সরজমিন হাসপাতালের ৪ তলার অবস্থিত স্পেশালাইজড ডেডিকেটেড ইউনিটে গিয়ে দেখা যায়, ৬৪টি বেডের মধ্যে ৬৩ জন চক্ষুরোগী এখানে ভর্তি। এই ইউনিটটি শুধুমাত্র ছাত্র আন্দোলনে আহতদের চিকিৎসার জন্য রাখা হয়েছে। তাদের মধ্যে প্রায় সবাই অন্তত একবার অপারেশন করিয়েছেন। দুই থেকে তিনবার চোখে অপারেশন হওয়া রোগীর সংখ্যাও অনেক। আবার অনেকেই আসছেন চেকআপ করাতে। চোখ হারিয়ে তারা ভেঙে পড়েছেন। উন্নত চিকিৎসার জন্য দেশের বাইরে অথবা বিদেশ থেকে চিকিৎসক এনে তাদের চিকিৎসার দাবি জানান এসব রোগীরা।
৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকার পতনের দিনে যাত্রাবাড়ী থানা থেকে পুলিশ বের হওয়ার সময়ে আন্দোলনকারীদের ওপরে নৃশংস গুলি চালায়। ওইদিন যাত্রাবাড়ী এলাকায় আন্দোলনকারীদের মধ্যে ছিলেন মো. আমজাদ। পুলিশের গুলিতে দুই চোখই হারান তিনি। ওইদিনের ঘটনার বর্ণনা দিতে গিয়ে তিনি বলেন, ৫ আগস্ট ২টার দিকে সেনাবাহিনী থানা পাহারা দিচ্ছিলেন। পুলিশকে তারা ভেতরে আটকে রাখে। বের হতে দেয়নি। কিন্তু সেনাবাহিনী সরে যাওয়ার পরে পুলিশ থানা থেকে বের হওয়ার জন্য এলোপাতাড়ি গুলিবর্ষণ শুরু করে। প্রথমে আমাকে পায়ে গুলি করে, আমি সেখানেই শুয়ে পড়ি। তারপর পুলিশ আমার পেছনে ও সামনে এক রাউন্ড করে দুই রাউন্ড গুলি করে। সামনে গুলি করার সময়ে আমার চোখে ছররা গুলি লাগে। তখনই আমি অন্ধ হয়ে যাই। সেখান থেকে ছাত্র ভাইয়েরা আমাকে উঠিয়ে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে যায়। ওখানে অনেক সিরিয়াল থাকায় রাত ৯টায় আমাকে হেলথকেয়ার হাসপাতালে ভর্তি করে। হেলথকেয়ার হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ আমজাদের পায়ের ভেতরে থাকা গুলি বের করে দেয়ার জন্য ১ লাখ ২০ হাজার টাকা চায়। এই ব্যয় বহন করতে না পেরে তার পরিবার নোয়াখালী নিতে বাধ্য হন। সেখানে ২৫ হাজার টাকার বিনিময়ে তার পায়ের গুলি বের করা হয়। আমজাদ বলেন, সেখান থেকে চোখের চিকিৎসার জন্য চট্টগ্রাম পাহাড়তলী গেছি। সেখানে আমাদের অবস্থা খারাপ দেখে ভর্তি নেয়নি। এরপর চকবাজার সরকারি মেডিকেলে পায়ের চিকিৎসা নেই। পরে তারা রেফার্ড করে ঢাকা মেডিকেলে পাঠায়। ঢাকা মেডিকেল থেকে সমন্বয়করা ১৫ই আগস্ট আমজাদকে চক্ষুবিজ্ঞান ইনস্টিটিউটে ভর্তি করিয়ে দেয়। ভর্তির ৩ দিন পরে তার অপারেশন হলেও চোখে আলো ফিরে আসে না। ১৫ দিন সেখানে ভর্তি থাকার পরে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ তাকে রিলিজ করে দেয়। আমজাদ বলেন, ৯ দিন হলো এখানে আছি। দুইটা ড্রপ দিয়েছে শুধু। আমি দুই চোখের এক চোখেও কিছু দেখি না। হাসপাতাল থেকে বলছে - বাইরে থেকে ডাক্তার আসলে আমাদের আবার ডাকবে। চোখের কর্নিয়া আর ভালো ডাক্তার পেলে হয়তো চোখটা একটু ভালো হবে। প্রথমে অপারেশন করার আগে একটু ঝাপসা দেখতাম, অপারেশনের পরে কিছুই দেখি না।
আমজাদের গ্রামের বাড়ি নোয়াখালীর কবিরহাটে। ক্লাস ফাইভ পাস করে পরিবারের হাল ধরেন তিনি। গুলিস্তানের নগর প্লাজায় গেঞ্জির দোকানে চাকরি করতেন তিনি। আমজাদ বলেন, আমার বাবা ৪ বছর আগে মারা গেছে। আমার ইনকামে আমিসহ মা, ছোট ভাই ও বোনের ভরণপোষণ হতো। ছোট ভাই এখন ওই দোকানে কাজ করে। আমজাদের মা আহাজারি করে বলেন, ওর জন্য আমি ১ লাখ ৯০ হাজার টাকা লোন করছি। ওর বাবা মারা যাওয়ার পর পরিবারের কোনো কষ্ট বুঝতে দেয় নাই। ওর কোনো ভবিষ্যৎ নাই। সরকার থেকে এখনো আমজাদকে কোনো ধরনের সাহায্য করা হয়নি উল্লেখ করে আমজাদ বলেন, জুলাই-আগস্ট স্মৃতি ফাউন্ডেশনে আবেদন করা হয়েছে। তবে এখনো কোনো অর্থ পাইনি।
৪ আগস্ট গাজীপুরে ছাত্র-জনতার আন্দোলনে অংশ নেয় ওমর ফারুক। ওইদিন আনসারের গুলিতে দু’টি চোখ হারান তিনি। ওমর ফারুক বলেন, ওইদিন ৭০০-৮০০ আনসার সদস্যের সঙ্গে প্রায় হাজার থেকে ১২০০ ছাত্র-জনতার ধাওয়া-পাল্টা ধাওয়া হয়। তবে আশেপাশে ২০ থেকে ৩০ হাজার মানুষ দাঁড়িয়ে ছিল। আমরা যখন শান্তিপূর্ণভাবে একাডেমির সামনে থেকে অতিক্রম করছিলাম, তখন ৭০০ থেকে ৮০০ জন আনসারের সবাই আমাদের ওপরে গুলি চালায়। প্রথম রাউন্ডের গুলি আমার ঘাড়ে ও পিঠে লাগে। আমি মনে করছি, পরে আর গুলি চালাবে না। আমি তখন দুই হাত উপরে করে সারেন্ডার করি। তাদের কমান্ডারকে আমি যখন ফেস করি তখন সবাই আমার দিকে গুলি ছোড়ে। আমি তখন মুখ থুবড়ে রাস্তায় পড়ে যাই। তখন মনে হয় আমার ৭ থেকে ১২ সেকেন্ডের মতো জ্ঞান ছিল। এখনো আমার দাঁতগুলো নড়ে। বুলেটের তীব্রতা এত ছিল যে, মনে হচ্ছিলো আমার গায়ে বৃষ্টিপাত হচ্ছিল। ওইদিন ওমর ফারুককে জিরানীতে অবস্থিত শেখ ফজিলাতুন্নেছা হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়। তিনি বলেন, সেখানে আমাকে একদিন রাখা হয়। তারা শুধু আমার রক্তগুলো পরিষ্কার করে আর দুইটা স্যালাইন দেয়। কোনো ধরনের চিকিৎসা না করেই তারা ১০ হাজার ৮০০ টাকা বিল করে। সেখান থেকে এক বড় ভাই জীবনের বাজি নিয়ে আমার ছোট ভাইসহ আমাকে সাভারে নিয়ে আসে। ৪ আগস্ট থেকে ৬ আগস্ট পর্যন্ত আমার চোখ থেকে অনবরত রক্ত পড়েছে। ৬ আগস্ট এই হাসপাতালে আমার চোখে প্রথম সার্জারি হয়।
ওমর ফারুক বলেন, বুলেট লাগার পরে ২০ আগস্ট পর্যন্ত আমার ডান সাইড প্যারালাইজড ছিল। হুইলচেয়ারে আমি যাতায়াত করতাম। বাথরুমে বসলেও আমাকে ধরে রাখতে হতো। ডাক্তাররা বললো - যে আমি যদি কষ্ট করে হাঁটতে পারি, তাহলে ধীরে ধীরে এই অবস্থার পরিবর্তন ঘটবে। ৩০ আগস্ট থেকে আমি মোটামুটি হাঁটতে পারি। ৩১ আগস্ট আমাকে রিলিজ দেয়া হয়। তখন এই হাসপাতাল থেকে ডাক্তার আমাকে বলে যে, আমার চোখে আর কখনো আলো ফিরবে না। সেপ্টেম্বরের ৪ তারিখে আমি আবার সিএমএইচ-এ ভর্তি হই। এখন আমি আলো জ্বললে আর নিভলে বুঝতে পারি। তৃতীয় মেয়াদে চক্ষুবিজ্ঞান ইনস্টিটিউটে ৭ নভেম্বর আবারো ভর্তি হন তিনি।
ওমর ফারুক বলেন, আমার চোখে সবমিলিয়ে গুলি লাগছে ১২টা। বাম চোখে ৫টা, ডান চোখে ৭টা। আমার মাথায় অগণিত গুলি লেগেছে, এখনো সেখানে ৪২টা গুলি আছে। পুরো শরীরে প্রায় ১০০টার মতো ছররা গুলি আছে। ডাক্তার বলেছে- আমার ডান চোখে আর দেখতে পাবো না। বাম চোখে দৃষ্টি ফেরার সম্ভাবনা আছে। যদি বিদেশে উন্নত চিকিৎসা দেয়া হয় অথবা বাইরে থেকে ডাক্তার এনে চিকিৎসা দেওয়া হলে চোখের দৃষ্টি বাড়তে পারে। আমরা চাই, দৃষ্টি না ফিরলে একটা পুনর্বাসনের ব্যবস্থা করা হোক। উন্নত চিকিৎসার জন্য আগস্ট মাস থেকে আমরা বলছি। ওমর ফারুক বগুড়া পলিটেকনিক ইনস্টিটিউটের চতুর্থ সেমিস্টারে ইলেকট্রনিক্স ডিপার্টমেন্টে অধ্যয়ন করেন। তার গ্রামের বাড়ি বগুড়ার শিবগঞ্জে। তিনি বলেন, আমার চিকিৎসার জন্য এনজিও থেকে ঋণ করা হয়েছিল। এখন এনজিও থেকে আমাদের অনেক চাপ দিচ্ছে। এটা মওকুফ করলে অনেক ভালো হতো।
১৯ জুলাই পল্টনে বিজয়নগর পানির ট্যাংকির সামনে পুলিশের গুলিতে চোখে আঘাতপ্রাপ্ত হন ইয়ামিন শেখ। পুলিশের ছোড়া ছররা গুলি তার এক চোখের দৃষ্টি কেড়ে নেয়। ওইদিনের ঘটনার বর্ণনা দিয়ে ইয়ামিন বলেন, আমরা শান্তিপূর্ণভাবে আন্দোলন করছিলাম। হঠাৎ সিভিল ড্রেস পড়ুয়া কেউ কেউ আমাদের টিয়ারশেল নিক্ষেপ করে। তারপর আমরা ছোটাছুটি শুরু করি। পেছনের গলি থেকে ছাত্রলীগ আমাদের ওপরে হামলা চালায়। এরপর অন্য একটি রোড দিয়ে বের হতে গিয়ে দেখি পুলিশ। তিন দিক থেকে তারা আমাদের ওপরে হামলা করে। সবাই সবার মতো সটকে পড়ি। একটা ব্যাংকের সিঁড়ি দিয়ে আমরা উঠে যাই। আমার সঙ্গে ৪ থেকে ৫ জন বন্ধু ছিল। একসঙ্গে নামার সময়ে পুলিশ আমাদের ওপরে দুটি গুলি চালায়। আমার এক বন্ধুর মাথার পেছন দিয়ে বুলেট ঢুকে সামনে দিয়ে বেরিয়ে যায়। সঙ্গে সঙ্গেই ও রাস্তায় পড়ে যায়। ওকে আমরা তুলতে গেলে পুলিশ আমাদের লক্ষ্য করে ইচ্ছামতো ছররা গুলি নিক্ষেপ করে। আমি সবার সামনে ছিলাম, পুলিশের গুলি আমার ডান চোখের মধ্যে ঢুকে যায়। এরপর ওইদিনই আমাকে বন্ধুরা এই হাসপাতালে নিয়ে আসে।
গুলিতে ইয়ামিনের ডান চোখের রেটিনা ৯৫ শতাংশ নষ্ট হয়ে যায়। তার এই চোখের চিকিৎসা আর কোথাও সম্ভব নয় বলে জানিয়েছেন চিকিৎসক। ইয়ামিন অশ্রুসিক্ত কণ্ঠে বলেন, আমার চোখে ওয়েল দেয়া আছে। ডাক্তার বলেছেন- চোখ ভেতরে চলে যাবে। আমার মুখের আকৃতিও আস্তে আস্তে নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। প্রথমদিকে আমাকে এই হাসপাতালে ভালো চিকিৎসা দেয়া হয়নি। এখান থেকে ইসলামীয়া হাসপাতালে একবার ভর্তি হই। আমার মুখে অনেকগুলো গুলি ঢুকে আছে। এখানে আবারো ২০ দিনের বেশি সময় ভর্তি হয়েছি। ইয়ামিনের পরিবার কেরানীগঞ্জে একটি বাসায় ভাড়া থাকেন। এ বছরই তিনি এসএসসি পাস করেছেন। সুস্থ হওয়ার পরে আবারো কলেজে ভর্তি হবেন বলে আশা ব্যক্ত করেন তিনি। বলেন, ২১ তারিখে আমার বাবাকে হাসপাতালে ভর্তি করাতে হবে। তার ওপেন হার্ট সার্জারির জন্য লাগবে অনেক টাকা। পড়াশোনার পাশাপাশি আমি ফ্রিল্যান্সিং করতাম। এখন পরিবারের সব ইনকাম বন্ধ হয়ে গেছে।
ভোরের আকাশ/রন
মন্তব্য