নারায়ণগঞ্জের ফতুল্লায় ধলেশ্বরী নদীর বিভিন্ন এলাকায় চলছে দখলের মহোৎসব। বাদল হোসেনের মালিকানাধীন মেসার্স কনকর্ড ওয়েল সাপ্লাইয়ার্স লিমিটেড কোম্পানির নামে নদীর জমি দখল নেওয়া হয়েছে। দখল করা জমিতে পাকা দালান; এমনকি নদীর ভেতরের অংশ ভরাট করে তেলের ড্রাম রাখার জায়গা ও পেট্রলপাম্প নির্মাণ করা হয়েছে!
একইসঙ্গে নারায়ণগঞ্জের রূপগঞ্জে শীতলক্ষ্যা নদীর ৫ হাজার বর্গফুট জমি দখল করে বালুর ব্যবসা পরিচালনা করছেন হাজী মোহাম্মদ আলী। এ এলাকায় নদীর জায়গা দখল করে আরো ব্যবসা গড়ে তুলেছেন আবদুল কাদির, আনোয়ার হোসেন, মেসার্স মৌমিতা এন্টারপ্রাইজ, সাদিয়া, মনির এন্টারপ্রাইজসহ ৩০-এর বেশি ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠান।
জাতীয় নদী রক্ষা কমিশনের ২০২০ সালের ২৪ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত নদী দখলদারদের হালনাগাদ করা তালিকায় এমন চিত্র উঠে এসেছে।
প্রতিবেদনে আরো দেখা গেছে, রূপগঞ্জের তারাবো এলাকায় শীতলক্ষ্যার বুক ভরাট করে অফিস বানিয়েছেন মোহাম্মদ আলী নামে আরেকজন। একই এলাকায় তানজিম এন্টারপ্রাইজের নামে মোস্তফা কামাল তপন ১ হাজার ৪০ বর্গফুটের বেশি নদীর জমি দখল করেছেন।
রূপগঞ্জের পূর্বগ্রামে আলম মেরিন শিপ বিল্ডার্সের নামে দখল করা হয়েছে ৭০০ বর্গফুটের বেশি নদীর জায়গা। এখানেই শেষ নয়, এ এলাকার আশপাশে বেশকিছু ডকইয়ার্ডের নামে নদীর জমি গ্রাস করেছে ভূমিদস্যুরা। এভাবে প্রতিটি জেলায়ই কমবেশি নদী দখল হয়েছে। অর্থাৎ দেশের ৬৪ জেলায় নদীর জমিতে রয়েছে ভূমিদস্যুদের থাবা।
তবে কমিশনের পক্ষ থেকে ২০২১ সালের সর্বশেষ প্রতিবেদন তৈরির কাজ চলমান। আগামী এক মাসের মধ্যে নতুন প্রতিবেদন চূড়ান্ত করে প্রকাশ করা হবে।
জানতে চাইলে জাতীয় নদী রক্ষা কমিশনের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান কামরুন নাহার আহমেদ ভোরের আকাশকে বলেন, ‘দেশের বিভিন্ন এলাকায় নদী দখলমুক্ত করতে উচ্ছেদাভিযান অব্যাহত হয়েছে। এরই ধারাবাহিকতায় আমরা দেখছি, আগের চেয়ে দখলদার কমেছে। তবে আগামী এক মাসের মধ্যে নতুন রিপোর্ট চূড়ান্ত করে প্রকাশ করা হবে।’
এজন্য কমিশনের সার্বিক প্রস্তুতি চলছে বলেও জানান তিনি।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, চলমান উদ্ধারাভিযানের মধ্যেও বাড়ছে নদী দখলের মাত্রা। বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের পরিচয়ে স্থানীয় লোকজন নদীর জমি দখলের সঙ্গে যুক্ত। দখলে যুক্ত নানা পেশার প্রভাবশালী ব্যক্তিসহ তাদের পরিচিত বা নিকটাত্মীয়-স্বজনরাও। অনেক সময় স্থানীয় প্রশাসনকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে পেশিশক্তি ব্যবহার করে নদীর জমি কব্জা করে নেওয়া হচ্ছে।
যদিও সরকারের পক্ষ থেকে বার বারই বলা হচ্ছে, যেকোনো মূল্যে নদীর জমি নদীকে ফিরিয়ে দেওয়া হবে। দখলের সঙ্গে কোনো আপোস হবে না। এরই ধারাবাহিকতায় তালিকা ধরে ধরে চলছে উচ্ছেদাভিযানও। তবে বিভিন্ন এলাকায় নদীর জমি উচ্ছেদের পর তদারকি না করায় ফের দখল হওয়ারও খবর আছে।
তদারকি জরুরি
বিশেষজ্ঞরাও বলছেন, নদীর জমি দখলমুক্ত করার পর তদারকি না থাকায় ফের দখল হচ্ছে। এভাবেই গড়ে উঠছে দখলদারের সংখ্যা। সেইসঙ্গে তালিকাভুক্ত দখলদারদের বিরুদ্ধে কঠোর আইনগত ব্যবস্থা নেওয়ারও পরামর্শ দিয়েছেন অনেকেই।
তারা বলছেন, সরকারি জমি বা নদী দখলের অপরাধে আইনি ব্যবস্থায় দখলদারদের জেল-জরিমানার যে বিধান রয়েছে, বিভিন্ন আইনে তা নিশ্চিত করা গেলে দখলের মাত্রা কমে আসতে পারে। সেইসঙ্গে রাজনৈতিকভাবেও দখলদারদের বিরুদ্ধে সোচ্চার হওয়ার পরামর্শ বিশেষজ্ঞদের।
কমিশনের সংশ্লিষ্টরা বলছেন, রাজনৈতিক সহযোগিতার অভাবে প্রভাবশালীদের বিরুদ্ধে অনেক সময় আইন প্রয়োগ কঠিন হয়ে যায়। এজন্য রাজনৈতিক সমর্থন জরুরি বলেও মনে করেন তারা।
জানতে চাইলে বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় (বুয়েট) নৌযান ও নৌযন্ত্র কৌশল বিভাগের অধ্যাপক মীর তারেক আলী বলেন, ‘আমরা প্রতি বছর একদিকে দেখছি- নদী দখলমুক্ত করতে অভিযান চলছে; অন্যদিকে প্রতি বছর বাড়ছে দখলদার।’
তিনি বলেন, ‘দখল উচ্ছেদ ও উচ্ছেদকৃত ভূমি যেন আবার দখলে না যায়- এ দুটি কাজ একসঙ্গে চালিয়ে যেতে হবে। কিন্তু আমরা তা লক্ষ করছি না। অভিযোগ আছে, উচ্ছেদের পর রক্ষণাবেক্ষণ ঠিকঠাক হয় না। ফলে দ্রুত উচ্ছেদকৃত ভূমি আবারও দখলে চলে যায়। এতে একই কাজ বার বার করতে হচ্ছে। অর্থাৎ আবারও টাকা খরচ করে উচ্ছেদাভিযান পরিচালনা করতে হয়।’
৬৩ হাজার দখলদার
কমিশনের সর্বশেষ প্রতিবেদনে দেখা গেছে, দেশের ৬৪ জেলায় নদী দখলদারের সংখ্যা প্রায় ৬৩ হাজার, যা ২০১৮ সালের হিসাবে ছিল ৫০ হাজারের মতো।
কমিশন সূত্রে জানা গেছে, ২০১৯ সালের প্রতিবেদনে নদী দখলদারদের সংখ্যা ছিল ৫৭ হাজার। প্রতিবেদন অনুযায়ী, সবচেয়ে বেশি নদী দখলদার খুলনা বিভাগে। সেখানে সংখ্যাটি ১১ হাজার ২৪৫। আর উচ্ছেদ করা হয়েছে ৪ হাজার ৮৯০ অবৈধ দখলদারকে।
নদী দখলদারের সংখ্যা সবচেয়ে কম সিলেট বিভাগে, ২ হাজার ৪৪ জন। এ বিভাগে ২০১৯ সালে উচ্ছেদ করা হয়েছে ৫৭৬ জনের অবৈধ স্থাপনা।
ঢাকা জেলায় নদী দখলকারী সাড়ে ৬ হাজারের বেশি
ঢাকা বিভাগে নদী দখলদারের সংখ্যা ৮ হাজার ৮৯০। উচ্ছেদ করা হয় নদীর জমিতে থাকা ১ হাজার ৪৫২ জনের ৫ হাজার ৯৩৫টি স্থাপনা।
ঢাকা জেলায় বুড়িগঙ্গা, তুরাগ, শীতলক্ষ্যা, ইছামতি, বালু, বংশী, গাজীখালী, কালীগঙ্গাসহ মোট ১১টি নদী ও ২০১টি খালের উল্লেখ রয়েছে প্রতিবেদনে। ঢাকা জেলায় নদী দখলদারের সংখ্যা ৬ হাজার ৭৫৮। এর মধ্যে উচ্ছেদ করা হয়েছে ৫ হাজার ৭৯৯ জনের স্থাপনা।
৭৭০ নদীর জমিতে দখল
কমিশনের প্রতিবেদনে বলা হয়, দেশের ৭৭০টি নদীর জমি দখল করেছেন ৪৩ হাজার ৩৯০ ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠান। গত কয়েক বছরে ১৮ হাজার ৫৭৯ ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানকে উচ্ছেদ করেছে বিভিন্ন জেলার প্রশাসন। দখলদারদের মধ্যে অন্তত ১০ শতাংশ স্থানীয় এবং রাজনৈতিকভাবে প্রভাবশালী।
সংসদীয় কমিটির কাছে জমা দেওয়া কমিশনের প্রতিবেদন এনআরসিসি জানায়, প্রতিটি বিভাগেই নদী ও নদীতীরে বিশালাকার কাঠামো তৈরি করা হয়েছে।
জাতীয় নদী রক্ষা কমিশনের সাবেক চেয়ারম্যান ড. মজিবুর রহমান হাওলাদার বলেন, সারা দেশে নদী দখলদারদের সংখ্যা প্রতি বছর বাড়ছে, বিষয়টি তেমন নয়। একসঙ্গে চূড়ান্ত প্রতিবেদন করা যায় না। তাছাড়া বার বার তদন্তে নতুন নতুন দখলের চিত্র উঠে আসায় দখলদারের সংখ্যা বাড়ে মনে হয়।
নানা কারণে কয়েক দশকে চোখের সামনে নদীগুলো দখল হয়েছে- এ কথা উল্লেখ করে তিনি বলেন, সমন্বিত প্রচেষ্টা থাকলে বাকি দখলও মুক্ত করা সম্ভব হবে।
তিনি বলেন, ইতোমধ্যে নদী ও পরিবেশ রক্ষায় আইন হয়েছে। আইন প্রয়োগের পাশাপাশি অভিযান অব্যাহত রাখতে হবে। তাছাড়া নদী দখলের অভ্যাস দেশে এখন স্থায়ী রূপ নিয়েছে।
শুকনো মৌসুমে নদী শুকিয়ে গেলে দখলের মাত্রা আরো বেড়ে যায়। এজন্য নদীর নাব্য বজায় রাখার পরামর্শ দিয়ে ড. মজিবুর রহমান বলেন, সব নদী নাব্য ফিরে পেলে দখল কমবে।
তিনি বলেন, আইনানুযায়ী কেউ নদী দখল করলে এক থেকে ৭ বছর পর্যন্ত জেল হতে পারে। কেউ নদীপ্রবাহ বন্ধ করলে অন্য আইনেও শাস্তির বিধান আছে।
সাড়ে ৪৩ হাজার অবৈধ দখলদার
উচ্ছেদের পরও দেশে এখন ৪৩ হাজার ৬৪২ নদীর অবৈধ দখলদার রয়ে গেছেন। এদের কবে নাগাদ উচ্ছেদ করা হবে, তা বলতে পারছে না জাতীয় নদী রক্ষা কমিশন।
কমিশন বলছে, ‘আমরা অনেক চেষ্টা করে জেলা পর্যায় থেকে তালিকাটাই আনাতে পারছি না। একেকবার একেক তালিকা আসে, ফলে তালিকা চূড়ান্ত করতে গিয়েও বিপাকে পড়ছে কমিশন। দখলদারদের তালিকায় দেখা যায়, যেসব বিভাগে অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড বেশি, সেখানেই বেশি দখল।’
জাতীয় নদী রক্ষা কমিশনের এক কর্মকর্তা নিজের অভিজ্ঞতা তুলে ধরে বলেন, ‘আমরা চাইলেই দখলদারদের প্রকৃত চিত্র পাই না। আমাদের নিজস্ব জনবল নেই। জেলা প্রশাসকদের তথ্যের ওপর নির্ভর করি। কিন্তু তাদের তথ্যে অনেক সময় দেখা যায়, দখলের চেয়ে উচ্ছেদ বেশি।’