পুলিশের বরখাস্ত ডেপুটি ইন্সপেক্টর জেনারেল (ডিআইজি) মিজানুর রহমান ও দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) বরখাস্ত পরিচালক খন্দকার এনামুল বাছিরের ঘুষের মামলার রায় আগামী মাসেই হওয়ার আশা করছেন দুই পক্ষের আইনজীবী।
মামলায় সোমবার (২৪ জানুয়ারি) শুনানি শেষে দুদকের আইনজীবী মোশাররফ হোসেন কাজল ও আসামিপক্ষের অন্যতম আইনজীবী এহসানুল হক সমাজী সাংবাদিকদের কাছে এ আশা প্রকাশ করেন। তারা বলেন, যে গতিতে মামলার বিচার চলছে তাতে সামনের মাসেই রায় হওয়ার কথা।
এ দিন শুনানির জন্য ডিআইজি মিজান এবং এনামুল বাছিরকে কারাগার থেকে আদালতে হাজির করা হয়। ঢাকার ৪ নম্বর বিশেষ জজ আদালতের বিচারক শেখ নাজমুল আলমের আদালতে যুক্তিতর্ক উপস্থাপনের সময় দুদকের আইনজীবী কাজল আসামিদের সর্বোচ্চ সাজার দাবি করেন।
১৯৪৭ সনের দুর্নীতি দমন প্রতিরোধ আইনের ৫(২) ধারায় মামলা হয়েছে তাদের বিরুদ্ধে। অপরাধ প্রমাণিত হলে তাদের সর্বোচ্চ ৭ বছরের কারাদণ্ড, সঙ্গে জরিমানাও হতে পারে।
সোমবার মামলায় দুদকের পক্ষে যুক্তিতর্ক উপস্থাপন শেষ করেন আইনজীবী মোশাররফ হোসেন কাজল। এরপর আসামিপক্ষ যুক্তিতর্ক উপস্থাপনের জন্য সময় আবেদন করেন। আদালত সময় আবেদন মঞ্জুর করে আগামী ৩ ফেব্রুয়ারি আসামিপক্ষের যুক্তিতর্ক উপস্থাপনের তারিখ ধার্য করেন। বাছিরের পক্ষে মামলা লড়ছেন জ্যেষ্ঠ আইনজীবী সৈয়দ রেজাউর রহমান।
গত ৩ জানুয়ারি আত্মপক্ষ শুনানিতে নিজেদের নির্দোষ দাবি করেন মিজানুর রহমান ও এনামুল বাছির। সেদিন তারা লিখিত বক্তব্য জমা দেবেন বলে আদালতকে জানান। এজন্য সময়ও চান। আদালত ১২ জানুয়ারি লিখিত বক্তব্য জমার তারিখ ধার্য করেন। নির্ধারিত দিনেই ডিআইজি মিজান ৬ পৃষ্ঠার ও এনামুল বাছির ১২ পৃষ্ঠার লিখিত বক্তব্য জমা দেন আদালতে।
গত ২৩ ডিসেম্বর মামলায় সাক্ষ্যগ্রহণ শেষ হয়। অভিযোগপত্রভুক্ত ১৭ সাক্ষীর মধ্যে ১২ জনের সাক্ষ্য নেন বিচারক।
৪০ লাখ টাকার ঘুষ কেলেঙ্কারির অভিযোগে ২০১৯ সালের ১৬ জুলাই দুদকের ঢাকা সমন্বিত জেলা কার্যালয়-১ এ দুদক পরিচালক শেখ মো. ফানাফিল্লাহ বাদী হয়ে মামলা করেছিলেন। মামলার তদন্ত কর্মকর্তাও তিনি।
২০২০ সালের ১৯ জানুয়ারি তাদের বিরুদ্ধে আদালতে অভিযোগপত্র দাখিল করেন শেখ মো. ফানাফিল্লাহ। একই বছরের ৯ ফেব্রুয়ারি তাদের বিরুদ্ধে অভিযোগপত্র গ্রহণ করেন ঢাকা মহানগর সিনিয়র স্পেশাল জজ কেএম ইমরুল কায়েশ।
এরপর আদালত অভিযোগ গঠনের তারিখ ধার্য করে মামলা ঢাকার বিশেষ জজ আদালত-৪ এর বদলির আদেশ দেন। ২০২০ সালের ১৮ মার্চ আসামিদের অব্যাহতির আবেদন খারিজ করে অভিযোগ গঠন করে বিচার শুরুর আদেশ দেন বিচারক।
এর আগে মামলার বিভিন্ন সাক্ষীর জবানবন্দিতে ঘুষের ঘটনার বিভিন্ন তথ্য উঠে আসে। তাদের মধ্যে কেউ কেউ ছিলেন প্রত্যক্ষদর্শী।
মামলার একজন সাক্ষী কনস্টেবল সাদ্দাম হোসেন। আদালতকে তিনি বলেন, ২০১৯ সালের ১৫ জানুয়ারি ডিআইজি মিজানের উত্তরার বাসা থেকে সাদ্দাম হোসেন দুটি ব্যাগ (একটি বাজারের ব্যাগ) সন্ধ্যার আগ মুহূর্তে গাড়িতে তুলে দেন। ব্যাগে ২৫ লাখ টাকা ও কিছু বই ছিল।
পরে ডিআইজি মিজান সাদ্দাম হোসেনকে রাজারবাগ নামিয়ে দেওয়ার জন্য গাড়িতে তোলেন। কিন্তু, ডিআইজি মিজান সাদ্দাম হোসেনকে রমনা পার্কের সামনে নিয়ে আসেন এবং বলেন, তার সঙ্গে কথা বলার জন্য একজন লোক আসবেন। তার সাথে কথা শেষে সাদ্দাম হোসেনকে যাওয়ার অনুমতি দেন ডিআইজি মিজান।
কিছুক্ষণ পরে লোকটি রমনা পার্কের আসেন। তারা দুজন পার্কে গিয়ে কথা বলেন। এরপর তারা গাড়িতে ওঠেন। ডিআইজি মিজান চালককে ওই লোককে রাজারবাগ মোড়ের সামনে ইসলামী ব্যাংক হাসপাতালের গলিতে নামিয়ে দিতে বলেন। যাতায়াতের মধ্যবর্তী সময়ে তারা অনেক কথা বলেন। মিজান স্যার ওই লোককে বলেন, ব্যাগে ২৫ লাখ ঠিক আছে।
তখন ওই লোক প্রশ্ন করেন যে সব ঠিক আছে ভাই? মিজান স্যার বলেন, সব ঠিক আছে। পরে ওই লোকটাকে ইসলামী ব্যাংক হাসপাতালের গলিতে নামিয়ে দেওয়া হয়। লোকটি যাওয়ার পর সাদ্দাম ডিআইজি মিজানের কাছে জিজ্ঞাসা করেন, সে কে? তখন ডিআইজি মিজান তাকে বলেন, লোকটি দুদক কর্মকর্তা এনামুল বাছির।
ডিএমপির অতিরিক্ত কমিশনার থাকাকালে বিয়ে গোপন করতে নিজের ক্ষমতার অপব্যবহার করে স্ত্রীকে গ্রেফতার করানোর অভিযোগ ওঠে ডিআইজি মিজানের বিরুদ্ধে। এছাড়া এক সংবাদ পাঠিকাকে প্রাণনাশের হুমকি ও উত্ত্যক্ত করার অভিযোগে ডিআইজি মিজানের বিরুদ্ধে বিমানবন্দর থানায় সাধারণ ডায়েরি (জিডি) হয়।
নারী নির্যাতনের অভিযোগে ২০১৯ সালের জানুয়ারির শুরুর দিকে তাকে প্রত্যাহার করে পুলিশ সদর দপ্তরে সংযুক্ত করা হয়। সেসময় সম্পদের তথ্য গোপন ও অবৈধভাবে সম্পদ অর্জনের অভিযোগে মিজানের বিরুদ্ধে মামলা করে দুদক। এর অনুসন্ধান কর্মকর্তা ছিলেন দুদকের পরিচালক খন্দকার এনামুল বাছির।
মামলার তদন্ত চলাকালে ডিআইজি মিজান অভিযোগ করেন, অবৈধ সম্পদ অর্জনের অভিযোগ থেকে রেহাই দিতে দুদকের পরিচালক এনামুল বাছির তার কাছ থেকে ৪০ লাখ টাকা ঘুষ নিয়েছেন। এ অভিযোগ ওঠার পর বাছিরকে সরিয়ে দুদকের আরেক পরিচালক মো. মঞ্জুর মোরশেদকে অনুসন্ধান কর্মকর্তা নিয়োগ দেওয়া হয়। ঘুষ লেনদেনের অভিযোগ খতিয়ে দেখতে ফানাফিল্লাহকে প্রধান করে তিন সদস্যের দলকে অনুসন্ধানের দায়িত্ব দেওয়া হয়।
তদন্তকালে উভয়ের অপরাধ প্রাথমিকভাবে প্রমাণিত হওয়ায় অভিযোগপত্র অনুমোদন দেওয়া হয়। অর্থ পাচার ও ঘুষ লেনদেনের অভিযোগ ওঠার পর ডিআইজি মিজানকে পুলিশ থেকে এবং পরিচালক বাছিরকে দুদক থেকে সাময়িক বরখাস্ত করা হয়।