logo
আপডেট : ২৪ জানুয়ারি, ২০২২ ১৩:৪১
রক্তাক্ত শৈলকুপা
কেন এত সংঘর্ষ
শাহরিয়ার রহমান, ঝিনাইদহ

কেন এত সংঘর্ষ

দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলীয় জেলাগুলো এক সময় বিভিন্ন চরমপন্থি গ্রুপের অভয়ারণ্য হিসেবে পরিচিত ছিল। এর মধ্যে ঝিনাইদহ অন্যতম। চরমপন্থি অধ্যুষিত জেলা হিসেবে তখন ব্যাপক পরিচিতি পায় এই জেলা। ওই সময় প্রতিনিয়তই ঘটত অপহরণ, হত্যা, সংঘর্ষ, লুটপাট, প্রতিপক্ষের বাড়িঘরে হামলা, ভাঙচুরের ঘটনা।

যার অধিকাংশই ছিল বিভিন্ন সামাজিক ও রাজনৈতিক আধিপত্য এবং গ্রাম্য মাতব্বরদের মধ্যে প্রভাব বিস্তার নিয়ে। জেলার ছয় উপজেলার মধ্যে শৈলকুপায় এর প্রভাব ছিল সব থেকে বেশি।

২০০৮ সালের পর থেকেই ঝিনাইদহে বড় ধরনের সংঘাত কিছুটা কমে আসে। কিন্তু সদ্য শেষ হওয়া পঞ্চম ধাপের ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনের তফসিল ঘোষণার পর থেকে আবারও উত্তপ্ত হয়ে ওঠে শৈলকুপার রাজনৈতিক ও সামাজিক পরিবেশ। যার মূলে রয়েছে সরকারদলীয় চেয়ারম্যান প্রার্থী ও একই দলের বিদ্রোহী প্রার্থী এবং গ্রাম্য প্রভাবশালীদের আধিপত্য বিস্তার।

তফসিল ঘোষণার পর থেকে শৈলকুপায় নিহত হয়েছেন সাত জন; আহত হয়েছেন অন্তত শতাধিক। ঝিনাইদহ, খুলনাসহ বিভিন্ন জেলা থেকে অতিরিক্ত পুলিশ এনে মোতায়েন করা হলেও উপজেলাটিতে থামানো যায়নি সংঘাত।

এই সহিংসতায় উপজেলার সারুটিয়া ইউনিয়নে পাঁচজন নিহত হন; যার মধ্যে চার জন নৌকা প্রতীকের সমর্থক। বাকিরা ছিলেন এক বিদ্রোহী প্রার্থীর সমর্থক। তারা সবাই নিম্নআয়ের মানুষ, এমনকি সরাসরি রাজনীতির সঙ্গেও জড়িত ছিলেন না। তারপরও রাজনীতির নামে দখল আর আধিপত্যের ক্রোধে তাদের বলি হতে হয়।

একমাত্র উপার্জনক্ষম মানুষকে হারিয়ে পরিবারগুলো চরম অনিশ্চয়তার মধ্য দিয়ে দিন কাটাচ্ছেন। ঘটনার পর এলাকার মানুষ বিশেষ করে পুরুষরা চরম আতঙ্কের মধ্যে দিন কাটাচ্ছেন। অনেকেই বাড়ি ছেড়ে অন্যত্র বসবাস করছেন।

রাজনৈতিক সহিংসতায় মৃত্যু : সর্বশেষ শনিবার দিবাগত রাতে সারুটিয়া ইউনিয়নের পরাজিত চেয়ারম্যান প্রার্থী জুলফিকার কাইছার টিপুর সমর্থক সারুটিয়া গ্রামের মেহেদি হাসান স্বপনকে মুঠোফোনের মাধ্যমে ডেকে নিয়ে যায় বর্তমান চেয়ারম্যান (নৌকা) মাহমুদুল হাসান মামুনের সমর্থকরা।

পরে তালতলা ব্রিজের কাছে হাতুড়ি দিয়ে পিটিয়ে গুরুতর আহত করে ফেলে রেখে যায় মেহেদিকে। সেখান থেকে তাকে উদ্ধার করে শৈলকুপা উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে ভর্তি করা হয়। এরপর তার অবস্থার অবনতি হলে উন্নত চিকিৎসার জন্য ফরিদপুরে নেওয়া হয়। সেখানেই চিকিৎসাধীন অবস্থায় মেহেদি মারা যায়। যদিও নৌকা প্রতীকের বিজয়ী চেয়ারম্যান মাহমুদুল হাসান মামুন তাকে নিজের কর্মী বলে দাবি করেন।

এর আগে ৮ জানুয়ারি দুপুরে উপজেলার বগুড়া ইউনিয়নের দলিলপুর মাঠে কল্লোল হোসেন (৩৫) নামে একজনকে পিটিয়ে ও কুপিয়ে হত্যা করে প্রতিপক্ষের অস্ত্রধারীরা। নিহত ব্যক্তি একই উপজেলার বগুড়া গ্রামের মৃত আকবর আলীর ছেলে।

ঘটনার দিন বগুড়া ইউনিয়নের সাবেক চেয়ারম্যান নজরুল ইসলামের সমর্থক কল্লোলসহ কয়েকজন মাঠে পেঁয়াজক্ষেতে কাজ করছিলেন। এ সময় বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত চেয়ারম্যান শিমুলের লোকজন লাঠিসোটা ও ধারালো অস্ত্র নিয়ে তাদের ধাওয়া দেয়। এরপর দলিলপুর মাঠে কল্লোলকে পিটিয়ে ও কুপিয়ে হত্যা করার অভিযোগ রয়েছে তাদের বিরুদ্ধে।

গত ৩১ ডিসেম্বর সারুটিয়া ইউনিয়নের কাতলাগাড়ি বাজারে নৌকার প্রার্থীর নির্বাচনী কার্যালয়ে প্রতিপক্ষের হামলায় অখিল সরকার ও হারান আলী গুরুতর আহত হন। হাসপাতালে নেওয়ার পথেই হারান আলী মারা যান। আর অখিল সরকার ৫ জানুয়ারি হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যান।

নির্বাচনী সহিংসতায় মারা যাওয়া অখিল সরকার ইটভাটায় কাজ করতেন। শৈলকুপা উপজেলার সারুটিয়া ইউনিয়নের ভোটার নন তিনি। থাকতেন শ্বশুরবাড়িতে। বাড়ি ঢাকার ধামরাই উপজেলায়। নিহত হারান আলীও থাকতেন কাঁচেরকোল বাজারের পাশের আশ্রয়ণ প্রকল্পে। পেশায় ছিলেন কৃষি শ্রমিক। তবে তারা আওয়ামী লীগের প্রার্থীর সমর্থক ছিলেন।

এদিকে ভোটের চারদিন আগে ১ জানুয়ারি শনিবার সন্ধ্যায় সারুটিয়া ইউনিয়নে ভাটবাড়িয়া এলাকায় জসিম উদ্দীন (৩৫) নামে এক যুবককে ছুরিকাঘাতে হত্যা করা হয়। নিহত ব্যক্তি ওই গ্রামের আব্দুস ছাত্তারের ছেলে। পেশায় একজন পোশাক শ্রমিক।

দীর্ঘদিন ঢাকায় একমাত্র শিশুসন্তান ও স্ত্রী নিয়ে বসবাস করছিলেন। তিনি স্থানীয় রাজনীতির সঙ্গে জড়িত ছিলেন না। ঘটনার দিনগত রাতেই তিনি বাড়িতে এসেছিলেন। ঘটনার সময় জসিম বাড়ি থেকে বের হয়ে বাইরে যাওয়ামাত্রই কয়েকজন লোক তাকে ধারালো অস্ত্র দিয়ে আঘাত করে ফেলে রেখে চয়ে যায়। প্রতিপক্ষের লোকজন ভেবেছিলেন, নির্বাচনে ভোট দিতে বাড়িতে এসেছে। তাই তাকে ছুরিকাঘাত করে হত্যা করে।

অন্যদিকে ৮ জানুয়ারি সকালে একই ইউনিয়নে নির্বাচনী সহিংসতায় জখম আব্দুর রহিম নামে এক ব্যক্তি রাজশাহী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যান। ২৩ ডিসেম্বর উপজেলার একই ইউনিয়নে কাতলাগাড়ী বাজারে নৌকা প্রতীকের চেয়ারম্যানের সমর্থক আব্দুর রহিমকে পিটিয়ে গুরুতর আহত করে স্বতন্ত্র চেয়ারম্যান প্রার্থী জুলফিকার কাইছার টিপুর সমর্থকরা। সে ওই ইউনিয়নের কৃষ্ণনগর গ্রামের খোরশেদ শেখের ছেলে।

উপজেলা নির্বাচন কর্মকর্তার কার্যালয় সূত্র জানায়, ঝিনাইদহের শৈলকুপা উপজেলার ৬ নম্বর সারুটিয়া ইউনিয়নে ৫ জানুয়ারি ভোটগ্রহণ অনুষ্ঠিত হয়। ওই নির্বাচনে চেয়ারম্যান পদে চারজন প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেন। এর মধ্যে আওয়ামী লীগের প্রার্থী ছিলেন ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক মাহমুদুল হাসান।

নির্বাচনে তার সঙ্গে শৈলকুপা উপজেলা ছাত্রলীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক ও আওয়ামী লীগের বিদ্রোহী প্রার্থী জুলফিকার কাইছার টিপুর প্রতিদ্বন্দ্বিতা হয়। মনোনয়ন পাওয়ার পর থেকেই নৌকা প্রতীকের প্রার্থী মাহমুদুল হাসান ও বিদ্রোহী প্রার্থী জুলফিকারের সমর্থকদের মধ্যে সংঘাতের সূত্রপাত হয়।

কী বলছেন স্থানীয়রা : কাতলাগাড়ি আশ্রয়ণ প্রকল্পের বাসিন্দা দীলিপ সরকার বলেন, ‘আমাদের এই আশ্রয়ণ প্রকল্পে ৯০টি পরিবার বাস করে। তাদের মধ্যে অধিকাংশই দরিদ্র। একদিন কাজ না করলে তাদের খাবার জোটে না। এসব পরিবারের সদস্যরা কেউ ইটভাটায়, কেউ রাস্তায় মাটি কাটার শ্রমিক। তাদের রাজনীতি করার সুযোগ নেই। তবে ভোটের সময় সবাই আনন্দ করেন। প্রার্থীদের নির্বাচনী কার্যালয়ে ঘুরে বেড়ান। নির্বাচনী প্রচার দেখতে গিয়ে এই আশ্রয়ণ প্রকল্পেরই দুজন প্রাণ দিলেন।’

নির্বাচনী সহিংসতায় মারা যাওয়া অখিল সরকারের স্ত্রী বাসন্তী সরকার বলেন, ‘হাসপাতালে বসে স্বামীকে বাঁচানোর অনেক চেষ্টা করেছি। নিজে খাবার না খেয়ে স্বামীর ওষুধ কিনেছি। তারপরও স্বামীকে বাঁচাতে পারিনি।’

নির্বাচনী সহিংসতায় মারা যাওয়া হারান আলীর স্ত্রী সুফিয়া বেগম বলেন, ‘আমার স্বামী কোনোদিন রাজনীতি করেননি। নির্বাচনী প্রচার দেখতে আওয়ামী লীগের প্রার্থীর কার্যালয়ে গিয়েছিলেন। সেখানেই তাকে কুপিয়ে হত্যা করা হয়।

বিষয়টি নিয়ে সাবেক কলেজ শিক্ষক ও মানবাধিকারকর্মী আমিনুর রহমান টুকু বলেন, ‘এই উপজেলাটির মানুষের মধ্যে সহনশীলতা কম, উগ্র মেজাজের। অতি সামান্য বিষয় নিয়ে বড় ঘটনার জন্ম দেয়। এ ছাড়া এই উপজেলার বিভিন্ন এলাকার মানুষ উচ্চ শিক্ষিত, তেমনি প্রশাসনের উচ্চপদে কর্মরত রয়েছেন।

‘সরাসরি এসব কর্মকর্তাদের প্রভাব এলাকায় না থাকলেও তাদের পরিবার বা আত্মীয়স্বজন মনে করেন, আমি অন্যেও ওপর প্রভাব খাটালে তারা রক্ষা করবে। এটিও সংঘর্ষ সৃষ্টির পেছনে বিশেষ ভূমিকা রাখে। এসবের জন্য রাজনৈতিক অসৎ উদ্দেশ্যেও অনেকাংশে দায়ী।’

এই শিক্ষক আরো বলেন, ‘এমন পরিস্থিতিতে প্রভাবশালী ও নেতাকর্মীদের সহনশীল হতে হবে। তেমনি সব ধর্মের মানুষের মধ্যে ধর্মীয় মূল্যবোধ জাগ্রত করতে হবে। সবাইকে বোঝাতে হবে কোনো ধর্মই সহিংসতা সমর্থন করে না। সর্বোপুরি পুলিশ প্রশাসন ও জেলা প্রশাসনকে আরো বেশি উদ্যোগী হতে হবে, যেন এই মানুষগুলো সহিংসতা ছেড়ে সাম্যের দিকে এগিয়ে আসে।’

শৈলকুপা উপজেলা আওয়ামী লীগের যুগ্ম আহ্বায়ক সরোয়ার জাহাদ বাদশা বলেন, ‘উপজেলার সারুটিয়া ইউনিয়নে ১৫-১৬ বছর ধরে এমন সংঘাত চলে আসছে। কোনোভাবেই এটিকে দমন করা যাচ্ছে না। এখানে সামাজিক দলাদলির কারণে সংঘাতটা বেশি। যদিও রাজনৈতিক বিষয় এর বাইরে নয়। তবে সামাজিকতাকে বেশি প্রাধান্য দেওয়ার কারণেই ইউনিয়নটিতে সহিংসতা বাড়ছে, আমরা এ থেকে বের হতে পারছি না।’

সরকারদলীয় এই রাজনীতিবিদ আরো বলেন, ‘এটা শৈলকুপার একটা খারাপ দিক হলো- বিভিন্ন কারণে শত শত মানুষ দেশীয় অস্ত্র নিয়ে সংঘাতে লিপ্ত হয়। এটা দীর্ঘ বছর ধরে চলে আসছে। এর পিছনে কোনো একক ব্যক্তি যে দায়ী তা স্পষ্ট করে বলা খুবই কষ্টসাধ্য। যদিও রাজনীতি সবকিছুই নিয়ন্ত্রণ করে।

‘হয়তো কোথাও বা কারো সদিচ্ছার অভাব রয়েছে। শৈলকুপা উপজেলায় বিদ্যমান যে সহিংসতা তা রোধ করতে হলে শুধু আওয়ামী লীগকে দিয়ে সম্ভব নয়। এক্ষেত্রে সমষ্টিগতভাবে ভূমিকা নিতে হবে। তা হলেই হয়তো সুদিন ফিরে আসবে।’

শৈলকুপার অব্যাহত সহিংসতা নিয়ে ঝিনাইদহের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার আনোয়ার সাঈদ বলেন, ‘উপজেলার প্রায় প্রতিটি গ্রামেই সামাজিক বিভিন্ন দল রয়েছে। তাদের মধ্যে আধিপত্য বিস্তার নিয়ে বিভিন্ন সময়ে মারামারি গন্ডগোল করতে দেখা যায়। ছোট একটা ঘটনাকে কেন্দ্র করে দুপক্ষেরই শত শত মানুষ দেশীয় অস্ত্র নিয়ে সংঘর্ষে জড়িয়ে পড়ে। এতে এসব হতাহতের ঘটনা ঘটে। এখানকার কালচারটাই এমন।’

এই পুলিশ কর্মকর্তা আরো বলেন, ‘হানাহানি বন্ধে আমরা আইনগত ব্যবস্থা নিচ্ছি। তাদের নিবৃত করার জন্য বিভিন্ন সময় দুপক্ষকে ডেকে আমরা কথা বলেছি। তাদের বাড়িতে আমরা অভিযান চালিয়ে ঢাল-সড়কিসহ দেশীয় অস্ত্র উদ্ধার করেছি। মামলা হচ্ছে, আসামিও গ্রেপ্তার হচ্ছে। আমাদের আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সর্বোচ্চ তৎপরতা সেখানে রয়েছে।’