logo
আপডেট : ২৬ জানুয়ারি, ২০২২ ০৮:০০
৫৮ খালে দখলদার ২৪৮
রাজন ভট্টাচার্য

৫৮ খালে দখলদার ২৪৮

রাজধানীর খালগুলোর সাম্প্রতিক তথ্য

যুগের পর যুগ দখলের পরও সম্প্রতি এক জরিপে রাজধানীতে ৫৮টি খাল চিহ্নিত করেছে ঢাকা জেলা প্রশাসন। এর মধ্যে ৩৭টি খালের অংশবিশেষ রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষসহ (রাজউক) তিনটি সরকারি ও সাতটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠান, রাজনৈতিক দল এবং ২৪৮ জন ব্যক্তি দখল করে নিয়েছে। ফলে খালগুলোর প্রবাহ আর স্বাভাবিক নেই।

গবেষণা প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশ সেন্টার ফর এনভায়রনমেন্ট অ্যান্ড জিওগ্রাফিক্যাল ইনফরমেশন সার্ভিসেস (সিইজিআইএস)-এর গবেষণা সূত্র জানায়, ঢাকা জেলা প্রশাসনের হিসাবে ঢাকায় ৫৮টি খালের মধ্যে ৩২টির অস্তিত্ব হারিয়ে গেছে। নদীর সঙ্গে সংযোগও প্রায় বিচ্ছিন্ন হয়ে গেছে। এতে জলাবদ্ধ হয়ে পরিণতি ভোগ করছে ঢাকার প্রায় দুই কোটি মানুষ।

অস্তিত্ব সংকটে থাকা ৫৩টি খাল উদ্ধার করে নদীর প্রবাহের সঙ্গে যুক্ত করার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। খাল দখলমুক্ত করতে আটঘাট বেঁধে মাঠে নেমেছে স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়সহ দুই সিটি করপোরেশন।

সিটি করপোরেশন বলছে, এজন্য প্রয়োজন প্রায় শত কোটি টাকা। রাজধানীর খালগুলোর একটির সঙ্গে অন্যটির সংযোগ তৈরি করে ওয়াটার ট্রান্সপোর্ট চালু করার কথা জানিয়েছে স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়। ইতোমধ্যে বিলীন হয়ে যাওয়া রামচন্দ্রপুর খাল উদ্ধারে অভিযান চলছে।

এদিকে পানি উন্নয়ন বোর্ডের অধীনে থাকা খালগুলো সিটি করপোরেশনের কাছে হস্তান্তরের জন্য প্রধানমন্ত্রীর কাছ থেকে অনুমোদন নেওয়া হয়েছে। এছাড়া গৃহায়ন ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয়ের আওতাধীন খালগুলো হন্তান্তর প্রক্রিয়াধীন রয়েছে বলে জানা গেছে।

জেলা প্রশাসনের প্রতিবেদনে আরো বলা হয়েছে, যে খালগুলো এখনো টিকে আছে সেগুলোর অধিকাংশ ময়লা-আবর্জনার চাপে স্বাভাবিক প্রবাহ ধরে রাখতে পারছে না। দ্রুত উদ্ধার না করলে সেগুলোও হারিয়ে যাবে।
জানা গেছে, একসময় ঢাকায় ৭৭টির বেশি খাল সচল ছিল। চারপাশ দিয়ে বয়ে যাওয়া বুড়িগঙ্গা, শীতলক্ষ্যা, তুরাগ ও বালু নদীর সঙ্গে সংযুক্ত ছিল ওই খালগুলো। নৌকা, স্টিমার চলত সেসব নদী-খালে। সেসময় নৌপথে মালামাল পরিবহণ ও বাণিজ্যিক প্রসার ঘটে। প্রাকৃতিক সৌন্দর্যে অপরূপ ছিল তখন ঢাকা। প্রবহমান নদী ও খালের সুবিধাই মুঘলদের ঢাকায় রাজধানী প্রতিষ্ঠা করতে উৎসাহিত করে। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে দখল আর দূষণে একে একে হারিয়ে যেতে থাকে খালগুলো।

নগর পরিকল্পনাবিদ ও নগর গবেষণাকেন্দ্রের প্রতিষ্ঠাতা অধ্যাপক নজরুল ইসলাম বলেন, তিন যুগে রাজধানীর এসব খাল-জলাভূমির অধিকাংশ দখল হয়ে গেছে। এখন সামান্য বৃষ্টিতে ডুবে যাচ্ছে ঢাকার রাস্তাঘাট। তাই ঢাকা শহরকে বাঁচাতে হলে যেকোনো উপায়ে ঢাকার খালগুলো উদ্ধার করতে হবে। পানিপ্রবাহের প্রাকৃতিক ব্যবস্থাকে ফিরিয়ে আনতে হবে। তা না হলে এই শহরকে কেউ আর রক্ষা করতে পারবে না।

উত্তর সিটি করপোরেশনের মেয়র আতিকুল ইসলাম বলেন, মৃতপ্রায় জায়গাগুলো উদ্ধারে ১০০ কোটি টাকা বরাদ্দ চাই আমাদের স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ের কাছ থেকে। খাল আগের রূপে ফিরিয়ে আনতে অনেক টাকার প্রয়োজন। রামচন্দ্রপুর খাল পুনরুদ্ধার হলে ওয়াকওয়ে, সাইকেল লেন ও খেলার মাঠসহ নির্মাণ করা হবে দৃষ্টিনন্দন পার্ক।

নগর পরিকল্পনাবিদ এবং স্থপতি ইকবাল হাবিব মনে করেন, অবৈধ দখল হয়ে যাওয়া উদ্ধার করা কাজটি যদিও সহজ নয়। তবে সিটি করপোরেশনের মালিকানায় খালগুলো আসায় এর রক্ষাণাবেক্ষণ ভালো হবে। কিন্তু এ কাজে সফল হওয়ার জন্য দীর্ঘমেয়াদি নগর পরিকল্পনা, সামাজিক ও প্রশাসনিক সক্ষমতা এবং সচেতনতা তৈরি করা প্রয়োজন।

রাজধানীতে দখল হয়ে যাওয়া একটি মৃতপ্রায় খাল (সংগৃহীত ছবি)

 

কোন খাল কোন নদীতে সংযুক্ত হবে
সোয়া পাঁচ কিলোমিটার দীর্ঘ কাটাসুর ও রামচন্দ্রপুর খালটি কল্যাণপুর খাল হয়ে যুক্ত হবে তুরাগে। গাবতলী, দারুসসালাম, কল্যাণপুর, শ্যামলী, আদাবর, পীরেরবাগ, আগারগাঁও তালতলা, শেওড়াপাড়ার একাংশ, মাজার রোড, আনসার ক্যাম্প, লালকুঠি, টোলারবাগ, পাইকপাড়া, আহমেদাবাদ, শাহআলী বাগ, বড়বাগ, মণিপুর, মিরপুর-১, ২, ৬, ১১, ১২ নম্বর আবাসিক এলাকা, রূপনগর ও জাতীয় চিড়িয়াখানা এলাকার এ খালটিও তুরাগে যুক্ত হবে।
মিরপুরের বাউনিয়া খালের সঙ্গে মিরপুরের সাংবাদিক কলোনি খাল, বাইশটেকি খাল ও মিরপুর হাউজিং এলাকার খালগুলো সংযুক্ত। সব মিলে এটি ১৪ দশমিক ৪ কিলোমিটার দীর্ঘ লম্বা। দখলের কারণে বর্তমানে এই খালগুলো পরস্পর থেকে বিচ্ছিন্ন। এগুলোকে যুক্ত করে মিরপুরের পল্লবী, কালশী, মিরপুর ১০ নম্বর, ১৩ ও ১৪ নম্বর এবং মিরপুর ডিওএইচএস আবাসিক এলাকার সব নিষ্কাশন নালা খালের সঙ্গে যুক্ত হয়ে তুরাগে মিলবে।

উত্তরা ও বিমানবন্দর এলাকার সব নিষ্কাশন নালা যুক্ত হয়েছে ১১ কিলোমিটার দীর্ঘ আবদুল্লাহপুর খালের সঙ্গে। খালটি উত্তরার কাছে টঙ্গী খালের সঙ্গে যুক্ত ছিল। কিন্তু তা এখন বিচ্ছিন্ন। আবদুল্লাহপুর খালের সঙ্গে টঙ্গী খালের সংযোগ পুনঃপ্রতিষ্ঠা করা হবে।

ঢাকার একসময়কার অভিজাত আবাসিক এলাকা ধানমন্ডি এলাকার সব নিষ্কাশন নালার পানি ধানমন্ডি লেক হয়ে হাতিরঝিলে গিয়ে পড়ত। কিন্তু পান্থপথ সড়ক নির্মাণের সময় ধানমন্ডি লেক ও হাতিরঝিল বিচ্ছিন্ন করে ফেলা হয়। হাতিরঝিলের সঙ্গে সংযোগ হবে বালু নদীর।

পুরান ঢাকা, জিরানী, মান্ডা, মেরাদিয়া-গজারিয়া, কসাইবাড়ি, শাহজাহানপুর, শাহজাদপুর, সুতিভোলা, ডুমনি, বোয়ালিয়া, রামপুরা, গোবিন্দপুর, সেগুনবাগিচা ও খিলগাঁও-বাসাবো খালগুলো সুবিধামতো মিলবে বুড়িগঙ্গা ও শীতলক্ষ্যা নদীতে।

গত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে রাজধানীর খালগুলো উদ্ধারে অভিযান চালিয়েছিল সেনাবাহিনী। তখনো ৪৭টি খাল চিহিৃত করা হয়। ঢাকা ডিটেইল্ড এরিয়া প্ল্যানে (ড্যাপ) ঢাকায় মোট খালের সংখ্যা ৪৩টি বলে উল্লেখ করা হয়েছে। জাতীয় নদী রক্ষা কমিশন রাজধানী ঢাকার খাল সম্পর্কে ৫৭ পৃষ্ঠার এক বিশদ প্রতিবেদন তৈরি করেছে সম্প্রতি। খাল হারিয়ে যাওয়ার সব তথ্য রয়েছে ওই প্রতিবেদনে। নদী রক্ষা কমিশন ঢাকাসহ আশপাশের এলাকা মিলিয়ে মোট ৭৭টি খালের অস্তিত্ব চিহ্নিত করেছে।

মঙ্গলবার (২৫ জানুয়ারি) রাজধানীর মোহাম্মদপুরের রামচন্দ্রপুর খালে দখলকারীদের উচ্ছেদ অভিযান চালায় ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশন। এসময় ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেন স্থানীয় সরকারমন্ত্রী তাজুল ইসলাম ও ঢাকা উত্তর সিটির মেয়র আতিকুল ইসলাম। মন্ত্রী বলেন, ঢাকার সব খাল উদ্ধার করে ওয়াটার বাস চালুর পরিকল্পনা করছে সরকার।

 

অবৈধভাবে দখল হওয়া খালগুলোকে উদ্ধার করা হবে : স্থানীয় সরকারমন্ত্রী
রাজধানীতে অবৈধভাবে দখল হওয়া খালগুলোকে উদ্ধার করা হবে বলে জানিয়েছেন স্থানীয় সরকার মন্ত্রী মো. তাজুল ইসলাম। গতকাল মঙ্গলবার রাজধানীর মোহাম্মদপুরের বসিলায় রামচন্দ্রপুর খালের অবৈধ স্থাপনা উদ্ধার অভিযান কার্যক্রম পরিদর্শনে গিয়ে তিনি এসব কথা বলেন। তিনি বলেন, সব খাল উদ্ধার করে দৃষ্টিনন্দন করা গেলে মানুষ বিদেশ থেকে ঢাকায় বেড়াতে আসবে।

এসময় ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের মেয়র বলেন, যতই বাধা আসুক খাল উদ্ধার অভিযান অব্যাহত থাকবে। ঢাকায় পানিপ্রবাহ সচল করা সম্ভব হলে জলাবদ্ধতা কমবে।

উদ্ধারকৃত খালসমূহ সংস্কার করা হলে রাজধানীতে জলাবদ্ধতা নিরসনের পাশাপাশি নগরবাসীকে একটি আধুনিক-দৃষ্টিনন্দন ও বাসযোগ্য নগর উপহার দেওয়া সম্ভব হবে বলেও জানান মন্ত্রী।

স্থানীয় সরকারমন্ত্রী বলেন, যারা সরকারি জায়গায় অবৈধ স্থাপনা নির্মাণে কোটি কোটি টাকা বিনিয়োগ করেছেন তারা স্বাভাবিকভাবেই এখন ক্ষতিগ্রস্ত হবেন। এর ফলে সব জায়গায় একটি মেসেজ চলে যাবে যে অবৈধভাবে অবকাঠামো নির্মাণ করে রেহাই পাওয়ার সুযোগ নেই।

তিনি আরো বলেন, শুধুমাত্র এখানকার খাল উদ্ধার হবে আর অন্যগুলো হবে না- এমনটা ভাবা উচিত হবে না। ঢাকা শহরের যত জায়গা দখল করে অবৈধ স্থাপনা নির্মাণ করেছেন বা করার পাঁয়তারা করছেন তারা সতর্ক হবেন। কোনো দখলবাজদের বরদাশত করা হবে না। জনগণের কল্যাণ প্রতিষ্ঠিত করার জন্য সবকিছু করবে সরকার।

রাজধানীর খালগুলোর একটির সঙ্গে অন্যটির সংযোগ তৈরি করে ওয়াটার ট্রান্সপোর্ট চালু করা হবে। এ লক্ষ্যে বিদেশি বিনিয়োগ সংস্থার সঙ্গে একাধিক সভা করে প্রকল্প হাতে নেওয়া হচ্ছে। খুব শিগগিরই কাজ শুরু হবে। ঢাকা শহরের ঐতিহ্যকে ফিরিয়ে আনতেই হবে।

নিয়মিত পরিষ্কারের অভাবে ঢাকার খালগুলো ভরে যাচ্ছে আবর্জনায়। এর মাসুল দিতে হয় বর্ষাকালে (সংগৃহীত ছবি)

 

 

তিনি বলেন, জনপ্রতিনিধির হাতে দায়িত্ব দিলে খাল উদ্ধার করা সহজ হবে। কারণ জনপ্রতিনিধিদের সঙ্গে জনগণ থাকে। তাদের ঐক্যবদ্ধ করলে সব চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করা সম্ভব। সে উদ্দেশ্যেই রাজধানীর কিছু খাল ঢাকা ওয়াসার নিকট থেকে দুই সিটি করপোরেশনের নিকট হস্তান্তর করা হয়েছে। দায়িত্ব পাওয়ার পর থেকেই দুই সিটি করপোরেশন জোরালো অভিযান চালিয়ে খাল উদ্ধারকাজ শুরু করেছে। যার ফলাফল এখন দৃশ্যমান।
জনগণের আশা-আকাক্সক্ষা পূরণের জন্য দুই মেয়র আন্তরিকভাবে কাজ করে যাচ্ছেন। তাদের সঙ্গে সরকারের পূর্ণ সমর্থন আছে এবং যেকোনো চ্যালেঞ্জ এবং ঝুঁকি মোকাবিলায় সরকার পাশে থাকবে বলে উল্লেখ করেন তিনি।
মন্ত্রী আরো বলেন, কয়েকজন মানুষের জন্য রাজধানীর দুই কোটি মানুষের জীবন অতিষ্ঠ হতে পারে না। আর এটা কখনোই করতে দেওয়া হবে না। রাজধানীতে পরিকল্পিতভাবে ট্রাক ও বাসস্ট্যান্ড নির্মাণ করার কাজ চলছে উল্লেখ করে তিনি বলেন, যেখানে যে পরিমাণ রাস্তার দরকার তা নির্মাণ করতে হবে।

তাজুল ইসলাম জানান, ঢাকা শহরে এখনো ৫৩টি খালের অস্তিত্ব রয়েছে। এসব খাল উদ্ধার করে যদি নৌ চলাচল ও দুই পাশে ওয়াকওয়ে নির্মাণের ব্যবস্থা করার পাশাপাশি দৃষ্টিনন্দন করা যায় তাহলে মানুষ ভেনিস ঘুরতে না গিয়ে ঢাকা শহরে আসবে।

এদিকে রাজধানীর মোহাম্মদপুরের রামচন্দ্রপুর খাল উদ্ধারের তৃতীয় দিনের অভিযানেও গুঁড়িয়ে দেওয়া হয় অবৈধ স্থাপনা। বিভিন্ন খালের ৪২টি পয়েন্ট দখলমুক্ত করে পানি প্রবাহ নিশ্চিত করা হবে বলে জানিয়েছেন উত্তরের মেয়র আতিকুল ইসলাম।