logo
আপডেট : ২৪ জানুয়ারি, ২০২২ ১৩:২৩
অশান্ত কাজাখ : ‘আবার আন্দোলনে নামলে মেরে ফেলব’

অশান্ত কাজাখ : ‘আবার আন্দোলনে নামলে মেরে ফেলব’

উর্দি পরা সশস্ত্র লোকটি প্রতিটি ওয়ার্ডে ঢুকে খোঁজাখুঁজি করছিল আর চিৎকার করে বলছিল, কে কে আন্দোলন-সহিংসতায় জড়িত ছিল। কাজাখস্তানের বড় শহর আলমাতিতে সহিংসতায় গুলিবিদ্ধ হয়ে হাসপাতালে চিকিৎসাধীন আসেল বলেন, একজন চিৎকার করে বলছিল, আবার যদি আন্দোলন কর তাহলে তোমাদের মেরে ফেলব।

তার বিশ্বাস অস্ত্র হাতে ওই লোকগুলো পুলিশের বিশেষ বাহিনীর বা নিরাপত্তা বাহিনীর সদস্য। তারা ঘুরে ঘুরে বোঝার চেষ্টা করছিল আহত আর কোন লোক সরকারবিরোধী বিক্ষোভে আবারও অংশ নেবে কি না। তারা আসেলকে তাদের সঙ্গে নিয়ে যাওয়ার চেষ্ঠা করে। কিন্তু সে এতো বেশি আহত ছিল যে, হাঁটার মতো অবস্থা ছিল না।

আসেল জানায়, নিজেকে রক্ষা করতে সে তার পরিচয় বদলে ফেলেছিল। জ্বালানির মূল্যবৃদ্ধির প্রতিবাদে জানুয়ারির শুরুতে যে শান্তিপূর্ণ আন্দোলন শুরু হয়, তাতে অন্যদের মতো সেও যোগ দেয়। বিশ্বের যে কয়টি তেল সমৃদ্ধ দেশ আছে, তার মধ্যে কাজাখস্তান অন্যতম। কিন্তু দেশটির বেশির ভাগ মানুষই এই প্রাকৃতিক সম্পদের সুফল ভোগ করতে পারে না।

শান্তিপূর্ণ আন্দোলন অল্প সময়ের মধ্যেই বিশৃঙ্খলায় পরিণত হয়। শুরু হয় লুটপাট এবং তা রক্তপাতের দিকে ধাবিত হয়। সোভিয়েত ইউনিয়ন থেকে স্বাধীনতা লাভের ৩০ বছরে দেশটিতে প্রথমবারের মতো রক্তক্ষয়ী সহিংসতা দেখা দেয়। সরকার বল প্রয়োগের মাধ্যমে সহিংসতা দমনের পথ বেছে নেয়।

সরকারি হিসেব অনুযায়ী, দেশটিতে বিক্ষোভ-সহিংসতায় অন্তত ২২৫ জন নিহত ও বিপুল সংখ্যাক মানুষ আহত হয়েছে। এছাড়া আটক করা হয়েছে অন্তত ১০ হাজার মানুষকে। ৫৭ বছর বয়সী আসেলের মতো অনেকেই আটক আতঙ্কে আছে। বিক্ষোভ-সহিংসতায় জড়িত থাকার অভিযোগে কাজাখ সরকার এ পর্যন্ত প্রায় ৭শ মামলা দায়ের করেছে। এরমধ্যে কিছু কিছু মামলা হয়েছে হত্যা, সন্ত্রাসবাদ ও সরকারকে উচ্ছেদ প্রচেষ্ঠার বিরুদ্ধে।

তবে মানবাধিকার সংস্থাগুলোর মতে, বিক্ষোভ-সহিংসতার সঙ্গে জড়িতদের পাশাপাশি শান্তিপূর্ণ আন্দোলনকারীদেরও আটক করছে সরকার। এমনকি ফেসবুকে আন্দোলনের প্রতি সমর্থন জানানোদেরও আটক করা হচ্ছে। তাদেরকে মারধর ও নির্যাতন করা হচ্ছে। আলমাতির মানবাধিকার কর্মী বাখিৎজান টোরেগোঝিনিয়া বলেন, পরিস্থতি দেখে মনে হচ্ছে নির্দোষরাও রেহাই পাবে না।

কর্তৃপক্ষ তাদের বড় ধরণের সন্ত্রাসী প্রমাণ করতে স্বীকারোক্তি আদায়ের চেষ্টা করছে। আলমাতির প্রধান চত্বরে শান্তিপূর্ণ আন্দোলনে অংশ নেয়া মুরাতবেক ইয়েসেনগাজিকে সহিংসতার অভিযোগে আটক করা হয়েছে। তার আইনজীবী তার মক্কেলকে আটকের পর মারধর করা হয়েছে। পুলিশি নিষ্ঠুরতায় পায়ে দাগ পড়ার ছবিও দেখান তিনি।

যদিও আটককৃতদের মারধর বা তাদের সঙ্গে কোন ধরণের নির্যাতনের কথা অস্বীকার করেছে কর্তৃপক্ষ। আলমাতির পুলিশ কর্মকর্তা সালতানাত আজিরবেক বলেন, যারা সহিংসতায় জড়িত ছিলনা তাদের ভয় পাওয়ার কোন কারণ নেই। নির্দোষদের ছেড়ে দেওয়া হবে।

শান্তিপূর্ণ আন্দোলন কিভাবে সহিংস বিক্ষোভে রূপ নিলো সে বিষয়ে এখনো সুষ্পষ্ট করে কেউ কিছু বলতে পারছে না। প্রাথমিকভাবে ধারণা করা হয় ৪ জানুয়ারি আন্দোলনের গতিপথ পরিবর্তন হয়। আচানক বিক্ষোভ থেকে বিভিন্ন দাবি-দাওয়া নিয়ে রাজনৈতিক স্লোগান দেওয়া শুরু হয়।

স্থানীয় সাংবাদিক তিমুর নুসিমবেকভ আলমাতির ঘটনার বর্ণনা দিতে গিয়ে বলেন, মানুষ শহরের উপকণ্ঠে ও সিটি সেন্টারে এসে জড়ো হয়। এর বেশিরভাগই ছিল বয়সে তরুণ এবং তারা একটা পরিবর্তনের ডাক দেয়। তাদের ছত্রভঙ্গ করার জন্য টিয়ার গ্যাস ও স্টান গ্রেনেড (এক ধরণের গ্যাস- যার দ্বারা মানুষ অচেতন হয়ে পড়ে) ছোড়ার পরপরই পরিস্থিতি ভিন্ন মোড় নেয়।

পুলিশ ও বিক্ষোভকারীদের মধ্যে শুরু হয়ে যায় মারামারি। পরদিন ৫ জানুয়ারি উত্তেজনা বাড়তে থাকে। আলমাতি চত্বরে কিছু মানুষকে দেখা যায় ছুড়ি ও শিকারী বন্দুক হাতে। তারা কারা ছিল সে সম্পর্কে আমরা এখনও অবগত নয়, বলেন নুসিমবেকভ।

পুলিশ কর্মকর্তা আজিরবেক বলেন, উন্নতমানের প্রশিক্ষণ প্রাপ্ত ও যুদ্ধ কৌশলে পারদর্শী কিছু মানুষ পুলিশে ওপর হামলা করে। তাদের উদ্দেশ্য ছিল পুলিশের কাছ থেকে অস্ত্র কেড়ে নেওয়া। কোনে আব্দিয়েভ নামের এক ব্যক্তি বিবিসিকে বলেন, আমরা শান্তিপূর্ণ আন্দোলন করছিলাম। কারা আন্দোলনকে বিক্ষোভ সহিংসতার পথে ঠেলে দিয়েছে তা আমরা জানিনা।

হঠাৎই একদল তরুণ এসে সোজা সিটি হলের দিকে এগিয়ে যায়। আমরা তাদের আটকাতে পারিনি। তারা গাড়ি ভাঙ্চুর ও আগুন দিয়েছে এবং জানালার কাঁচ ভেঙেছে। তারা সবাই মুখোশ পরিহিত ছিল। তাদের চোখ দেখে আমরা ভয়ে শিউরে উঠি। তারা যে কোন সময় আমাদের ওপর আক্রমণ চালাতে পারে- এমন আতঙ্ক কাজ করছিল।

শান্তিপূর্ণ আন্দোলনে গুলি : অল্প সময়ের মধ্যেই আন্দোলন নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যায়। কিছু মানুষ সিটি হলে জড়ো হয় এবং আগুন ধরিয়ে দেয়। এসময় মুহুর্মুহু গুলির শব্ধ ও স্টান গ্রেনেডের আওয়াজ পাওয়া যাচ্ছিল। বুলেট বিদ্ধ হওয়া একজন হলেন আসেল। বলেন, হঠাৎ দেখি আমার পা দিয়ে প্রবল বেগে রক্ত ঝড়ছে।

‘মনে হচ্ছিল চোখের সামনে অন্ধকার নেমে এসেছে। যখন সম্বিৎ ফিরে পেলাম, দেখি দুইজন মানুষ আমাকে আড়াল করে টেনে নিয়ে যাচ্ছে। গুলি থেকে বাঁচতে তারা চিৎকার করে সবাইকে শুয়ে পড়ার জন্য বলছিল। তাকে একটি ট্রাকে করে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়। ট্রাকে অসংখ্য মানুষ ছিল। অনেকেই আমার গুলিবিদ্ধ পা মাড়াচ্ছিল। পায়ের ব্যাথায় আমি গোঙ্গাচ্ছিলাম। ট্রাকে কিছু মানুষ ছিল যাদের শ্বাস-প্রশ্বাস চিরতরে বন্ধ হয়ে গিয়েছিল।’

‘পরদিন ৬ জানুয়ারি কিছু মানুষ শান্তিপূর্ণ মিছিল করে গুলি চালানো বন্ধের আহ্বান জানান। এতে অংশ নেয়া বেশির ভাগই ছিল বয়স্ক মানুষ ও মহিলা। তাদের হাতে শোভা পাচ্ছিল, আমরা শান্তিপ্রিয় মানুষ, সন্ত্রাসী নয় লেখা ব্যানার। সেদিন সন্ধ্যায় সেনাবাহিনী গাড়িভর্তি অস্ত্র নিয়ে চত্বরের চারেপাশে ঘিরে রাখে।’

সালতানাত খামজিনা নামের এক বিক্ষোভকারী জানান, আমরা কাজাখস্তানের পতাকা হাতে স্বাধীনতা স্মৃতিস্তম্ভের পাশে ছিলাম। সারিবদ্ধভাবে দাঁড়িয়ে হাত ওপরে তুলে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে বোঝানোর চেষ্টা করছিলাম, আমরা নিরস্ত্র। সাতটার দিকে সেনাবাহিনী গুলি ছোঁড়া শুরু করে।

আওয়াজ শুনে মনে হচ্ছিল তারা শূন্যে গুলি ছুড়ছে। হঠাৎ দেখি আমাদের পেছনে দাঁড়িয়ে থাকা মানুষগুলো লুটিয়ে পড়ছে। সামনের সারিতে দাঁড়িয়ে থাকা মানুষগুলোর কিছুই হয়নি। হয়তো গুলি ছোড়ার আওয়াজের সুযোগে পেছন থেকে কেউ নিঃশব্দে তাদের কাজ করে গেছে- বলেন সালতানাত।

মেরিখান আব্দুমানাপভ নামের আরেক বিক্ষোভকারী বলেন, আমরা স্বাধীনতা স্মৃতিস্তম্ভের কাছে ছিলাম। হঠাৎ দেখি আনুমানিক ৫০ বছর বয়সী এক লোক যন্ত্রণায় কাতরাচ্ছে। সে চলতে পারছেনা। ১৭/১৮ বছর বয়সী দুটি মেয়ে ও এক তরুণ একজন আরেকজনের ওপর পড়ে আছে। দেখেই বোঝা যাচ্ছিল, তারা আর বেঁচে নেই।

সে সময় আমার খুব রাগ হচ্ছিল এবং নিজের কাছে প্রতিজ্ঞা করি, শান্তিপূর্ণ আন্দোলকারীদের ওপর কিভাবে গুলি চালানো হয়েছে তা আমি সবাইকে জানাবো। যদিও পুলিশ কর্মকর্ত আজিরবেক দাবি করছেন, আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী আত্মরক্ষার্থে গুলি চালিয়েছে।

কাজাখ সরকার শুরু থেকেই দাবি করে আসছে, সহিংসতার পেছনে আন্তর্জাতিক সন্ত্রাসীদের যোগসাজোশ রয়েছে, এর অনেক প্রমাণও তাদের কাছে রয়েছে। এরসঙ্গে দেশটির সাবেক প্রেসিডেন্ট নুরসুলতান নজবায়েভের সংশ্লিষ্টতা রয়েছে বলেও অভিযোগ সরকারের।

রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষের কারণ যাইহোক না কেন, তিমুর নুসিমবেকভ সতর্ক করে দিয়ে বলেন, শান্তিপূর্ণ আন্দোলনে অংশগ্রহণকারী ও সাংবাদিকদের লুট ও ডাকাতির ঘটনায় জড়ানো কোনভাবেই ঠিক হবেনা। কর্তৃপক্ষ এখন তাদের ভুলগুলো আড়াল করার চেষ্টা করছে। কর্তৃপক্ষের ভুল পদেক্ষেপের কারণে কাজাখস্তানের ইতিহাসে প্রথমবারের মতো এরকম মানবিক বিপর্যয় নেমে এসেছে।

-মোমেনা আক্তার পপি- বিবিসি অবলম্বনে