logo
আপডেট : ২৩ জানুয়ারি, ২০২২ ১২:১৯
মৃতদের ৮৬ শতাংশই টিকা নেননি
আরিফ সাওন

মৃতদের ৮৬ শতাংশই টিকা নেননি

করোনাভাইরাস। ফাইল ছবি

করোনায় মৃতদের মধ্যে ৮৫ দশমিক ৮০ শতাংশ টিকা নেননি। নিয়েছেন মাত্র ১৪ দশমিক ২০ শতাংশ। এর মধ্যে দুই ডোজ নিয়েছেন ৫৮ দশমিক ৭৬ শতাংশ। ৪১ দশমিক ২৩ শতাংশ পেয়েছেন এক ডোজ টিকা।

২০২১ সালের ৩৭তম এপিডেমিওলজিক্যাল সপ্তাহ থেকে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর করোনায় মৃতদের মৃত্যু পর্যালোচনার রিপোর্ট প্রকাশ করে আসছে। ২০২১ সালের ১৩ সেপ্টেম্বর থেকে ২০২২ সালের ১৭ জানুয়ারি পর্যন্ত ১৮ সপ্তাহের এপিডেমিওলজিক্যাল রিপোর্ট পর্যালোচনায় এসব তথ্য পাওয়া গেছে।

১৮টি এপিডেমিওলজিক্যাল সপ্তাহে মৃত্যু হয় ১ হাজার ২১৩ জনের। এর মধ্যে এক দিনের তথ্য বাদে কো-মরবিডিটি ছিল ৬৬১ জনের। ১৮ সপ্তাহে মৃতদের মধ্যে ৫৯ দশমিক ২৫ শতাংশের কো-মরবিডিটি ছিল।

মৃতদের কো-মরবিডিটির মধ্যে ৬১ দশমিক ৬১ শতাংশের উচ্চরক্তচাপ, ৬১ দশমিক ৩৭ শতাংশের ডায়াবেটিস, ৫১ দশমিক ৪২ শতাংশের বক্ষব্যাধি, ২০ দশমিক এক শতাংশের হৃদরোগ, ১৮ দশমিক ৭০ শতাংশের কিডনিজনিত রোগ, ৪ দশমিক ৬১ শতাংশের নিউরোজিক্যাল রোগ, ৩ দশমিক ৮৮ শতাংশের থায়রয়েডজনিত রোগ, ২ দশমিক ৯১ শতাংশের স্ট্রোকজনিত সমস্যা, ২ দশমিক ২১ শতাংশের ক্যান্সার, ১ দশমিক ৯৬ শতাংশের লিভারজনিত রোগ, ১ দশমিক ১৭ শতাংশের রক্তজনিত রোগ, ১.০৩ শতাংশের বাতরোগ, ০.১৬ শতাংশের মানসিক সমস্যা। অন্যান্য সমস্যা শূন্য দশমিক ৫৫ শতাংশের।

এই সময়ে বেশি মারা গেছেন ৬১ থেকে ৭০ বছর বয়সী; ২৭৪ জন। এরপর ৫১ থেকে ৫০ বছর বয়সী; ১৯৫ জন, ৭১ থেকে ৮০ বয়সী ১৪৯ জন এবং ৪১ থেকে ৫০ বছর বয়সী ১০৭ জন, ৮১ থেকে ৯০ বছরের ৫০ জন। বাকিরা অন্য বয়সী। বয়সের বিশ্লেষণে দেখা গেছে, ৪০ থেকে ৮০ বছর বয়সীরা বেশি মারা গেছেন।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, করোনা উচ্চঝুঁকিতে রয়েছেন বেশি বয়সীরা- যাদের ডায়াবেটিস, উচ্চরক্তচাপ, বক্ষব্যাধি ও হৃদরোগসহ একাধিক রোগ রয়েছে। ঝুঁকি এড়াতে দ্রুত তাদের টিকার আওতায় আসতে হবে। টিকা না নিয়ে তাদেরও উচিত বাইরে বের না হওয়া।

৩৯ সপ্তাহ থেকে মৃতদের ভ্যাকসিন উপাত্ত দেওয়া হয়। ২৭ অক্টোবর শুরু হয় ৩৯ সপ্তাহ। এই সময় থেকে ১৬ সপ্তাহে মারা যান ৭৩০ জন। ৪৭ জনের টিকা-সংক্রান্ত কোনো তথ্য পাওয়া যায়নি। প্রাপ্ত ৬৮৩ জনের মধ্যে টিকা নেন ৯৭ জন অর্থাৎ ১৪.২০ শতাংশ। টিকা নেননি ৫৮৬ জন অর্থাৎ ৮৫.৮০ শতাংশ।

মৃতদের মধ্যে যে ৯৭ জন টিকা পেয়েছেন। এরা সবাই দুই ডোজ টিকা পাননি। এদের মধ্যে ৫৭ জন দুই ডোজ এবং ৪০ জন এক ডোজ টিকা নিয়েছেন। ৫৮.৭৬ শতাংশ দুই ডোজ এবং ৪১.২৩ শতাংশ এক ডোজ নিয়েছেন।

বাংলাদেশ এন্ডোক্রাইন সোসাইটির (বিইএস) সাধারণ সম্পাদক ও বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বিএসএমএমইউ) এন্ডোক্রাইনোলজি বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ডা. শাহজাদা সেলিম বলেন, ডায়াবেটিস হলো এমন একটা রোগ, এটা অন্য অনেক ক্ষতি করার সঙ্গে সঙ্গে রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা ধ্বংস করে দেয়।

এই যে রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কমে যাওয়া এটা নির্ভর করে ডায়াবেটিস কত দিনের, ডায়াবেটিসের নিয়ন্ত্রণ কেমন, ব্লাড সুগার মাঝে মাঝে কমছে-বাড়ছে এই তিনটি বিষয়ের ওপর। আরেকটি বিষয় হলো বাংলাদেশে এখন যারা ডায়াবেটিসের রোগী আছেন তাদের ৮০ শতাংশ ডায়াবেটিস কন্ট্রোল করতে ব্যর্থ হচ্ছেন। কাজেই এই ৮০ শতাংশ মানুষ অনেক বেশি ঝুঁকিতে আছে।

তিনি বলেন, ‘করোনা নিয়ে যতগুলো পাকলিকেশন হয়েছে আপনারা দেখেছেন করোনায় যারা আক্রান্ত হয়েছে, খারাপ হয়েছে, আরেকটা গ্রুপ আছে- যাদের দৈহিক ওজন বেশি, শ্বাসকষ্ট বা অন্য সমস্যা আছে। বেশি মারা গেছে যারা এদের মধ্যে একটা গ্রুপ কিন্তু বেশি দৈহিক ওজনের।

‘ডায়াবেটিসের রোগীদের হার্ট অ্যাটাকের আশঙ্কা বেশি, হাইপার টেনশন অন্যান্য রোগও তার কিন্তু সব থাকবে। এখন করোনার এই পরিস্থিতিতে ভালো করে ডায়াবেটিস কন্ট্রোলের চেষ্টা করতে হবে। শুধু কন্ট্রোল করলে হবে না। অ্যাপ্রোপিয়েট ড্রাগ ব্যবহার করতে হবে।’

এখন দেশে অন্তত আড়াই থেকে তিন কোটি ডায়াবেটিসে আক্রান্ত ধারণা করা হয় বলে জানান তিনি। বলেন, ‘এই সংখ্যা নিয়ে আমরা খুব বিভ্রান্তিতে আছি। ইন্টারন্যাশনাল ডায়াবেটিস ফেডারেশনের সবশেষ পাবলিকেশনে দেখাচ্ছে যে ১২.১৫ শতাংশ। সেটা ১৬ কোটি মানুষের ওপর নির্ভর করে। কিন্তু এখন তো মানুষ অনেক বেশি। সেই হিসাবে আমাদের ধারণা আরো অনেকে বেড়েছে। তাতে এখন দেশে আড়াই থেকে তিন কোটি ডায়াবেটিসে আক্রান্ত।’

আইইডিসিআরের সাবেক প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা অধ্যাপক ডা. মুশতাক হোসেন বলেন, ‘টিকা নেওয়ার ফলে মানুষের শরীরে রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধি পায়। ফলে করোনা ভাইসার তাকে খুব বেশি দুর্বল করতে পারে না। ভাইরাস যখন তাকে দুর্বল করতে না পারে তখন নিজে দুর্বল হয়ে যায়। এ কারণে গুরুতর অসুস্থ হওয়ার আশঙ্কা কম থাকে। আর গুরুতর অসুস্থ না হলে মৃত্যু ঝুঁকিও কমে যায়।’

বিশিষ্ট ভাইরাসবিদ ও বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য অধ্যাপক ডা. মো. নজরুল ইসলাম বলেন, যারা বয়স্ক, যাদের কো-মরবিডিটি আছে এবং তারা টিকা নেননি- এই ধরনের লোকদের টিকা না নেওয়া পর্যন্ত তাদের কোনোভাবেই ঘর থেকে বের হওয়া যাবে না।

যারা বয়স্ক এবং যাদের কো-মরবিডিটি তাদের পরিবারের অন্য সদস্যদেরও স্বাস্থ্যবিধি মানা বাধ্যতামূলক। কারণ, তারা ঘর থেকে বের হলেন না। কিন্তু তাদের পরিবারের অন্যরা তো বাইরে যাচ্ছেন। তাদের সংক্রমিত হওয়ার আশঙ্কা থাকছে। সংক্রমিত হয়ে তাদের কিছু হলো না। কিন্তু তাদের থেকে সংক্রমিত হয়ে ঝুঁকিতে পড়ছেন ওই মানুষগুলো; যাদের কো-মরবিডিটি আছে-বয়স্ক এবং টিকা নেননি।

জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ ডা. লেলিন চৌধুরী বলেন, ‘আমরা তো এক দিনে ৭০ লাখ মানুষকে টিকা দিতে পারি। তা তো আমরা দেখিয়েছি। আমরা যদি ১০ দিনের কার্যক্রম হাতে নিতাম তাহলে আমরা ৫০ লাখ করে হলেও ১০ দিনে বিশেষ ক্যাম্পেইন করে ৫ কোটি মানুষকে টিকা দিয়ে দিতে পারতাম। এখন যত দ্রুত সম্ভব লক্ষ্য অনুযায়ী ১৩ কোটি ৮২ লাখ মানুষের টিকা নিশ্চিত করতে হবে।’

পরে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার জন্মদিন উপলক্ষে ২৮ সেপ্টেম্বর স্বাস্থ্য অধিদপ্তর বিশেষ গণটিকাদান কর্মসূচি ঘোষণা করে। সেদিন দেশে ৬৭ লাখ ৫৮ হাজার ৯২২ ডোজ টিকার প্রয়োগ হয়। দেশে প্রথম বুস্টার প্রয়োগ শুরু হয় ১৯ ডিসেম্বর। এর আগে ২০২১ সালের ২৪ সেপ্টেম্বর বিশে^ প্রথম বুস্টার ডোজ নেন ব্রিটেনের সেই নারী মার্গারেট কিনান।

এ পর্যন্ত দেশে ১৫ কোটির বেশি ডোজ টিকা দেওয়া হয়েছে। এর মধ্যে প্রথম ডোজ পেয়েছেন ৯ কোটির বেশি এবং দ্বিতীয় ডোজ পেয়েছেন ৫ কোটির বেশি। এছাড়া এক কোটি ২৮ লাখ শিক্ষার্থী পেয়েছেন প্রথম ডোজ টিকা। দেশে মজুদ আছে আরো ৯ কোটি ডোজ টিকা।