এবার আন্তর্জাতিক আলোচনায় এসেছে দেশের ডেঙ্গু পরিস্থিতি। শীতকালকে ‘পিক মৌসুম’ দেখে খোদ বিশেষজ্ঞরাও বিপাকে পড়ছেন। দুই মাস ধরে পিক মৌসুমের (জুলাই-সেপ্টেম্বর) তুলনায় বেশি সংখ্যক নতুন ডেঙ্গু রোগী শনাক্ত এবং মৃত্যুর ঘটনা ঘটছে। সংক্রমণ ও মৃত্যুর সংখ্যায় শীর্ষে ব্রাজিল থাকলেও মৃত্যুহারে শীর্ষে বাংলাদেশ। দেশটির তুলনায় বাংলাদেশে মৃত্যুর হার ৯ গুণ বেশি।
চলতি বছর ৫৩টি দেশে ডেঙ্গুর প্রকোপ দেখা দিয়েছে। আক্রান্ত হয়েছে এক কোটি ৪০ লাখের বেশি মানুষ। মারা গেছেন ১০ হাজারের বেশি। এর মধ্যে শুধু ব্রাজিলেই এখন পর্যন্ত আক্রান্তের সংখ্যা ৯৯ লাখ ২৮ হাজার ১৬৯ জন। মৃত্যু হয়েছে ৫ হাজার ৮১৫ জনের।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (ডব্লিউএইচও), প্যান আমেরিকান স্বাস্থ্য সংস্থা, ইউরোপিয়ান সেন্টার ফর ডিজিজ প্রিভেনশন অ্যান্ড কন্ট্রোল (ইসিডিসি) ও বাংলাদেশ স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের ডেঙ্গুর পরিসংখ্যান পর্যালোচনা করে এ তথ্য জানা যায়।
বাংলাদেশ পরিস্থিতি:
এবছর দেশের ডেঙ্গু পরিস্থিতিতে বেশি মাত্রায় অস্বাভাবিকতা লক্ষ্য করছেন জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা। তারা বলছেন, জুলাই থেকে সেপ্টেম্বর হলো ডেঙ্গুর পিক মৌসুম। অক্টোবর থেকে নতুন রোগী ও মৃত্যুর হার কমতে থাকে। কিন্তু চলতি বছর এক্ষেত্রে অস্বাভাবিক চিত্র লক্ষ্য করা যাচ্ছে। যেখানে মৃত্যু কমার কথা, সেখানে উল্টো বাড়ছে। ডেঙ্গুতে গড়ে দৈনিক মৃত্যু সেপ্টেম্বরে ২ দশমিক ৯ জন, অক্টোবরে ৪ দশমিক ৫০ জন, নভেম্বরে ৫ দশমিক ৭৬ জন। আর ডিসেম্বরের ৮ দিনে দৈনিক মৃত্যু দাঁড়াল ৫ দশমিক ১২ জনে।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের সর্বশেষ হিসাব অনুযায়ী, চলতি বছরে ৮ ডিসেম্বর পর্যন্ত ৫২৯ জন ডেঙ্গুতে প্রাণ হারিয়েছেন। এর মধ্যে গত অক্টোবর মাসে ১৩৫ জন এবং নভেম্বরে ১৭৩ জনের মৃত্যু হয়েছে। চলতি বছরে ৮ ডিসেম্বর পর্যন্ত ৯৬ হাজার ২২৮ ডেঙ্গু রোগী হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের পুরো বছরের তথ্যে দেখা যায়, বছরের শুরুতে অর্থাৎ জানুয়ারিতে হাসপাতালে ভর্তি হন ১ হাজার ৫৫ জন, মৃত্যু হয় ১৪ জনের; ফেব্রুয়ারিতে ভর্তি হন ৩৩৯ জন, মৃত্যু হয় তিনজনের; মার্চে রোগী ছিলেন ৩১১ জন, মৃত্যু পাঁচজনের; এপ্রিলে আক্রান্ত ৫০৪ জন, মৃত্যু দুইজনের; মে মাসে আক্রান্ত ৬৪৪ জন, মৃত্যু ১২ জনের; জুনে আক্রান্ত ৭৯৮ জন, মৃত্যু আটজনের; জুলাইয়ে আক্রান্ত ২ হাজার ৬৬৯ জন, মৃত্যু ১২ জনের; আগস্টে আক্রান্ত ৬ হাজার ৫২১ জন, মৃত্যু ২৭ জনের; সেপ্টেম্বরে আক্রান্ত ১৮ হাজার ৮৭ জন, মৃত্যু ৮৭ জনের।
অক্টোবরে ডেঙ্গু আক্রান্ত হয় সাড়ে চার হাজার, মৃত্যু হয় ১৩৪ জনের। নভেম্বরে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন ২৯ হাজার ৬৫২ জন এবং এ সময়ে মারা গেছেন ১৭৩ জন। অর্থাৎ চলতি বছর মাসিক হিসাবে ডেঙ্গুতে নভেম্বরে মৃত্যুহার সবচেয়ে বেশি। আর ডিসেম্বরের ৮ দিনে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন ৪ হাজার ৭৫৯ জন এবং মারা গেছেন ৪১ জন।
বিশেষজ্ঞদের মতামত:
জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক ডা. আবু জামিল ফয়সাল ভোরের আকাশকে বলেন, আগের বছরগুলোতে দেখেছি, ডেঙ্গুর পিকটাইম সেপ্টেম্বরে ছিল পাঁচবার। অক্টোবরে তিনবার, আগস্ট ও নভেম্বরে হয়েছে একবার করে। এবারও অক্টোবর পিকটাইম হয়েছে। কিন্তু সেটা দীর্ঘস্থায়ী হতে পারে। তিনি আরও জানান, প্রতি বছর সরকার থেকে ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণে যে পরিমাণ অর্থ ব্যয় হয়, তার কোনো কার্যকারিতা নেই। শুধু অর্থ ব্যয় করলেই হবে না, সুনির্দিষ্ট পরিকল্পনা গ্রহণ করতে হবে। প্রতিদিন সন্ধ্যায় ফগার মেশিন দিয়ে ধোঁয়া দিলেই ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণে আসবে না। সুষ্ঠু ও কার্যকরী পরিকল্পনা নেওয়ার দাবি জানান তিনি।
জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ ডা. লেলিন চৌধুরী ভোরের আকাশকে বলেন, সারাবছর ধারাবাহিকভাবে কাজ করায় পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতের কলকাতা ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণে রেখেছে। বাংলাদেশে ডেঙ্গুকে মৌসুমি সমস্যা হিসেবে দেখা হচ্ছে। এটা যে জনস্বাস্থ্যের জরুরি সমস্যা, সে চিন্তা থেকে কাজ হচ্ছে না। ফলে এককালীন অর্থ বরাদ্দ করে ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণে আনা সম্ভব নয়।
কীটতত্ত্ববিদ অধ্যাপক কবিরুল বাশার ভোরের আকাশকে বলেন, আমরা মাঠ পর্যায়ে এডিস মশার যে ঘনত্ব বা প্রক্রিয়া ইনডেক্স পেয়েছি, সেটা ২০ এর ওপরে। যা থেকে বলাই যায় এখানে ডেঙ্গু কমবে না। আমাদের ফোরকাস্টিং মডেল অনুযায়ী, পুরো অক্টোবরজুড়েই থাকবে ডেঙ্গুর প্রকোপ। নভেম্বর ও ডিসেম্বরেও ডেঙ্গুর প্রভাব কমবে না।
বিশ্ব পরিস্থিতি ও বাংলাদেশ:
ইসিডিসির সবশেষ তথ্য অনুযায়ী, দক্ষিণ আমেরিকার কয়েকটি দেশে বরাবরের মতো এবছরও ডেঙ্গুর প্রকোপ বেশি। সবচেয়ে বেশি ডেঙ্গু সংক্রমণ হয়েছে এমন ১০টি দেশের মধ্যে সাতটিই দক্ষিণ আমেরিকার। এর মধ্যে আছে ব্রাজিল, পেরু, প্যারাগুয়ে, বলিভিয়া, আর্জেন্টিনা, মেক্সিকো ও কলম্বিয়া।
ব্রাজিলের পর দক্ষিণ আমেরিকার দেশ আর্জেন্টিনায় ডেঙ্গুর সংক্রমণ বেশি। ইসিডিসির সবশেষ তথ্য অনুযায়ী, দেশটিতে এবছর ৫ লাখ ৮০ হাজার ২০০ জনের ডেঙ্গু শনাক্ত হয়েছে, এর মধ্যে মারা গেছেন ৪০৮ জন। মৃত্যুহার ০ দশমিক ০৭ শতাংশ।
মেক্সিকোতে ৫ লাখ ২ হাজার ৭২৩ জনের ডেঙ্গু শনাক্ত হয়েছে, এর মধ্যে মারা গেছেন ২৬২ জন। দেশটিতে মৃত্যুহার ০ দশমিক ০৫ শতাংশ। কলম্বিয়ায় ৩ লাখ ১ হাজার ৪২২ জনের ডেঙ্গু শনাক্ত হয়েছে, এর মধ্যে মারা গেছেন ১৯৮ জন। দেশটিতে মৃত্যুহার ০ দশমিক ০৬ শতাংশ।
পেরুতে মৃত্যুর সংখ্যা কলম্বিয়ার চেয়ে বেশি। দেশটিতে এ পর্যন্ত ২ লাখ ৭৩ হাজার ৮৪৭ জনের ডেঙ্গু শনাক্ত হয়েছে, এর মধ্যে মারা গেছেন ২৫২ জন। দেশটিতে মৃত্যুহার ০ দশমিক ০৯ শতাংশ। এছাড়া প্যারাগুয়েতে ২ লাখ ৯১ হাজার ৮২২ জনের ডেঙ্গু শনাক্ত হয়েছে, এর মধ্যে মারা গেছেন ১২৮ জন। দেশটিতে মৃত্যুহার ০ দশমিক ০৪ শতাংশ।
ভোরের আকাশ/রন
মন্তব্য