logo
আপডেট : ৬ জানুয়ারি, ২০২২ ১৯:৩৬
‘চাদর আওলা ফুরুত ফারুত, গজি আওলা কোঁতে, খ্যাতা আওলা ফুকুর ফুকুর হাসে ’
নজরুল ইসলাম রাজু, রংপুর

‘চাদর আওলা ফুরুত ফারুত, গজি আওলা কোঁতে, খ্যাতা আওলা ফুকুর ফুকুর হাসে ’

রংপুরের ঐতিহ্যবাহী তাজহাট জমিদার বাড়ি

দেশের ৬৪ জেলার ভাষা বাংলা হলেও প্রত্যেকের রয়েছে নিজ নিজ আঞ্চলিক ভাষা। ‘আঞ্চলিক ভাষা’ এমন একটি ভাষা যার মাধ্যমে পাওয়া যায় একজন মানুষের শেকড়ের পরিচয়, যার মাধ্যমে বলা যায় মনের কথা। এই আঞ্চলিক ভাষা আমাদের অনেকেরই চিরচেনা।


জানা যায়, একজন মানুষের বেড়ে ওঠা, অতীত এবং বর্তমান খুব সহজেই চেনা যায় তার ভাষার মাধ্যমে, বোঝা যায় সে কোন অঞ্চলের বা কোন জেলার মানুষ। দেশের উত্তরবঙ্গের রংপুর অঞ্চলেও রয়েছে আঞ্চলিক ভাষা। মায়ের শেখানো এ ভাষায় কথা বলে প্রাণ খুঁজে পায় এখানকার মানুষ। কিন্তু বর্তমানে আঞ্চলিক ভাষা ছেড়ে প্রমিত বাংলা ভাষায় ঝুঁকে পড়েছেন রংপুরের মানুষ। হারিয়ে যাচ্ছে, তুই, মুই, বাহে প্রভৃতি শব্দগুলো। হারিয়ে যাচ্ছে প্রবাদ/প্রবচনও- শ্বশুর বাড়ি মধুর হাঁড়ি, তিন দিন বাদ ঝাটার বাড়ি। গুডু গুডু হাফ মুই তোর বাপ। যদি বইষ্যে পুষে, কড়ি হয় তুষে। ষ্যে আগনে, রাজা যায়-মাগনে। এই ভাষা আর পাওয়া যায় না।


ভাওয়াইয়া শিল্পী রঞ্জিত রায় জানান, ‘চাদর আওলা ফুরুত ফারুত, গজি আওলা কোঁতে, খ্যাতা আওলা ফুকুর ফুকুর হাসে। বর্তমানে হারাতে বসেছে মেয়েলী খেলাধুলার মাধ্যমে রংপুরী ভাষায় ছড়া কাটার প্রচুর নির্দশনও। যেমন- ইকরি বিকরি চাম চিকরি। চামের আগায় দিনু পটি, আয় গোয়ালী ভাত খাই, না খাও তোর হাতে গবরি গবরি গোন্ধায়, এ্যাল পাত, ব্যাল পাত, ছিড়ি ন্যাংটি তোল এক হাত। আগে এই ভাষায় ভাওয়াইয়া গান গাইতাম। হকি গাড়িয়াল ভাই। বাড়ির পাশে ব্যাতের আড়াসহ অসংখ্য গান।’


রংপুরের মিঠাপুকুরের আমির হোসেন বলেন, ‘আমরা যা করবো একটা বাচ্চা তাই শিখবে। আমরা যদি তার শুরুটাই আঞ্চলিক ভাষা দিয়ে করি। তখন দেখা যাবে বাচ্চাদের শুদ্ধ ভাষা শিখানো আমাদের অনেক কঠিন হয়ে যাবে। তখন তার বাইরে পড়ালেখা করতে গিয়ে, কাজ করতে গিয়ে অনেক ঝামেলা হবে, লজ্জায়ও পরতে পারে। এই কারণে আমি চেষ্টা করি বাচ্চাকে আগে প্রমিত বাংলা শেখাতে। রংপুরের আঞ্চলিক ভাষা যুগ-যুগ ধরে চলে আসলেও কিন্তু এখন তা আস্তে আস্তে বিলুপ্তির পথে। তবে গ্রাম অঞ্চলে এখনো আছে মুই, তুই, কোনটে বাহে, কি করেন, কি আয় চল যাই চলছো। মুখদে, তুই আয়, তুই খা, কোনটি ও নানাবিধ আঞ্চলিক ভাষা ছিল এ অঞ্চলে। কথাগুলো বলেছিলেন রংপুরের তারাগঞ্জ উপজেলার ইকরচালি গ্রামের মোকলেছার রহমান।


রংপুরের গঙ্গাচড়া উপজেলার চর এলাকার রফিকুল ইসলাম জানান, মই, কাম করি, বাড়ির সবাইকে খাইচে, মুই সারা দিন একশ ট্যাকা পাইছো। ওই ট্যাকা আনি মুই হাঁটুত গেইছ আর খরছ আনচ। (রফিক সারাদিন শ্রমিকের কাজ করে একশ টাকা পেয়েছিল। তা দিয়ে বাজার থেকে খরচ এনে বাড়ির সবাই মিলে খেয়েছে।) তারাগঞ্জের আব্দুল হাফিজ একই ভাষায় কথা বলে জানান, আঞ্চলিক ভাষা বিলুপ্ত হয়ে যাচ্ছে। এখন মানুষ অনেক শিক্ষিত হয়েছে। তাই আঞ্চলিক ভাষায় কথা বলে না।


বীর মুক্তিযোদ্ধা মোসাদ্দেক আলী বাবলু জানান, রংপুরের মেয়েলী গীতের মধ্যেও রয়েছিল অজস্র আঞ্চলিক ভাষা। তবে এখন আর এসবের চর্চা তেমন একটা হয় না। যেমন- বিয়ের সময় বর বা কনেকে হলুদ মাখানো হয়। এ সময়ের গীত- ফোরল ডুববার গেনু মা মুই, কুমোর পাড়া দিয়া, ব্যারাও রই কুমারের মাইয়া, হাতত দিয়ার নিয়া। এছাড়া এখন আর তেমন একটা শোনা যায়না রাখালের কণ্ঠে রংপুরের আঞ্চলিক ভাষার ভাওয়াইয়া গন।


এখন মা-বাবা আর ভাইবোনদের সঙ্গে সীমিত পরিসরে নিজ জেলার আঞ্চলিক ভাষায় কথা বললেও সন্তানের সঙ্গে সচেতনভাবেই সব সময় প্রমিত বাংলায় কথা বলার চেষ্টা করেন অনেকে। এর প্রধান কারণ, যেন তাদের সন্তানেরা আধুনিক পরিবেশের সঙ্গে খাপ খাইয়ে নিতে পারে এবং তার কথায় যেন আঞ্চলিকতার টান না থাকে। কিন্তু আধুনিকতার ছোঁয়ায় এখন হারিয়ে যাচ্ছে বৃহত্তর রংপুর অঞ্চলের আঞ্চলিক ভাষা। আঞ্চলিক এই ভাষা সংরক্ষণে কারোরিই নজর নেই।


শিক্ষাবিদ ড. তুহিন ওয়াদুদ জানান, কালের বির্বতনে আধুনিকতার ছোঁয়ায় যেন হারিয়ে যাচ্ছে ঐতিহ্যবাহী এ আঞ্চলিক ভাষা। প্রমিত বাংলার সঙ্গে সঙ্গে পার্শ্ববর্তী দেশের কৃষ্টি-কালচার এসে হ-য-ব-র-ল অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে। রংপুরের অনেক অভিভাবক সন্তানদের গড়ে তুলছেন ভালো পরিসরে। এ কারণে সেসব সন্তানেরা আঞ্চলিক ভাষা আর বলার চেষ্টা করে না। ফলে শিশুরাও বঞ্চিত হচ্ছে নিজ এলাকার আঞ্চলিক ভাষা শেখা থেকে।

ভাষাবিদরা মনে করছেন, এখনি সময় আমাদের হারিয়ে যাওয়া ঐতিহ্যবাহী আঞ্চলিক ভাষা সংরক্ষণের। যদি যথাযথভাবে এর সংরক্ষণ না করা হয়, তাহলে বিলুপ্ত হতে পারে এ আঞ্চলিক ভাষা।


বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, আঞ্চলিক ভাষা বিলুপ্ত হওয়া থেকে রক্ষা করতে হলে এটা শুধু পাঠ্যপুস্তকে সীমাবদ্ধ রাখলেই হবে না। আমাদের সমাজে নানারকম সাংস্কৃতিক ও বিনোদনমূলক অনুষ্ঠান আয়োজনের প্রয়োজন। তা না হলে আগামী কয়েক বছর পর রংপুরের আঞ্চলিক ভাষা খুঁজে পাওয়া দুস্কর হবে।


জেলা প্রশাসক আসিব আহসান জানান, রংপুরের আঞ্চলিক ভাষা হারিয়ে যাচ্ছে। এর মূল কারণ- মানুষ বিভিন্ন শিক্ষায় শিক্ষিত হচ্ছে। এ কারণে বাংলাদেশ এখন অনেক উন্নত। মানুষ বিভিন্ন অফিস আদালতে চাকরি করছেন। আর সবক্ষেত্রে আঞ্চলিক ভাষা বলতে না পারাটাই এ ভাষা হারিয়ে যাওয়ার আসল কারণ।

 

ওএফএস