর্শ অনুযায়ী চলছি এখন। শুধু সৈকত ও তার মা নন, আরও অনেক শিশু-কিশোর এখনো জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউট থেকে চিকিৎসা নিচ্ছে।
আন্দোলনে আহত শিশু-কিশোররা সবাই এক ধরনের ট্রমার মধ্যে আছে। ট্রমা এক ধরনের মনোদৈহিক চাপজনিত বিষয়। কোনো অনাকাক্সিক্ষত ভয়াবহ ঘটনার অভিজ্ঞতা যা প্রত্যক্ষদর্শীর মনে চাপের সৃষ্টি করতে পারে কিংবা তার অস্তিত্বের জন্য হুমকি হতে পারে। অন্যের ট্রমার গল্প শুনেও আরেকজন ট্রমাটাইজ হতে পারে। চিকিৎসকদের মতে, কেউ ট্রমায় ভুগলে আবেগ খুব বেশি উঠা-নামা করবে। মানসিক অনুভূতি নিয়ন্ত্রণে সমস্যা হয়। নিজের আন্তঃসম্পর্ক বজায় রাখতে সমস্যা হয়। ঘুমের ব্যঘাত, শ্বাস নিতে কষ্ট, মস্তিষ্কের পরিবর্তন, ইচ্ছা করলেও নিজেকে ঠিক রেখে স্বাভাবিক কাজ চালিয়ে যেতে পারছে না এমন হতে পারে। প্যানিক অ্যাটাক ও কিছুক্ষণ পর পর চমকে ওঠার ঘটনাও ঘটে।
আন্দোলনে আহত শিক্ষার্থীদের নিয়ে সম্প্রতি মানসিক স্বাস্থ্য সমস্যা সংক্রান্ত বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় ও সুপার স্পেশাল হাসপাতাল একটি গবেষণা চালিয়েছে। ২৬ জন রোগীর ওপর গবেষণাটি চালানো হয়। এদের সবাই গুলিবিদ্ধ হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হন। বয়স ১২-৩৩ বছরের মধ্যে। প্রাইমারিতে পড়াশোনা ১৩ জন, মাধ্যমিকে ১০ জন ও উচ্চ মাধ্যমিক পর্যন্ত পড়াশোনা করা দুজন। গবেষণায় দেখা যায়, ৪২ শতাংশ রোগী দুশ্চিন্তাগত, ৫৩ শতাংশের ঘুমের সমস্যা, বিষণ্নতায় ভুগছেন ১১ শতাংশ রোগী এবং ১১ শতাংশ রোগীর খিটখিটে মেজাজ।
দেশে কোটা সংস্কার আন্দোলন দমনের সময় ৬৫ জনেরও বেশি শিশুর মৃত্যু হওয়ার তথ্য দেয় জাতিসংঘ শিশু তহবিল-ইউনিসেফ। ৫ আগস্ট পরবর্তীসময়ে এক বিবৃতিতে এ তথ্য জানান শিশুদের বিরুদ্ধে সহিংসতাবিষয়ক জাতিসংঘ মহাসচিবের বিশেষ প্রতিনিধি নাজাত মাল্লা মজিদ। বিবৃতিতে নাজাত মাল্লা মজিদ বলেন, সবশেষ যাচাই করা তথ্য অনুযায়ী বাংলাদেশে শিক্ষার্থীদের ‘শান্তিপূর্ণ বিক্ষোভ’ দমনে ৬৫ জনেরও বেশি শিশু নিহত হয়েছে। বাংলাদেশের তরুণ ও শিশুরা সাম্প্রতিক বিক্ষোভের অগ্রভাগে ছিল। তারা অনেক কিছু অর্জন করেছে কিন্তু এর জন্য তারা বিশাল মূল্যও দিয়েছে।
জাতিসংঘ মহাসচিব এবং মানবাধিকারবিষয়ক হাইকমিশনারের কাছে তিনি কোটা সংস্কার আন্দোলনের সময় সহিংসতার সব ধরনের ঘটনার পূর্ণ, স্বাধীন, নিরপেক্ষ ও স্বচ্ছ তদন্তের দাবি রেখেছেন। দৈনিক প্রথম আলো পত্রিকায় প্রকাশিত একটি তথ্য বলছে, নিহত ৬৫ জন শিশুর মধ্যে ০-১০ বছর বয়সী ৫ জন, ১১-১৫ বছর বয়সী ২৩ জন ও ১৬-১৭ বছর বয়সী ৩৭ জন। সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয় এবং মহিলা ও শিশু বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা শারমীন এস মুরশিদ সম্প্রতি জানান, জুলাই ও আগস্টে ছাত্র-জনতার গণঅভ্যুত্থানে মোট ১০৫ জন শিশু মারা গেছে। তিনি একটি অনুষ্ঠানে বলেন, গণঅভ্যুত্থানে ১০৫ জন শিশু মারা গেছে। এটি স্বাস্থ্যসেবা বিভাগ চূড়ান্ত করেছে, আমরা সেখান থেকে তথ্য নিয়ে এসেছি। শিশু হিসেবে ১৮ বছর পর্যন্ত বয়স ধরে এ তালিকা করা হয়েছে।
হাসপাতালের নথি ও স্বজনদের তথ্য বিশ্লেষণে দেখা যায়, ৭৯ শিশু-কিশোরের শরীরে ছররা ও প্রাণঘাতী গুলির চিহ্ন ছিল। স্থাপনা ও যানবাহনে দেওয়া আগুনে পুড়ে মারা গেছে ৯ শিশু-কিশোর। একটি শিশুর মৃত্যু সাউন্ড গ্রেনেডের স্পিøন্টারের আঘাতে হয়েছে। নিহত শিশুদের মধ্যে সবচেয়ে কমবয়সী শিশুটির নাম আবদুল আহাদ, যার বয়স ছিল ৪ বছর। ২০ জুলাই রাজধানীর রায়েরবাগে ৮তলা ভবনের বারান্দা থেকে মা-বাবার সঙ্গে বিক্ষোভ দেখার সময় গুলিবিদ্ধ হয়ে মারা যায় শিশুটি। নিহত শিশু-কিশোরদের মধ্যে দুটি মেয়েশিশুও রয়েছে। তারা হলো- নারায়ণগঞ্জের রিয়া গোপ (৬) ও উত্তরার নাঈমা সুলতানা (১৫)। রিয়া বাসার ছাদে ও নাঈমা বারান্দায় গুলিবিদ্ধ হয়ে মারা যায়।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এমন সময়ে শিশুকে নিরাপদ রাখতে শারীরিক ও মানসিক নিরাপত্তা এবং নিরাপদ পরিবেশের নিশ্চয়তা দিতে হবে শিশুদের (১০ বছরের কম বয়সী)। যে কোনো পরিস্থিতি ছোট করে সহজ ভাষায় ব্যাখ্যা করা জরুরি। বাইরে কী ঘটছে জানতে চাইলে, কিছু না বলে এড়িয়ে না গিয়ে বলা দরকার- বাইরে কিছু মানুষ দুষ্টদের ওপর রেগে গেছে, রাগ কমলে আমরা বের হবো। মানসিক স্বাস্থ্য চিকিৎসকের মতে, আন্দোলনে থাকা শিক্ষার্থীদের ‘একিউট স্ট্রেস ডিজ-অর্ডার’ এবং পরবর্তী সময়ে ‘পোস্ট-ট্রমাটিক স্ট্রেস ডিজ-অর্ডার’ বা ‘পিটিএসডি’ হতে পারে। সহিংসতার ভয়ংকর স্মৃতি ফিরে ফিরে আসতে পারে।
গত ১৯ জুলাই রাজধানীর মিরপুর-১৪ নম্বর স্টাফকোর্য়ার্টারে কোটা সংস্কার আন্দোলন চলাকালে সাফকাত সামির (১১) ও তার চাচা মশিউর রহমান (১৬) বাসার বেডরুমে জানালার পাশে টেবিলে বসে পড়াশোনা করছিল। এ সময় দুষ্কৃতকারীর একটি গুলি মশিউরের ডান কাঁধ ভেদ করে সামিরের ডান চোখ দিয়ে ঢুকে মাথার পেছন দিয়ে বের হয়ে যায়। সামিরকে হাসপাতালে নিলে চিকিৎসক মৃত ঘোষণা করেন। আর মশিউরকে ১৪টি সেলাই দেন। একই গুলিতে আহত মশিউর বলে, একসঙ্গে আমরা দুজন পড়াশোনা করছিলাম টেবিলে। হঠাৎ একটি গুলি আমার কাঁধে লেগে সামিরের মাথায় ঢুকলে মারা যায় সে। এরপর থেকে আমার ওই টেবিলে পড়াশোনা করতে ভয় লাগে। মনে হয় আবার যদি গুলি এসে আমি মারা যাই!
জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউটের রেজিস্ট্রার ডা. গোলাম মোস্তফা মিলন বলেন, ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের সময় অনেক মুক্তিযোদ্ধা ট্রমাটাইজড ছিলেন। আমাদের হাসপাতালে এমন কিছু রোগী এখনো চিকিৎসা নিতে আসেন যারা মুক্তিযোদ্ধা। ৫৩ বছর পরেও এই মুক্তিযোদ্ধারা পোস্ট-ট্রমাটিক স্ট্রেস ডিজ-অর্ডারের রোগী। ‘পোস্ট-ট্রমাটিক স্ট্রেস ডিজ-অর্ডার’ বা ‘পিটিএসডি’ কয়েক মাস থেকে শুরু করে কয়েক বছর এমনকি অনেক বছর গ্যাপের পরেও শুরু হতে পারে। এটি ভয়ংকর একটি বিষয়। এটি শিশু ও নারীদের জন্য ঝুঁকিপূর্ণ। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে আহতদের চিকিৎসার জন্য আলাদা ইউনিট রয়েছে আমাদের হাসপাতালে। সরাসরি হামলার ঘটনা না দেখলেও মানুষের কাছ থেকে, শুনে কিংবা টেলিভিশন ও সোশ্যাল মিডিয়া থেকে সহিংসতার ভিডিও দেখেও অনেকে ট্রমার মধ্যে রয়েছে। এমন রোগীও পেয়েছি আমরা। এদের মধ্যে বড় একটি অংশ ১৮ বছরের কম বয়সী বা শিশু-কিশোর।জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউটের রেজিস্ট্রার ডা. গোলাম মোস্তফা মিলন বলেন, ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের ভয়াবহতা পর্যবেক্ষণ করে মানসিক ট্রমার শিকার হয়ে জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউটে চিকিৎসা নিয়েছেন ৩০ জন। চারজন এখনো চিকিৎসাধীন। জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউটের একটি টিম অন্য হাসপাতালে গিয়ে রোগীদের কাউন্সেলিং করছে। গত কয়েকদিন ধরে জাতীয় অর্থোপেডিক হাসপাতাল ও পুনর্বাসন এবং জাতীয় চক্ষুবিজ্ঞান ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালে গিয়ে একটি টিম শিশুদের কাউন্সেলিং শুরু করেছে। কী ধরনের সমস্যা পাচ্ছেন জানতে চাইলে তিনি বলেন, মানসিক স্বাস্থ্য হাসপাতালে চিকিৎসারত শিশুদের প্রধান সমস্যা হচ্ছে তারা স্বাভাবিক কাজ করতে গেলে ভয় কিংবা আতঙ্কগ্রস্ত থাকছে। অর্থাৎ তাদের স্বাভাবিক কার্যক্রম বিঘ্ন ঘটছে। এছাড়া আরেকটি সমস্যা হচ্ছে পড়াশোনায় আগের মতো মনোযোগ দিতে পারছে না। পড়াশোনা করতে বসলেই জুলাই-আগস্টের বিভিন্ন গোলাগুলি কিংবা সহপাঠী মারা যাওয়ার বিষয়টি সামনে আসছে। তিনি বলেন, মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউটের পাশাপাশি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়, ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল ও পাবনা মানসিক হাসপাতালসহ জেলা পর্যায়ের চিকিৎসা কেন্দ্রগুলোয় বেশকিছু রোগী রয়েছেন, যারা অভ্যুত্থানে মানসিক ভারসাম্য হারিয়েছেন।
স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের স্বাস্থ্য শিক্ষা ও পরিবার কল্যাণ বিভাগের বিশেষ সহকারী মো. সায়েদুর রহমান বলেন, শিশু-কিশোরসহ অন্য আহতদের মধ্যে অসন্তোষ তৈরির অন্যতম কারণ মানসিক ট্রমা (আঘাত)। এই মানসিক স্বাস্থ্যের বিষয়টি এ পর্যন্ত খুব ভালোভাবে দেখা হয়েছে বলে আমরা মনে করছি না। আমরা স্বীকার করছি, বিষয়টি আমরা যথেষ্ট সফলতার সঙ্গে পেরে উঠিনি। এজন্য ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব মেন্টাল হেলথের পাশাপাশি দেশের সরকারি-বেসরকারি যারা এই সেবার সঙ্গে আছেন, তাদের যুক্ত করে একটি নেটওয়ার্ক করা হবে।
জুলাই শহীদ স্মৃতি ফাউন্ডেশনের মিডিয়া অ্যান্ড পিআর এক্সিকিউটিভ জাহিদ হোসাইন বলেন, ‘জুলাই-আগস্টে শহীদের পরিবারের জন্য পাঁচ লাখ টাকা ও আহতদের জন্য এক লাখ টাকা করে দেওয়া হচ্ছে। আহত শিশু যারা আছে তাদেরকে মানসিক স্বাস্থ্যসেবা দেওয়ার জন্যও আমাদের ফাউন্ডেশন কাজ করে যাচ্ছে। শাহবাগে ফাউন্ডেশন স্পেশাল সেলের একটি অফিস আছে সেখানে আহতদের ফরম জমা হচ্ছে। ফরম জমা নেওয়া শেষ হলে আহত শিশুদের মধ্যে বাছাই করে বিশেষভাবে শিশুদের মানসিক স্বাস্থ্যসেবার দিকে নজর দেওয়া হবে।
জাতিসংঘের শিশুবিষয়ক সংস্থা ইউনিসেফের দক্ষিণ এশিয়া অঞ্চলের পরিচালক সঞ্জয় উইজে সেকেরা বলেন, বাংলাদেশ সরকার, ইউনিসেফের অংশীদার ও তরুণদের জন্য কাজ করছে, এমন সংস্থাগুলোর প্রতিনিধিদের সঙ্গে আমাদের বৈঠক হয়েছে। বৈঠকে জাতিসংঘের শিশু অধিকার সনদে শিশুদের একত্র হওয়া ও শান্তিপূর্ণভাবে সমাবেশের অধিকারের স্বীকৃতি দেওয়ার বিষয়টির ওপর জোর দেওয়া হয়েছে। শিশু ও তরুণরা বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ। তারা যখন কোনো কিছু নিয়ে সোচ্চার হন, তখন তাদের সর্বোচ্চ সুরক্ষা দেওয়া উচিত বলে মনে করে ইউনিসেফ। ইউনিসেফের এ কর্মকর্তা বলেন, বাংলাদেশে জুলাই মাসে বিক্ষোভের সময় শিশুদের এমন মৃত্যু ভয়ানক ক্ষতি। তাছাড়া অনেক শিশু আহত হয়েছে। অনেককে আটক করা হয়েছে। ইউনিসেফ সব ধরনের সহিংসতার নিন্দা জানাচ্ছে। আন্তর্জাতিক মানবাধিকার আইন, বাংলাদেশের স্বাক্ষর করা জাতিসংঘের শিশু অধিকার সনদ ও আটক করা হলে শিশুদের ওপর যে প্রভাব পড়ে, তা নিয়ে গবেষণার ভিত্তিতে ইউনিসেফ শিশুদের যে কোনো ধরনের আটক বন্ধের আহ্বান জানাচ্ছে। যার অর্থ হলো- কোনো স্থানে শিশুদের অংশগ্রহণ বা তাদের আগের ইতিহাস, ধর্ম ও তাদের পরিবারের কর্মকাণ্ড বা মতাদর্শের জন্য শিশুদের গ্রেপ্তার বা আটক করা যাবে না।
ভোরের আকাশ/রন
মন্তব্য