logo
আপডেট : ২৫ জানুয়ারি, ২০২২ ২২:১৪
চতুর্থবারের মতো দুর্নীতি সূচকে বাংলাদেশের স্কোর ২৬
নিজস্ব প্রতিবেদক

চতুর্থবারের মতো দুর্নীতি সূচকে বাংলাদেশের স্কোর ২৬

ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল

ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনালের (টিআই) ২০২১ সালের ‘দুর্নীতির ধারণা সূচকে’ (করাপশন পারসেপশন্স ইনডেক্স বা সিপিআই) বিশ্বের দুর্নীতিগ্রস্ত দেশগুলোর তালিকায় বাংলাদেশে এক ধাপ এগিয়েছে। সর্বোচ্চ দুর্নীতিগ্রস্ত দেশের তালিকায় গত বছর বাংলাদেশের অবস্থান ১২তম হলেও এবার হয়েছে ১৩তম। মোট ১০০ স্কেলের মধ্যে ২৬ স্কোর পেয়ে এক ধাপ উন্নতি করলেও টানা ১০ বছর একই অবস্থানে রয়েছে বলে দাবি করছে বার্লিনভিত্তিক ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল (টিআই)। গতকাল মঙ্গলবার ভার্চুয়ালি দুর্নীতির ধারণা সূচক (সিপিআই) প্রতিবেদন প্রকাশ করেন ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের (টিআইবি) নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান।

টিআইবি দাবি করছে, ২০২১ অনুযায়ী শূন্য থেকে ১০০ স্কেলে বাংলাদেশের স্কোর ২৬, যা ২০২০-এর তুলনায় অপরিবর্তিত রয়েছে। তালিকায় সর্বোচ্চ স্কোর প্রাপ্তির ক্রমানুসারে বাংলাদেশের অবস্থান ১৮০টি দেশের মধ্যে ১৪৭তম, যা ২০২০-এর তুলনায় এক ধাপ নিচে। আর সর্বনিম্ন স্কোরের হিসাবে বাংলাদেশের অবস্থান ২০২০ সালের তুলনায় এক ধাপ ওপরে ১৩তম। একই স্কোর পেয়ে বাংলাদেশের সঙ্গে যৌথভাবে ১৩তম স্থানে রয়েছে মাদাগাস্কার ও মোজাম্বিক। ১৬ স্কোর পেয়ে দক্ষিণ এশিয়ার শীর্ষ দুর্নীতিগ্রস্ত দেশের তালিকায় আফগানিস্তান। বাংলাদেশের অবস্থান দক্ষিণ এশিয়ার দ্বিতীয় সর্বশীর্ষ, এশিয়ায় তৃতীয়। টিআইবি একে অত্যন্ত বেদনাদায়ক বলে মন্তব্য করেছে। সূচকে ৮৮ স্কোর পেয়ে কম দুর্নীতিগ্রস্ত হিসেবে যৌথভাবে তালিকার শীর্ষে অবস্থান করছে ডেনমার্ক, ফিনল্যান্ড ও নিউজিল্যান্ড। ৮৫ পয়েন্ট পেয়ে যৌথভাবে তালিকায় দ্বিতীয় স্থানে সিঙ্গাপুর, সুইডেন ও নরওয়ে এবং ৮৪ পেয়ে তালিকার তৃতীয় স্থানে রয়েছে সুইজারল্যান্ড।

অন্যদিকে ১১ স্কোর পেয়ে ২০২১ সালে সবচেয়ে দুর্নীতিগ্রস্ত দেশের তালিকার শীর্ষস্থানে আছে দক্ষিণ সুদান। ১৩ স্কোর পেয়ে তালিকার দ্বিতীয় স্থানে সিরিয়া ও সোমলিয়া এবং ১৪ স্কোর পেয়ে তৃতীয় স্থানে রয়েছে ভেনেজুয়েলা। টিআইবি জানায়, এবারের সিপিআই ২০২১ গবেষণায় মোট ১৮০টি দেশের মধ্যে ৬৫টি দেশের স্কোর বেড়েছে, ৪৮টি দেশের স্কোর অপরিবর্তিত রয়েছে এবং ৬৬টি দেশের স্কোর কমেছে। এর মধ্যে তালিকায় নতুন অন্তর্ভুক্ত হয়েছে ফিজি। টিআইবি দাবি করছে, সূচক অনুযায়ী ২০২১ সালে বাংলাদেশের অবস্থান সংক্রান্ত ব্যাখ্যায় সিপিআই দাবি করছে, ২০২১ অনুযায়ী ১০০ এর মধ্যে বৈশ্বিক গড় স্কোর ৪৩। সেই বিবেচনায় বাংলাদেশের স্কোর ২৬ হওয়ায় দুর্নীতির ব্যাপকতা এখনো উদ্বেগজনক বলে প্রতীয়মান হয়। দুর্নীতির ব্যাপকতা ও গভীরতার কারণে বাংলাদেশ দুর্নীতিগ্রস্ত বা বাংলাদেশের অধিবাসীরা সবাই দুর্নীতি করে। এ ধরনের ভুল ব্যাখ্যা প্রদান করা হয়। যদিও দুর্নীতি বাংলাদেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ও দারিদ্র্য দূরীকরণ সর্বোপরি টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা অর্জনের পথে কঠিন অন্তরায়, তথাপি দেশের আপামর জনগণ দুর্নীতিগ্রস্ত নয়। তারা দুর্নীতির কারণে ক্ষতিগ্রস্ত ও ভুক্তভোগী মাত্র। ক্ষমতাবানদের দুর্নীতি এবং তা প্রতিরোধে ব্যর্থতার কারণে দেশ বা জনগণকে কোনোভাবেই দুর্নীতিগ্রস্ত বলা যাবে না।

২০১২-২০২১ এক দশকের সূচক অনুযায়ী, বাংলাদেশের অবস্থান সম্পর্কে সিপিআই জানায়, সূচকে বাংলাদেশের স্কোর ও অবস্থান ২০১২ সালে যা ছিল ১০ বছর পরও একই রয়েছে। বাংলাদেশের বর্তমান স্কোর ২৬/১০০, নিম্নক্রম অনুযায়ী অবস্থান ১৩তম, যেটি ২০১২ সালের অনুরূপ। শেষ ১০ বছরে বাংলাদেশের স্কোর ঘুরেফিরে ২৫ থেকে ২৮ এর মধ্যেই রয়ে গেছে। এর মধ্যে টানা চার বছরসহ মোট ছয়বার বাংলাদেশের স্কোর ছিল ২৬, দুবার ২৫ এবং একবার করে ২৭ ও ২৮। আর গত ১০ বছরে নিম্নক্রম অনুযায়ী বাংলাদেশের অবস্থান সর্বোচ্চ চারবার ১৩তম, দুবার ১৪তম এবং একবার করে ১২, ১৫, ১৬ ও ১৭তম; যা সূচকে বাংলাদেশের অবস্থানের সার্বিক কোনো অগ্রগতি নির্দেশ করে না, তেমনি দুর্নীতি নিয়ন্ত্রণে অস্বস্তিকর স্থবিরতার প্রমাণ দেয়। এমনকি গত কয়েক বছর পর্যন্ত দুর্নীতির বিরুদ্ধে প্রধানমন্ত্রীর শূন্য সহনশীলতার অঙ্গীকারসহ সরকারের দুর্নীতিবিরোধী বিভিন্ন পর্যায়ের ঘোষণা সত্ত্বেও উল্লিখিত এক দশকে এ নিম্ন স্কোর ও অবস্থান প্রমাণ করেÑ আইনের যথাযথ প্রয়োগ ও কাঠামোগত দুর্বলতায় বাংলাদেশের অবস্থানের কোনো উন্নতি হচ্ছে না।

দক্ষিণ এশীয় দেশগুলোর সঙ্গে বাংলাদেশের তুলনা অনুযায়ী, ২০২১ সালের সিপিআই প্রতিবদনে দেখা যাচ্ছেÑ দক্ষিণ এশিয়ায় শুধু ভুটান তালিকার প্রথম সারিতে ২৫ তম স্থান পেয়েছে, যদিও এ অঞ্চলের আটটি দেশই ২০২০ সালের তুলনায় এবার অধিক স্কোর অর্জনে ব্যর্থ হয়েছে। ভুটান, ভারত, নেপাল ও বাংলাদেশের স্কোর অপরিবর্তিত থাকলেও মালদ্বীপ, পাকিস্তান, শ্রীলঙ্কা ও আফগানিস্তানের স্কোর নিম্নমুখী (অবনমন) রয়েছে। আর উচ্চক্রম অনুযায়ী, অবস্থানের দিক থেকে একমাত্র ভারতের এক ধাপ উন্নতি হয়েছে এবং নেপালের অবস্থান অপরিবর্তিত রয়েছে। অবশিষ্ট দেশগুলোর প্রতিটিরই অবস্থানের নিম্নমুখী হয়েছে। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি অবনমন হয়েছে পাকিস্তানের ১৬ ধাপ, মালদ্বীপের ১০ ধাপ, আফগানিস্তানের ৯ ধাপ ও শ্রীলঙ্কার ৮ ধাপ।

সূচক অনুযায়ী, দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে দুর্নীতির মাত্রা সবচেয়ে কম ভুটানে। দেশটির স্কোর ৬৮, যা ২০২০ সালের সমান; যদিও উচ্চক্রম অনুযায়ী, সূচকে দেশটির অবস্থান গতবারের তুলনায় এক ধাপ অবনমন হয়ে ২৫। এরপর মালদ্বীপ গতবারের তুলনায় ৩ পয়েন্ট কম পেয়ে ৪০ স্কোর করেছে এবং উচ্চক্রম অনুযায়ী, ১০ ধাপ অবনমন হয়ে ৮৫তম অবস্থানে রয়েছে। ভারতের স্কোর অপরিবর্তিত থেকে গতবারের সমান ৪০ হলেও উচ্চক্রম অনুযায়ী, এক ধাপ উন্নতি হয়ে দেশটি ৮৫তম অবস্থানে উঠে এসেছে। এরপর শ্রীলঙ্কা গতবারের তুলনায় ১ পয়েন্ট কমে ৩৭ স্কোর করেছে এবং উচ্চক্রম অনুযায়ী, ৮ ধাপ অবনমন হয়ে ১০২তম অবস্থানে রয়েছে। আর নেপালের স্কোর ৩৩ এবং অবস্থান ১১৭, যা ২০২০ সালের তুলনায় অপরিবর্তিত রয়েছে। এরপর পাকিস্তান গতবারের তুলনায় ৩ পয়েন্ট কম পেয়ে ২৮ স্কোর করেছে এবং উচ্চক্রম অনুযায়ী, ১৬ ধাপ অবনমন হয়ে ১৪০তম অবস্থানে রয়েছে। আর অপরিবর্তিত ২৬ স্কোর নিয়ে এবং উচ্চক্রম অনুযায়ী, গতবারের তুলনায় এক ধাপ অবনমন হয়ে ১৪৭তম অবস্থানে আছে বাংলাদেশ। সর্বশেষ ২০২০ সালের থেকে ৩ পয়েন্ট কমে ১৬ স্কোর নিয়ে উচ্চক্রম অনুযায়ী, ১৭৪তম অবস্থানে নেমে গেছে আফগানিস্তান, অর্থাৎ অবনমন হয়েছে ৯ ধাপ।

প্রতিবেদন প্রকাশের পর সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে ড. ইফতেখারুজ্জামান বলেন, দুর্নীতি কমানোর ক্ষেত্রে সম্ভাবনা আছে, কিন্তু তা বাস্তবায়নে অনেক বাধা রয়েছে। আমাদের প্রতিষ্ঠান আছে, আইন আছে এবং রাজনৈতিক অঙ্গীকার আছে। রাজনীতির শীর্ষপর্যায় থেকে এ অঙ্গীকার করা হয়। সুন্দর সহশীলতার কথা বলা হয়েছে। এটি একবার বলা হয়নি, ২০১৮ নির্বাচনের ইশতেহার প্রকাশের সময় প্রধানমন্ত্রী সুন্দর সহশীলতার ঘোষণাটা দিয়েছিলেন। তারপর থেকে তিনি অনেকবার এ বিষয়ে বলেছেন। কিন্তু যাদের ওপরে সুন্দর সহনশীলতা বাস্তবায়নের দায়িত্ব, তাদের একাংশ দুর্নীতিতে নিমজ্জিত। দুর্নীতির ফলে লাভবান, দুর্নীতিবাজদের সুরক্ষা দেন, দুর্নীতিকে উৎসাহিত করেন এবং জবাবদিহিমূলক প্রতিষ্ঠানগুলোকে অকার্যকর করে দেওয়া, রাজনৈকিভাবে একমুখী করে দেওয়া, পেশাগত দক্ষতাকে নিয়ন্ত্রণে নেওয়ার কারণে আমরা ন্যায়বিচার দেখতে পাই না। আমরা দেখতে পাইÑ দুর্নীতি সত্যিই বিকাশ হচ্ছে, দুর্নীতিকে বাস্তবাতা হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করা হচ্ছে। এ জায়গায় পরিবর্তন লাগবে। এজন্য টিআইবি দেখতে চায় রাজনৈতিক সংস্কৃতিতে একটা আমূল পরিবর্তন। তা হচ্ছে রাজনৈতিক অবস্থান, রাষ্ট্রীয় বস্তু ও সরকারি বস্তুকে কোনো অবস্থায়ই নিজেদের ব্যক্তিগত সম্পদ বিকাশের উপায় হিসেবে দেখা যাবে না। এ জায়গা থেকে সরে এসে জনগণের আগ্রহকে সব থেকে প্রাধান্য দিয়ে রাজনীতি এবং সরকার পরিচালনা করতে হবে। তাহলে আমরা মনে করি, ইতিবাচক জায়গায় যেতে পারব।

ড. জামান বলেন, বাংলাদেশে সেই সম্ভাবনা অবশ্যই আছে। বাংলাদেশ অর্থনৈতিকভাবে জিডিপির গ্রোথে, অন্যান্য আর্থসামাজিক সূচকে অগ্রগতি করছে। এটি আমাদের গৌরবের বিষয়। কিন্তু এ অগ্রগতি আরো সুষম হতে পারত। অনেক গতিশীল হতে পারত। আরো উন্নত হারে হতে পারত। মোটকথা, আরো জনগণবান্ধব হতে পারত। তিনি বলেন, দুর্নীতির কারণে জনগণ তাদের মৌলিক সেবা থেকে বঞ্চিত হয়। রাষ্ট্রীয় ও সরকারি সেবা পাওয়ার জন্য তাদের ঘুষ দিতে হয় এবং তা না হলে সেই সেবা পাচ্ছেন না। এ অবস্থায় আমরা চলে গেছি। কাজেই অবস্থার পরিবর্তন করতে হবে। তিনি বলেন, দুর্নীতি প্রতিরোধে আমাদের দুটি প্রস্তাবÑ প্রথমত, রাজনৈতিক সংস্কৃতিতে আমূল পরিবর্তন লাগবে, জনস্বার্থকে প্রাধান্য দিতে হবে। যারা ক্ষমতায়, ক্ষমতার কাছাকাছি, ক্ষমতা ব্যবহারের সুযোগ পান, তারা ক্ষমতাকে লাইসেন্স হিসেবে নেবেন না, নিজেদের সম্পত্তি হিসেবে নেবেন না, এ জায়গা থেকে সরে আসতে হবে। দ্বিতীয়ত, প্রধানমন্ত্রী বলেছিলেন, দুর্নীতি নিয়ন্ত্রণে গণমাধ্যম এবং সাধারণ মানুষকে সম্পৃক্ত করতে হবে। সেটাকে কার্যকর করতে হবে। এমন একটা পরিবেশ সৃষ্টি করতে হবেÑ যাতে করে জনগণ, সাধারণ নাগরিক, গণমাধ্যম, সংবাদকর্মী এবং নাগরিক সমাজ সবাই যেন দুর্নীতির বিরুদ্ধে কথা বলার এবং দুর্নীতির বিরুদ্ধে প্রতিবেদন করার সুযোগ অবারিতভাবে পায়। তাদের কথার যেন মূল্য দেওয়া হয়। তাদের যেন ভয়ভীতি দেখানো না হয়, তাদের যেন মামলা-হামলার শিকার হতে না হয়। এদিকে নজর রাখতে হবে।