জিডিপির সার্বিক তথ্যগুলো যদি দেখি তাহলে দেখ যাবে অর্থনীতি করোনাজনিত মন্দার প্রভাব থেকে বের হয়ে আসছে। অর্থনীতি পুনরুদ্ধারের আয়োজন চলছে। পরিসংখ্যন ব্যুরোর তথ্য অনুযায়ী, ২০২১ সালে আমাদের জাতীয় অর্থনীতি আগের বছরের চেয়ে ভালো অবস্থানে ছিল। ২০২০ সালে প্রবৃদ্ধি ছিল ৩.৫ শতাংশ। ২০২১ সালে তা বৃদ্ধি পেয়ে হয় ৫.৪ শতাংশ। ইতোমধ্যে ২০২২ সালের প্রবৃদ্ধি নিয়ে বিশ্বব্যাংক, আইএমএফ ও এডিবি প্রাক্কলন করেছে। এ ব্যাপারে ইউএনও’রও একটি রিপোর্ট বেরিয়েছে। সংখ্যার ভিন্নতা আছে, তারপরও যেটা বলা যায় তাহলো ২০২১ অর্থবছর ভালো ছিল। ২০২২ অর্থবছর তার চেয়ে ভালোর দিকে যাচ্ছে। কেউ কেউ বলছেন, এ বছর প্রবৃদ্ধি হবে ৬ শতাংশ। কারো কারো মতে, ৫.৮, ৬.৪ বা ৬.৬ শতাংশ। সংখ্যার দিক থেকে তারতম্য থাকলেও অর্থনীতি রিকোভারি হচ্ছে, এটা সুস্পষ্ট।
মাসিক ভিত্তিতে আমরা অন্যান্য যে তথ্য পাই, তাও এখানে বিশ্লেষণ করা দরকার। বিশেষ করে যন্ত্রপাতি আমদানি, কাঁচামাল উৎপাদন, ট্যাক্স রেভিনিউ ও গত সেপ্টেম্বর পর্যন্ত ইন্ডাস্ট্রিটিয়াল সেক্টরের যেসব তথ্য আমাদের হাতে এসেছে, তাতে উপরোক্ত মন্তব্য করা অযৌক্তিক নয়। ক্রেডিট গ্রোথ, বেসরকারি খাতে ঋণ প্রবাহ' এসব তথ্যও এই প্রাক্কলনগুলোকেই সমর্থন করে। সবটিতেই অর্থনৈতিক পুনরুদ্ধারের একটি বার্তা আছে। এখানে বড় চালিকা শক্তি হিসেবে যেটা দেখা যাচ্ছে, সেটা হলো রপ্তানি খাত। অর্থনীতি যেসব কম্পোনে ঘুরে দাঁড়িয়েছে, তার মধ্যে দ্বিতীয় চালিকাশক্তি হলো ভোক্তা ব্যয়। সরকারি ব্যয় অন্যান্য বছরের মতো যথারীতি চলছে। বড় ধরনের কোনো পরিবর্তন নেই। ভোক্তা ব্যয়ই আমাদের জিডিপির বড় অংশ। দেখা যাচ্ছে, ভোক্তা ব্যয় অনেক বেড়েছে। আরেকটি বিষয় হলো, করোনার পর ২০২০ সালের শেষের দিকে অনেকেই জরিপ করেছিলেন, অর্থনীতির অবস্থা কী' এটা নির্ণয় করার জন্য। এ ধরনের জরিপের ফল আমরা ২০২১ সালের প্রথম দিকে দেখেছি, শেষের দিকে খুব একটা দেখা যায়নি। এ জরিপগুলোর একটি অবদান আছে। এসব জরিপে প্রাতিষ্ঠানিক কোনো পরিসংখ্যান আসে না। করোনার বড় আঘাতের বড় জায়গা ছিল নগরগুলো, বিশেষ করে ঢাকা এবং চট্টগ্রাম। আরবান এলাকাগুলোতে সংক্রমণ বেশি ছিল। এখানকার ইনফর্মাল সেবা খাতগুলোতে বেশি আঘাত এসেছিল। এখানেই করোনা সংক্রমণের ঝুঁকিটা একটু বেশি।
আমরা দেখেছি, ২০২০ সালে অনেকে নগর ছেড়ে গ্রামের বাড়ি চলে গেছেন। এটা বেশি হয়েছে ঢাকা এবং চট্টগ্রামে। কারণ কাজ নেই, ব্যবসা নেই। শহরে থেকে ঘরভাড়া দেওয়া, বিদ্যুৎ বিল দেওয়া কঠিন হয়ে যায়। ফলে বাধ্য হয়ে গ্রামে চলে গেছেন তারা। যারা গ্রামে চলে গেছেন তাদের কত ভাগ ফিরে আসেন তা নিয়ে সরাসরি জরিপভিত্তিক কোনো তথ্য নেই। তবে আশপাশের চিত্র দেখলে যেটা মনে হয় আরবান বা নগরকেন্দ্রিক অর্থনীতিও ঘুরে দাঁড়াচ্ছে। ২০২০ সালের শেষে করোনার সংক্রমণ একটু কমে আসার পর দোকান খুললেও গ্রাহক পাওয়া যেত না। অথচ করোনার আগে যেখানে দোকান খুললেই একশ’-দেড়শ’ গ্রাহক পাওয়া যেত। করোনার সংক্রমণ কমে আসার অব্যবহিত পর পাওয়া যেত বিশ-পঁচিশজন। রিকশাওয়ালা বাইরে বের হলেও যাত্রী পেত না, নাপিতরা দোকান খুললেও গ্রাহক পেত না। সেই সময়ের তুলনায় এখন ওমিক্রনের সংক্রমণ বেড়ে যাওয়ার সময়েও মানুষ বেশি বাইরে যাচ্ছে। মানুষ কাজকর্ম করছে, রিকশায় ঘুরছে, পান-বিড়িওয়ালা দোকান খুলছে, মানুষ সেলুনে যাচ্ছে। নিত্যদিনের কাজগুলো অনেকটা স্বাভাবিকভাবেই করছে। আগে এগুলো দেখা যেত না।
আমাদের দেশের মানুষ শ্রমের ভিত্তিতেই জীবিকা নির্বাহ করে। সাধারণ মানুষের কাছে এই পুনরুদ্ধারের ফল কতটা পৌঁছাচ্ছে, সেটা নির্ভর করে দুটি বিষয়ের ওপর। প্রথমটি হলো কর্মসংস্থান। করোনাকালে যারা কর্মসংস্থান হারিয়েছেন, তারা কি আবার আগের কর্মস্থলে ফিরতে পেরেছেন? ফিরলেও আগের মতো কি মজুরি পাচ্ছেন? কর্মসংস্থান নিয়ে একটি স্টাডিতে দেখা যায়, হারানো কর্মসংস্থানও রিকোভারি হচ্ছে। কিন্তু করোনা পূর্ববর্তীর পরিস্থিতিতে পৌঁছায়নি এখনো। করোনাপূর্ব পরিস্থিতির বেইজলাইনকে যদি আমরা একশ’ ভাগ ধরি, তাহলে করোনাকালে তা নেমে এসেছিল পঞ্চাশ ভাগে। সেটা এখন ৮৮ থেকে ৯০ ভাগে ফিরে এসেছে। ২০২১ এর শুরুর দিকে অন্যদের জরিপেও এমন তথ্য ছিল। তবে কাজ যেভাবে ফিরে এসেছে, আয় সে হারে ফিরে আসেনি। আরেকটি তথ্য আছে, সেটা পরিসংখ্যন ব্যুরোর। সেখানে মজুরি বৃদ্ধির বিষয়টি তুলে ধরা হয়েছে। ডিসেম্বর পর্যন্ত ১২ মাসে ৬ শতাংশ মজুরি বৃদ্ধি পেয়েছে। আবার মূল্যস্ফীতির কথা যদি ধরি সেটাও ৬ শতাংশের কাছাকাছি। তার মানে হলো মজুরি ৬ শতাংশ বাড়ল। আবার জীবন নির্বাহের খরচ সেটাও বেড়েছে। আগের বছরে যে পণ্য বা সেবা ১০০ টাকায় কেনা হয়েছে, এখন সেটা ১০৬ টাকায় কিনতে হচ্ছে। কাজেই প্রকৃত মজুরি খুব একটা বাড়েনি। বলতে পারি রিকোভারি যেটা হচ্ছে সেটা হলো' জিডিপির গ্রোথ ৩.৫ থেকে ৫ বা ৬.৫ এর কাছাকাছি হচ্ছে। এখানে রিকোভারিটা শ্রমজীবি মানুষের কাছে পৌঁছাচ্ছে না।
এখানে শিল্প খাতে মজুরি সবচেয়ে বেশি বৃদ্ধি পেয়েছে। এখানে বৃদ্ধির হার প্রায় ৮ শতাংশ। সেটা হলো তৈরি পোশাকশিল্পে এখন প্রচুর অর্ডার আছে, শ্রমিকরা কাজ করছে, শ্রমিকের চাহিদা আছে। ফার্মাসিউটিক্যাল সেক্টর বরাবরই ভালো করেছে। করোনার মধ্যে সবচেয়ে ভালো করেছে। ই-জাতীয় প্রডাকশন বেড়েছে। সিমেন্ট ও লাইট ইঞ্জিনিয়ারিং ইত্যাদি খাতের পরিসর বাড়ছে। বিবিএস এর তথ্য অনুযায়ী শিল্পের উৎপাদন সেক্টরে মূল্যস্ফীতির হারের চেয়ে মজুরি বৃদ্ধি পেয়েছে বেশি। শ্রমিকের মজুরি বেড়েছে, এটা সব খাতে প্রযোজ্য নয়। যেসব খাতে মজুরি বেড়েছে, তাতে আমাদের লেবার ফোর্সের বড় অংশ সম্পৃক্ত নয়। মূল্যবৃদ্ধির চেয়ে একেবারে পিছিয়ে আছে কনস্ট্রাকশন বা নির্মাণ ও মৎস্য খাত। এখানে নির্মাণ খাতে মজুরি বৃদ্ধি পেয়েছে ৪.৩ শতাংশ, মৎস্য খাতে ২.৭ শতাংশ। তাদের প্রকৃত মজুরি কমে গেছে। আবার অপ্রাতিষ্ঠানিক খাতে মজুরি বৃদ্ধি পায়নি। সেখানেই আমাদের কর্মসংস্থানের হার সবচেয়ে বেশি। সর্বোপরি করোনা রিকোভারির ফল শ্রমজীবি মানুষের কাছে পুরোপুরি পৌঁছেনি। এ রিকোভারি আরো টেকসই করতে হবে এবং আরো অন্তর্ভুক্তিমূলক হতে হবে। করোনার আগেই বিনিয়োগের স্থবিরতা ছিল, করোনার মধ্যে বন্ধ হয়ে গিয়েছিল। সেখানে প্রযুক্তি ও মেডিকেল খাতের বিষয়টি আলাদা। করোনার মধ্যে বিনিয়োগের সুযোগ ছিল না, অনিশ্চয়তা ছিল। সেখানে সেই অনিশ্চয়তা এখনো কাটেনি। বৈদেশিক বাণিজ্যের আমদানি ব্যয় বেড়ে গেছে। আন্তর্জাতিক বাজারে কমোডিটি মূল্যের বাজার বেড়ে গেছে। ফলে একই পরিমাণ পণ্য আমদানির জন্য বেশি পরিমাণে এলসি খুলতে হচ্ছে। উৎপাদনে সক্ষমতা বৃদ্ধি করতে ওয়ার্কিং লোনের চাহিদা বেড়েছে। কিন্তু দীর্ঘমেয়াদি বিনিয়োগের জন্য যে ঋণের প্রয়োজন সেটা সে হারে শুরু হয়নি। যে কারণে ওই দীর্ঘমেয়াদি ঋণের চাহিদা বাড়েনি সেটা হলো' বিনিয়োগের জন্য যেসব বাধা ছিল, প্রত্যাশিতভাবে সেগুলোর উন্নতি হয়নি।
বাস্তবতা হলো, রিকোভারিটা টেকসই হবে কি না, আরেকটি ধাক্কা আসবে কি না! এগুলো আর ইনক্লুসিভ করা যায় কি না! এবং এগুলোর চ্যালেঞ্জ কী কী! প্রথমটি হলো কোভিড ম্যানেজমেন্ট। করোনা সংক্রমণ বাড়ছে। এগুলো নিয়ন্ত্রণের জন্য যেসব উপায় আছে এর মধ্যে কিছু উপায় অর্থনীতির চাকাকে একেবারে বন্ধ করে দেয়। আর কিছু উপায় হলো অর্থনীতিকে সচল রেখে মোকাবিলার করার। আমাদের এখন দ্বিতীয়টির প্রতি বেশি মনোযোগ দেওয়া দরকার। কারণ দুই বছরের অভিজ্ঞতায় আমরা বাংলাদেশে যেটা দেখেছি লকডাউনের মতো যেসব উদ্যোগ নেওয়া হয়, গণপরিবহন বন্ধ করে দেওয়া হয় সেগুলো আমরা বাস্তবায়ন করতে পারি না। এজন্য স্বাস্থ্যসেবার উন্নতি করতে হবে। যাতে সবাইকে ভ্যাকসিন দেওয়া যায় সেদিকে গুরুত্ব দিতে হবে।
আরেকটি বিষয় হলো, বিনিয়োগের একটি চ্যালেঞ্জ। ভোক্তা বৃদ্ধি পেয়েছে, এটা আমরা দেখতে পাচ্ছি। এটি একটি সাময়িক ব্যাপার। কাজেই উৎপাদন ক্ষমতা বৃদ্ধি না করলে চাহিদা বৃদ্ধি পাবে না। আর এই বৃদ্ধির প্রক্রিয়াটা হলো বিনিয়োগ। এখন প্রয়োজন হলো উৎপাদন ক্ষমতা বৃদ্ধি করা। এখানে বিনিয়োগের প্রয়োজন। বিনিয়োগ করতে হলে তো অনেক প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে যেতে হয়। অবকাঠামো প্রয়োজন, ট্যাক্স পলিসি' নানা বিষয় এর সাথে যুক্ত। আছে রেগুলেশনের জটিলতা। ফাইন্যান্সিয়াল সেক্টরের নানাবিধ সমস্যা। এখানে সংস্কার কার্যক্রম গ্রহণ করতে হবে।
এখানে আরো একটি বড় কাজ তাহলো শিক্ষা কার্যক্রমকে জাম্প করা। দেড় বছর ধরে শিক্ষা কার্যক্রম বন্ধ ছিল। প্রবৃদ্ধির উৎস কিন্তু আমাদের ওটাই। শক্তিটা ওখান থেকেই আসবে। যদি দক্ষ শ্রমিক না পায় তাহলে উৎপাদন হবে না। নিরাপদ দূরত্ব বজায় রেখে কিভাবে ক্লাস চালিয়ে নেওয়া যায় তার বিকল্পগুলো ভাবতে হবে।
চতুর্থ চ্যালেঞ্জ হলো সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ, ম্যাক্রো ম্যানেজমেন্ট। মূল্যস্ফীতি ইতোমধ্যে বেড়ে গেছে। বড় সমস্যা হচ্ছে জোগানের দিক থেকে সমস্যার কারণে। আন্তর্জাতিক পণ্য বাজারের মূল্য বৃদ্ধি পেয়েছে। তেল ও গ্যাসের দাম বেড়েছে। পরিবহনের ভাড়া বৃদ্ধি পেয়েছে। এগুলো অর্থনীতিতে সংক্রমিত হতে সময় লাগে। পরিবহনের ভাড়া বৃদ্ধি পেলে সব জায়গায় প্রভাব পড়ে। আগামী পাঁচ ছয় মাস পরিস্থিতি স্বাভাবিক থাকলেও এরপর মূল্যবৃদ্ধিজনিত সংকট আরো ঘনীভ‚ত হবে। তেলের দাম ওঠা-নামা নিয়ে যেটা করা হয় তা করা হয় অ্যাডহক ভিত্তিতে; আমলাতান্ত্রিক সিদ্ধান্ত। এক্ষেত্রে একটি টেকসই ব্যবস্থা নিতে হবে। আন্তর্জাতিক বাজারে তেলের দাম বাড়ালে যেমন স্থানীয় বাজারে বাড়ানো হয়, তেমনি কমলে দ্রত কমাতে হবে।
সর্বশেষ মূল্যস্ফীতি এখন বড় একটি চ্যালেঞ্জ। আরেকটি চ্যালেঞ্চ হলো বৈদেশিক বাণিজ্যের ঘাটতি। পণ্য মূল্য বেড়ে গেছে। ফর্মাল চ্যানেলে রেমিট্যান্স আসা কমে গেছে। বৈদেশিক সাহায্য, এফডিআই, পোর্টফোলিও ইনভেস্টমেন্ট এগুলো চাহিদার তুলনায় হয়নি। এ কারণে বৈদেশিক মুদ্রা চাহিদার তুলনায় জোগান হয়নি। যার কারণে বৈদেশিক মুদ্রার বিনিময় হারের ওপর একটি চাপ তৈরি হয়েছে। এটা ঠেকানোর জন্য বাংলাদেশ ব্যাংক প্রায় দুইশ’ কোটি ডলারের বৈদেশিক মুদ্রা বিক্রি করেছে। তা সত্ত্বেও ডলারের বিনিময় হার ১ দশমিক ৭ শতাংশ বেড়ে গেছে। এখানে হিসাবটা মেলানো কঠিন হয়ে গেছে।
লেখক: বিশ্বব্যাংকের সাবেক চিফ ইকোনমিস্ট