logo
আপডেট : ২৯ ডিসেম্বর, ২০২১ ১৭:৪৯
আন্দ্রেই কোলেসনিকভ
রাশিয়ার জনগণ কেন সোভিয়েত যুগে ফিরতে ব্যাকুল
অনলাইন ডেস্ক

রাশিয়ার জনগণ কেন সোভিয়েত
যুগে ফিরতে ব্যাকুল

১৯৯১ সালের আগস্ট মাসের অভ্যুত্থানচেষ্টার পর সোভিয়েত ইউনিয়ন কার্যত অপ্রাসঙ্গিক হয়ে পড়ে।

সোভিয়েত ইউনিয়নের পতন হয়েছিল নীরবে। সেদিন মনে হচ্ছিল, ঘড়ির কাঁটা থমকে গেছে।

১৯৯১ সালের ২৫ ডিসেম্বর মিখাইল গর্ভাচেভ জাতির উদ্দেশে ভাষণে পদত্যাগের ঘোষণা দেন। একই দিন সন্ধ্যা ৭টা ৩০ মিনিটের একটু পরে ক্রেমলিনের প্রেসিডেন্ট ভবন থেকে সোভিয়েত ইউনিয়নের পতাকা নামিয়ে ফেলা হয় ফ্ল্যাগ স্ট্যান্ড থেকে। পরের পাঁচ মিনিট পতাকার খুঁটি খালিই পড়েছিল, যা রূপক অর্থে রাশিয়ায় ক্ষমতার পালাবদলকে নির্দেশ করছিল। সেদিন রাত পৌনে ৮টার দিকে রাশিয়ার তিন রঙা পতাকা ওড়ানো হয়। পরদিন সোভিয়েত ইউনিয়ন আনুষ্ঠানিকভাবে বিলুপ্ত ঘোষণা করা হয়।

সোভিয়েত সাম্রাজ্যের এই বিলুপ্তির সঙ্গে সঙ্গে সোভিয়েত ইউনিয়নের স্মৃতি, আমার জন্ম থেকে বেড়ে ওঠার ২৬ বছরের স্মৃতি শুধু স্মৃতি হয়েই থাকল। একইসঙ্গে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে আমার পরিবারের ক্ষয়ক্ষতি এবং জোসেফ স্ট্যালিনের ভয়ংকর শাসনব্যবস্থারও অবসান হয়। আমার স্বীকার করতেই হয়, রাশিয়ার পতকার খুঁটি যখন খালি পড়েছিল, তখন আমার তেমন খারাপ কোনো অনুভূতি হয়নি।

১৯৯১ সালের আগস্ট মাসের অভ্যুত্থানচেষ্টার পর সোভিয়েত ইউনিয়ন কার্যত অপ্রাসঙ্গিক হয়ে পড়ে। গর্ভাচেভ তখন ক্ষমতায় থাকলেও তার কোনো নিয়ন্ত্রণ ছিল না। মন্ত্রী ও রাজ্যের নেতারা খাবার সরবরাহ ব্যবস্থা এবং দুর্ভিক্ষ নিয়ে উদ্বেগজনক চিঠি চালাচালি করছিলেন। রাশিয়ায় সেই সময় একটি নতুন সরকার ব্যবস্থার চেষ্টা চলছিল।

একজন উদীয়মান সাংবাদিক হিসেবে, আমি এই পরিবর্তনের ব্যাপারে আগ্রহী ছিলাম। রাষ্ট্রযন্ত্রে কী কী সংস্কার হচ্ছে, তা আমি নিয়মিত আমার পত্রিকায় লিখতাম। আর আমার বড়ভাই রাশিয়ার প্রধান সংস্কারক ইয়েগর গাইদারের পরামর্শক হন, যিনি পরবর্তী সময়ে প্রধানমন্ত্রী হয়েছিলেন।

ক্ষমতা কাঠামোর পালাবদলের ওই কঠিন সময়ে জনগণের মধ্যে যে আশার সঞ্চার হয়েছিল তা পরের বছরগুলোতে ধীরে ধীরে নিরাশায় পরিণত হতে থাকল। অধিকাংশ মানুষের মধ্যে এই ধারণা হলো যে, পুঁজিবাদ তাদের জীবনে সুখ বয়ে আনেনি।

বিভিন্ন সমস্যা থাকা সত্ত্বেও ১৯৯৩ সালের বসন্তে জনগণ সংস্কার এগিয়ে নেওয়ার জন্য গণভোটে রায় দিয়েছিল। সেই বছরের শরতে সংস্কারবাদী দল ভাইবর রসি নতুন সংসদে বৃহত্তম জোট গঠনে সক্ষম হয়। এটি ছিল রাশিয়ার রাজনীতিতে উদারপন্থিদের সর্বশেষ সুযোগ।

সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের তিন বছরেরও কম সময়ের মধ্যে ১৯৯৪ সালে সমাজবিজ্ঞানীরা ইউরি লেভাদার নেতৃত্বে রাশিয়ায় পরিবর্তন লক্ষ্য করছিলেন। ব্যবসা-বাণিজ্যে ঝুঁকি থাকায় সাধারণ মানুষ ব্যবসা-বাণিজ্যের তুলনায় চাকরিকে প্রাধান্য দিতে শুরু করল।

সময় গড়ানোর সঙ্গে সঙ্গে রাশিয়ার উল্লেখযোগ্য সংখ্যক মানুষ অতীতের স্মৃতি মনে করে যন্ত্রণা অনুভব করতে শুরু করল। টেলিভিশনে নববর্ষের বিভিন্ন অনুষ্ঠানে সোভিয়েত আমলের গান গাওয়া হতো। রেস্তোরাঁয় রেস্তোরাঁয় জনপ্রিয় হয়ে উঠতে লাগল সোভিয়েত আমলের খাবারদাবার।

কিন্তু কেউই ২০০০ সালের আগ পর্যন্ত সোভিয়েত যুগে ফিরে যাওয়ার কথা কেউ গুরুত্বের সঙ্গে ভাবেনি। নতুন প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন রাশিয়ার নাগরিকদের সোভিয়েত যুগে ফেরার এই আকাক্সক্ষাকে গুরুত্ব দিয়ে কর্মকাণ্ড শুরু করেন। এর অংশ হিসেবে তিনি সোভিয়েত যুগের জাতীয় সংগীতের একটি সংস্করণ পুনরায় চালু করেন, যা এখনো রাশিয়ায় চলছে।

পুতিনের ‘সোভিয়েত ভূতের পুনরুত্থান’ কর্মকাণ্ড এখানেই থেমে থাকেনি। ২০০৫ সালে এক ভাষণে পুতিন সোভিয়েত ইউনিয়নের ভাঙনকে ২০ শতকের ‘সবচেয়ে বড় রাজনৈতিক বিপর্যয়’ বলে অভিহিত করেন। এর দুই বছর পর তিনি মিউনিখে আরেক বক্তৃতায় পশ্চিমাদের কাছে রাশিয়ার অপমানিত হওয়ার বিষয়টি সামনে আনেন। তার এসব বক্তব্য যেন ‘রাশিয়াকে আবার মহান করা’র পরিকল্পনারই অংশ।

পুতিনের এসব বক্তব্য তখন রাশিয়ার জনগণ তেমন পাত্তা দেয়নি। কারণ তারা তখন রাজনীতি নিয়ে তেমন মাথা ঘামাচ্ছিলেন না। বরং তারা অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির পুনরুদ্ধার এবং ২০০০-এর দশকে তেলের উচ্চমূল্যের বিষয়টি উপভোগ করছিলেন।

প্রথমবার ক্ষমতায় আসার পর পুতিনের জনপ্রিয়তা হ্রাস পেতে শুরু করলে মনে করা হচ্ছিল, রাশিয়ার রাষ্ট্রব্যবস্থায় আধুনিকায়ন অনিবার্য। অবশ্য ২০০৮ সালে রাশিয়ার সঙ্গে জর্জিয়ার সংক্ষিপ্ত যুদ্ধ তার জনপ্রিয়তাকে কিছুটা বাড়িয়ে দিয়েছিল।

২০১২ সালে শহুরে শ্রেণির অভূতপূর্ব প্রতিবাদের মুখে পুতিন অতি-রক্ষণশীল নীতি গ্রহণ করা শুরু করেন। তখন সোভিয়েত ইতিহাসের কথিত গৌরবগাথা তার প্রচারের অন্যতম প্রধান উপাদান হয়ে ওঠে। ২০১৪ সালে রাশিয়ার ক্রিমিয়া দখলকে হারানো ‘সাম্রাজ্য পুনরুদ্ধারের’ অংশ হিসেবে বিবেচনা করা হয়েছিল।

সোভিয়েত আমলের সাম্রাজ্যবাদী অনুভূতি রাশিয়ার বেশিরভাগ মানুষের মনে এখনো সুপ্তভাবে জ্বলছে এবং পুতিন তাদের এই অনুভূতিকে কাজে লাগাচ্ছেন।

ক্রিমিয়ার প্রভাব পুরাতন হতে শুরু করলে পুতিন সোভিয়েত যুগের বিভিন্ন সাফল্যের কথা সামনে আনতে শুরু করেন। স্ট্যালিনের আমলের ‘মহান দেশপ্রেম যুদ্ধ’-কে বিজয় এবং শৃঙ্খলার কারণ হিসেবে তুলে ধরতে শুরু করেন।

২০২১ সালে স্বাধীন লেভাদা সেন্টারের এক জরিপে দেখা গেছে, রাশিয়ার ৪৯ শতাংশ মানুষ সোভিয়েত আমলের রাজনৈতিক ব্যবস্থার পক্ষে রয়েছে। রাশিয়ার ৫০টি রাজ্যের ১ হাজার ৬০৩ প্রাপ্তবয়স্ক নাগরিকের ওপর চালানো এই জরিপের ফল প্রকাশিত হয় গত সেপ্টেম্বর মাসে।

রাশিয়ার জনগণ এখন একটি ন্যায়ভিত্তিক সমাজের স্বপ্ন দেখছে। যদিও তাদের সামনে সোভিয়েত ইউনিয়ন ছাড়া অন্য কোনো মডেল নেই। কাল্পনিক ইউএসএসআর রাষ্ট্রব্যবস্থা এখনো পুতিনকে বিভিন্ন উপায়ে সহায়তা করলেও তার জনপ্রিয়তা কমছেই।

মস্কোয় গত ডিসেম্বরে ঐতিহ্যবাহী হকি টুর্নামেন্টে রাশিয়ার দলের সবাই সোভিয়েত যুগের ইউনিফর্ম পরে বরফে খেলতে নেমেছিলেন। দর্শকরাও তখন সোভিয়েত পতাকা নাড়ছিলেন। সোভিয়েত পতাকা আনুষ্ঠানিকভাবে নামানোর তিন দশক পরে এই পতাকা রাশিয়ার মানুষের জীবনে বড় প্রভাবক হিসেবে দেখা দিয়েছে।


সিএনএনে প্রকাশিত রাশিয়ার সংবাদিক আন্দ্রেই কোলেসনিকভের মন্তব্য প্রতিবেদনের ভাষান্তর।