এখনকার ঘটনাপ্রবাহ দেখে মনে হয়, আমরা আজকাল সোভিয়েত নেতা লিওনিড ব্রেজনেভের যুগে ফিরে যাচ্ছি। রাশিয়ার জাতীয় টিভি চ্যানেল রাশিয়া-১ এবং ফার্স্ট চ্যানেলের সংবাদ দেখে মনে হয় আমাদেরকে ১৯৭০ সালে নিয়ে যাচ্ছে
যুদ্ধবাজদের উত্তেজনাকর বক্তব্য ফিরে এসেছে সেই সাথে পশ্চিমাদের সমালোচনা, ১৯৭৬ সালের ক্ল্যাসিক সিনেমা আইরনি অব ফেইটের চিত্রায়ণ, ১৯৬৭-এর কমেডি সিনেমা কিডনাপ এবং ১৯৬৯ সালের ককেশিয়ান ঘরানার মারদাঙ্গা হিট সিনেমা ডায়মন্ড আর্মস।
সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের ৩০তম বার্ষিকীতে এসে রাশিয়ার জনগণের পুরানো দিনের সামাজিক শৃঙ্খলা এবং স্থিতিশীলতার কথা সবচেয়ে বেশি মনে পড়ছে।
বর্তমানে মস্কোর বৈদেশিক নীতিতেও সোভিয়েত যুগের প্রভাব লক্ষ্য করা যাচ্ছে।
যুক্তরাষ্ট্র-রাশিয়ার মধ্যে অনুষ্ঠেয় শীর্ষ সম্মেলনগুলোয় শীতলযুদ্ধের আভাস লক্ষ্য করা যায়। ৩০ ডিসেম্বর যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন এবং রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন টেলিফোন আলাপে ইউক্রেন উত্তেজনা নিয়ে আলোচনা করেন। দুই নেতা এই টেলিফোন আলাপে একে অপরের দিকে হুঁশিযারি উ”চারণ করেন এবং যদিও বলা হচ্ছে আলোচনার সুর সামগ্রিকভাবে ‘গঠনমূলক’ ছিল।
ছয় মাস আগে তারা জেনেভায় মুখোমুখি বৈঠক বসেছিলেন এবং যার ফলস্বরূপ যুক্তরাষ্ট্র এবং রাশিয়া নিজ দেশের রাষ্ট্রদূতদের তাদের আগের কর্মস্থলে ফিরিয়ে আনে।
বিভিন্ন সমস্যা থাকা সত্ত্বেও দুই দেশের মধ্যে সরকারি পর্যায়ে যোগাযোগ বেড়েছে। গত বছর নভেম্বরের শুরুতে সিআইএ পরিচালক এবং রাশিয়ায় নিযুক্ত যুক্তরাষ্ট্রের সাবেক রাষ্ট্রদূত উইলিয়াম বার্নস মস্কো ভ্রমণ করেন এবং তিনি পুতিন, রাশিয়ার নিরাপত্তা পরিষদের সেক্রেটারি নিকোলাই পাত্রুশেভ এবং বৈদেশিক গোয়েন্দা সার্ভিসের প্রধান সের্গেই নারিশকিনের সাথে দেখা করে ইউক্রেনের উত্তেজনা নিয়ে আলোচনা করেন।
যুক্তরাষ্ট্রের জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা জ্যাক সুলিভেন পুতিনের বৈদেশিক নীতি দেখভালকারী ইউরি উশাকভের সাথে যোগাযোগ রক্ষা করে চলছেন। ক্রেমলিনের জন্য বাইডেনের দৃষ্টি আকর্ষণ করা একটি সফলতা। ইউক্রেন সীমান্তে সৈন্য সমাবেশ এবং সেনা অভিযানের হুমকি মনে হচ্ছে কাজে দিয়েছে।
গত ছয় বছর যাবৎ ইউক্রেনে চলমান অচলাবস্থা মস্কোকে হতাশ করেছে। ২০১৫ সালে ফ্রান্স ও জার্মানির মধ্যস্থতায় করা মিনস্ক-২ চুক্তি ইউক্রেনে শান্তি ফেরাতে ব্যর্থ হয়েছে।
কিয়েভ এবং মস্কো উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি না হওয়ার জন্য একে অপরকে দায়ী করছে। রাশিয়া দাবি করছে যে, ইউক্রেন সাংবিধানিক পরিবর্তনের যে প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল তা বাস্তবায়ন করেনি। সাংবিধানিক এই পরিবর্তনের মাধ্যমে স্বঘোষিত ডোনেটস্ক এবং লুহানস্ক পিপলস রিপাবলিককে মূল স্রোতে আনার ব্যবস্থা করা হয়েছে রাশিয়ার সাথে করা চুক্তিতে। অন্যদিকে কিয়েভ দাবি করছে রাশিয়া, ইউক্রেন-রাশিয়া সীমান্তে কিয়েভের নিয়ন্ত্রণ আরোপ করতে দিচ্ছে না।
এই অচলাবস্থা কাটিয়ে ওঠার জন্য ক্রেমলিন প্যারিস এবং বার্লিনকে ডিঙ্গিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের মাধ্যমে একটি নতুন চুক্তি করতে চায়। এই চুক্তির ধারণাটি হলো এমন যে, ইউক্রেনের রাষ্ট্রপতি ভলোদিমির জেলেনস্কি রাশিয়া-যুক্তরাষ্ট্রের চুক্তিটিতে হা ছাড়া অন্যকিছু বলার উপায় থাকবে না।
রাশিয়ার করা একটি খসড়াতে বলা হয়, ন্যাটোকে তার পূর্ব সীমান্তের দেশগুলোয় বৃহৎ আকারের সৈন্য সমাবেশ বন্ধ করতে হবে যেটা ন্যাটো ২০১৪ সাল থেকে ক্রিমিয়া দখলের পর করে আসছে।
মস্কো ন্যাটোর কাছ থেকে আরো নিশ্চয়তা চায়, তারা রাশিয়ার সীমান্তে মাঝারি পাল্লার ক্ষেপণাস্ত্র মোতায়েন করবে না।
এই খসড়া প্রস্তাবে আরো দাবি করা হয়, ইউক্রেনকে সামরিক সাহায্য যেটা যুক্তরাষ্ট্র ও ন্যাটোর মাধ্যমে প্রদান করা হয়, তা বন্ধ করতে হবে এবং একই সাথে সোভিয়েতভুক্ত দেশগুলোর সাথে সামরিক অনুশীলন বন্ধ করতে হবে। এসব দাবির সারমর্ম হচ্ছে, রাশিয়া ঘড়ির কাঁটা ঘুরিয়ে ১৯৯০ সালে নিতে চাচ্ছে যেখানে পূর্ব ইউরোপ থেকে পশ্চিমাদের উৎখাত করে রাশিয়া তার তথাকথিত নিকটবর্তী সীমান্তে নিজের প্রভাব বিস্তার করতে চাচ্ছে।
এই পরিকল্পনার অংশ হিসেবে রাশিয়া ইউক্রেন সীমান্তে ১ লাখ সৈন্য ও ভারী অস্ত্রশস্ত্রের সমাবেশ ঘটিয়েছে এবং ক্রিমিয়া দখল করে নিয়েছে।
রাশিযার এসব কার্যকলাপের বিপরীতে যুক্তরাষ্ট্র ও তার মিত্ররা ইউক্রেনে উত্তেজনা কমানোর জন্য রাশিয়াকে আলোচনার টেবিলে আনতে চাচ্ছে।
বাইডেন প্রশাসনের সক্রিয় কূটনৈতিক চেষ্টার পর গত বছরের ডিসেম্বরের শেষদিকে রাশিয়ান পররাষ্ট্রমন্ত্রী সের্গেই ল্যাভরভ ঘোষণা করেছিলেন যে ১০ জানুয়ারি দুই দেশের মধ্যে আলোচনা অনুষ্ঠিত হবে। রাশিয়ার অনেক দাবি পশ্চিমাদের কাছে গ্রহণযোগ্য না হলেও, কূটনৈতিক প্রক্রিয়া সহিংসতার চেয়ে অধিক গুরুত্বপূর্ণ। সবকিছু ঠিকঠাক থাকলেও এই আলোচনা থেকে গুরুত্বপূর্র্ণ বিষয় যেমন কৃষ্ণ ও বাল্টিক সাগরের উত্তেজনাপূর্ণ ইস্যুগুলো নিয়ে অগ্রগতি কমই হবে।
কিছু পণ্ডিত বলছেন, আলোচনার আগে খসড়া চুক্তি প্রকাশ করা আলোচনাকে দুর্বল করে দেওয়ার একটি রাশিয়ার চালাকি এবং ইউক্রেনে সামরিক হামলার ক্ষেত্র প্রস্তুত করারই অংশ।
এই খেলায় সফল হওয়ার জন্য যুক্তরাষ্ট্র ও তার মিত্রদের শক্তিশালী অবস্থানে থেকে রাশিয়ার সাথে আলোচনা করতে হবে। সোভিয়েত নেতা ব্রেজনেভের মতো মূল আলোচনার ক্ষেত্র প্রস্তুত করার জন্য রাশিয়াকে আগে প্রতিহত করতে হবে।
এ কারণেই যুক্তরাষ্ট্র পুতিনের সাথে আলোচনায় অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞা ‘এমন ধরনের যেটা আগে কেউ দেখেনি’ দেওয়ার কথা বলে বেড়াচ্ছে যদি ইউক্রেনে যুদ্ধ বাধে। এই পরিস্থিতিতে ইউরোপীয় মিত্রদের কাছে স্পষ্ট নয় যে তারা কি পদক্ষেপ নেবে। ফ্রান্সে প্রেসিডেন্ট ইমানুয়েল ম্যাক্রোঁ সতর্ক থাকার আহ্বান জানিয়েছেন। বাম, গ্রিনস এবং উদারপন্থিদের মধ্যে এই নিয়ে বিভক্তি থাকলেও জার্মানির নতুন চ্যান্সেলর ওলাফ স্কোলজ শান্তির পক্ষে অবস্থান নিয়েছেন। যদিও জার্মানির পররাষ্ট্রমন্ত্রী আনালেনা বেয়ারবক রাশিয়ার বিরুদ্ধে কঠোর পদক্ষেপের পক্ষে।
এটা বলার অপেক্ষা রাখে না যে, রাশিয়া ন্যাটোর মধ্যে বিভক্তি সর্বোচ্ছ কাজে লাগাবে।
সূত্র: আল জাজিরা