একটি দায়বদ্ধতা থেকে বঙ্গবন্ধু কর্নার করেছিলাম। যা করপোরেট পর্যায়ে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবকে তুলে ধরার প্রয়াস। এর শুরু করেছিলাম রাষ্ট্রায়ত্ত বাণিজ্যিক ব্যাংকের মৌলভীবাজারের একটি শাখাতে। পরবর্তীতে ব্যাংকটির কার্যালয় করা হয়। এরপর মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নির্দেশনাক্রমে সারাদেশের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানসহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে কর্নার।
শুরুটা আমার ব্যক্তিগত দায়বদ্ধতার জায়গা থেকে। আমি ২০০৯ সালে যখন অগ্রণী ব্যাংকের জেনারেল ম্যাজেনার হলাম, তখন আমার মাথায় এলো কিভাবে করপোরেট লেভেলে বঙ্গবন্ধু চর্চার একটি উপযোগী মাধ্যম হয়। ১৯৮৪ সালে আমি যখন এই ব্যাংকটিতে যোগদান করি, তখন পুরাতন মানুষের কাছে থেকে শুনতাম সাবেক হাবিব ব্যাংকের কর্মকর্তারা বাঙালি ব্যাংকারদের কিভাবে ট্রিট করত। খুবই অবহেলা করত বাঙালিদের। যাতে বাঙালি ভালো কোনো পজিশনে আসতে না পারে। এই যে বঞ্চনা, আমি জয়েন করার পর থেকে শুনে আসছিলাম। পশ্চিম পাকিন্তানিরা নিজেরা ভালো ব্যাংকিং জানত কিন্তু বাঙালিদের ব্যাংকিং শেখাত না। ব্যাংকিং শেখালে তো তাদের মূল্য থাকবে না, বাঙালিরা বড় কর্মকর্তা হয়ে যাবে। কোনো নারীকে চাকরি দেওয়া হতো না। ভালো কোয়ালিটি থাকলেও তাকে ভালো পোস্ট দিতো না। এগুলো শুনতে শুনতে আমার ক্যারিয়ার শুরু। জিএম হলাম। তখন আমার মধ্যে চিন্তা এলো দেশ আজ স্বাধীন হয়েছে বলে আমি জিএম হলাম। দেশ যদি স্বাধীন না হতো তাহলে আমি জিএম হতে পারতাম না। কেন হলাম, দেশ স্বাধীন হয়েছে বলে আমি জিএম হলাম। দেশকে স্বাধীন করল জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিববুর রহমান।
আমি তখন ভাবলাম, আমার জন্য যখন ভালো খবর হয় তখন আমি বাবা-মায়ের পায়ে সালাম করি। মারা গেলে কবর জিয়ারত করি। এই যে আমি জিএম হলাম বঙ্গবন্ধুর কবর জেয়ারতই শেষ করে তৃপ্তি পাচ্ছি না। করপোরেট লেভেলে তাকে কিভাবে শ্রদ্ধা করা যায়। এমন একটা কিছু করা দরকার যেখানে গেলে বঙ্গবন্ধুর সৃষ্টি চোখের সামনে ভেসে ওঠে। এই যে করপোরেট-অগ্রগতি সব বঙ্গবন্ধুর ত্যাগের দান। এ বার্তা করপোরেট লেভেলে পৌঁছে দিতে হবে। আমি যদি আর্টিস হতাম তাহলে একটি ছবি আঁকতে পারতাম, যদি কবি হতাম তাহলে একটি কবিতা লিখতে পারতাম বা গান লিখে উপহার দিতে পারতাম। আল্লাহ তো আমাকে সেই গুণ দেয়নি। আমি করপোরেট মানুষ, আমার সে ধরনের কোনো গুণ নেই, আমার সীমাবদ্ধতা আছে।
আমি তখন দেশে এলাম। ২০০৯ সাল। আমাকে হেড অব আইডি-ইন্টারন্যাশনাল বিভাগের দায়িত্ব দেওয়া হলো। সিলেট ডিভিশনের বাড়তি দায়িত্ব ছিল আমার ওপর। মৌলভীবাজারের অফিসে ইন্সপেকশনে গিয়ে দেখি একটি জায়গা খালি আছে। আমি বললাম এই যে কর্নারটা খালি আছে এখানে আমি বুকসেলফ দেব। আর বঙ্গবন্ধুর কর্মের ওপর বই দেব। তোমরা বঙ্গবন্ধুকে চর্চা করবা। বঙ্গবন্ধুকে চর্চা করলে বঙ্গবন্ধু পরিষদ বা এ ধরনের যে কার্যক্রমগুলো আছে তার চেয়ে অফিসে বসে বঙ্গবন্ধুকে চর্চা করতে পারবে। দেশপ্রেম বাড়বে, ফাঁকি দিতে পারবে না। আরও বেশি করে কাজ করতে পারবা। ত্যাগের মনোভাব তৈরি হবে। কার মহান ত্যাগের বিনিময়ে প্রিয় এ দেশ সেটা জানতে পারবা। তারপর আমি বইমেলা, বাংলা একাডেমি, বিভিন্ন লাইব্রেরি, ইসলামী ফাউন্ডেশনসহ বিভিন্ন জায়গা থেকে বঙ্গবন্ধুর জীবন ও কর্মের ওপর বই সংগ্রহ করে এনে দিলাম। ওরাও সংগ্রহ করল। এভাবে বঙ্গবন্ধু কর্নারটা হয়ে গেল। এটা ২০১০ সালের কথা।
এরপর যখন ২০১৫ সালের আনসার ও ভিডিপি ব্যাংকের এমডি হয়ে গেলাম তখন কাজটি আরও সম্প্রসারণের সুযোগ এলো। যখন প্রথম আমি মৌলভীবাজারে বঙ্গবন্ধু কর্নার তৈরি করি, তখন আমি জিএম ছিলাম। দায়িত্ব ছিল ছোট্ট, কর্নার শাখা পর্যায়ে করেছিলাম। ইতিমধ্যে এই কর্নারের জনপ্রিয়তা ও উপযোগিতা আমি লক্ষ্য করলাম। এর মাধ্যমে মানুষ বঙ্গবন্ধু চর্চা শুরু হয়ে গেছে। তখন সিদ্ধান্ত নিলাম এটি আরও বড় পরিসরে কিভাবে শুরু করা যায়। তখন আনসার ও ভিডিপি ব্যাংকে আমার অফিসের পাশে একটি রুমকে বঙ্গবন্ধু কর্নারের জন্য ঠিক করি। মেজর জেনারেল নিজামুদ্দিন আনসার ব্যাংকের চেয়ারম্যান ছিলেন। তার রুম আর বোর্ড রুমের কর্নারের রুমটি ঠিক করা হলো। ওখানে গ্লাসফাইবারে বঙ্গবন্ধুর আবক্ষ ভাস্কর্য স্থাপন করলাম। আমি তো বঙ্গবন্ধুর জীবদ্দশায় পাই নাই, ছোট্ট ছিলাম। এটা স্থাপনের পর মনে হলো বঙ্গবন্ধুর সামনেই আছি। ইতোমধ্যে অসমাপ্ত আত্মজীবনীও বের হলো। বঙ্গবন্ধুর ওপর বই সিডি সংগ্রহ করে বঙ্গবন্ধু কর্নারকে সমৃদ্ধ করলাম। এরপর জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ৪১তম শাহাদাতবার্ষিকী উপলক্ষে দুইজন এমপিকে দিয়ে কর্নার উদ্বোধন করেছিলাম। যদিও সেটা এক সময়ে বঙ্গবন্ধুর সাথে কাজ করা ড. মশিউর রহমানের উদ্বোধন করার কথা ছিল, তিনি হঠাৎ করে খুলনাতে চলে যাওয়ার কারণে সেটা আর হলো না; উদ্বোধন করেন
দুইজন এমপি।
এরপর আমি অগ্রণী ব্যাংকে আসি। অগ্রণী ব্যাংক হলো সেই ব্যাংক, যার নামকরণ করেছিলেন বঙ্গবন্ধু নিজে। স্বাধীনতাপূর্ব এই ব্যাংকের নাম ছিল হাবিব ব্যাংক। স্বাধীনতা-পরবর্তী স্বাধীন দেশকে সামনে এগিয়ে নেওয়ার অভীষ্টকে সামনে রেখে নাম দেওয়া হলো অগ্রণী ব্যাংক। এখানে এসে বঙ্গবন্ধু কর্নার আরও ভালোভাবে কিভাবে চালু করা যায়, সে ব্যাপারে উদ্যোগ নিলাম। যে কর্নার আমি অগ্রণী ব্যাংকের মৌলভীবাজারে শুরু করেছিলাম, সেই কর্নার প্রধান কার্যালয়ে আরও বড় পরিসরে কিভাবে চালু করা যায় চিন্তা-ভাবনা শুরু করলাম। প্রধান কার্যালয়ে একটি কাভার্ড ওয়েটিং রুম ছিল। যেটিতে মানুষ রেস্ট নিত, আড্ডা দিত। অনেকে ঘুমাত। সেটা খুলে দিলাম। একটি বুক সেলফ করে দিলাম। একটি আবক্ষ ভাস্কর্য আনার কথা ভাবলাম, যা হবে দর্শনীয়, দৃষ্টিনন্দন, ভাবগাম্ভীর্য এবং হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালি স্বাধীনতা সংগ্রামের মহানায়ক জাতির জনককে ফুটিয়ে তুলবে। ভাস্কর্য বসানো হলো। ব্রোঞ্চের, ১১৭ কেজি ওজনের। আবক্ষ ভাস্কর্যটি এতই সুন্দর হয়েছে, বঙ্গবন্ধুর তিলটি পর্যন্ত বাদ যায়নি। এই কর্নারের জন্য আমি যেমন প্রশংসিত হয়েছি, আবার সমালোচনার শিকারও হয়েছি। কেউ কেউ বলেছে, ‘আরে, আপনি তো বঙ্গবন্ধুকে পাশে নিয়ে নিলেন!’
যখন সমালোচনা আসতে লাগল তখন আমার মনে হলো, আমি একজন করপোরেট পার্সন, আমার সীমাবদ্ধতা আছে। আমাকে একটি গণ্ডির মধ্যে থাকতে হয়। গণ্ড ছাড়িয়ে গেলাম, অবাধ্য হলাম কি না! আমার বিপরীত চিন্তাও হলো, আমি করেছি আবেগ থেকে, আমি জাতির জনককে শ্রদ্ধা জানাব। এটা তো ভিড়-জমায়েতের কোনো বিষয় নয়। মানুষের সমালোচনার পরিপ্রেক্ষিতে মনে হলো, আমি কী ভুল করলাম, না ঠিক করলাম। ঠিক করলাম যদি কোনোদিন মাননীয় প্রধানমন্ত্রী জননেত্রী শেখ হাসিনার কাছে তুলে ধরতে পারতাম, তার প্রতিক্রিয়াটা জানতে পারতাম, তাহলে শান্তি পেতাম। যা করেছি, নেত্রীর নোটিশে তুলে ধরার মধ্য দিয়ে ভুল বা ঠিকটা হয়েছে সেটা জানতে পারতাম। যদি পছন্দ না করতেন তাহলে স্থগিত করে এ উদ্যোগ থেকে সরে আসতাম। মানুষের সমালোচনার ফলে এক ধরনের অস্বস্তি তৈরি হয়েছিল।
২০১৬ সালে প্রধানমন্ত্রীর সাথে সাক্ষাৎ করার একটি সুযোগ হলো। আমরা রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলো প্রধানমন্ত্রীর ত্রাণ তহবিলে চেক দেওয়ার সময় বিষয়টি তুলে ধরলাম। পরিকল্পনা মতো কোর্টের বুক পকেটে বঙ্গবন্ধু কর্নারের দুটি ছবি নিয়ে গেলাম। একটি অগ্রণী ব্যাংকের, অপরটি আনসার ও ভিডিপি ব্যাংকের। আমার আবেগ এমন পর্যায়ে পৌঁছেছিল যে, আমি আজ সরকারপ্রধানকে বলবই, আমার চাকরি থাক, আর যাক। এটা না করলে উপায়ও নেই। চেকটা দিচ্ছিলাম আর ঘামছিলাম। ভাবছিলাম এরপর কি করব। সময় কম, অন্য ব্যাংক চলে আসবে। হ্যাঁ, আরেকটি কথা বলে নিই। এর আগে অগ্রণী ব্যাংকের ৫০০তম বোর্ড মিটিংয়ে অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আব্দুল মুহিত, অর্থ ও পরিকল্পনা প্রতিমন্ত্রী এমএ মান্নান, বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর ও অর্থসচিব সাহেব এসেছিলেন। সবাই এই কর্নার দেখে খুশি। মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর কাছে তুলে ধরার ব্যাপারে, এটা কিছুটা সাহস জুগিয়েছিল।
চেক দেওয়ার পর কথার ফাঁকে প্রধানমন্ত্রীর সামনে ছবি দুটি তুলে ধরলাম। বললাম, মাননীয় প্রধানমন্ত্রী আমি দুটি বঙ্গবন্ধু কর্নার করেছি। একটি অগ্রণী ব্যাংকে। আরেকটি আনসার ও ভিডিপি ব্যাংকে, আমি যখন আনসার ও ভিডিপি ব্যাংকে ছিলাম তখনকার। এখানে বঙ্গবন্ধুর জীবন ও সংগ্রাম এবং অর্জন নিয়ে যেসব বই, শিল্পকর্ম আছে সেগুলো তুলে ধরেছি। অর্থমন্ত্রী ও পরিকল্পনামন্ত্রীও এটার প্রশংসা করেছেন। ছবি দুটি দিতে দিতে কথা বলছিলাম আর প্রধানমন্ত্রীর অভিব্যক্তি দেখছিলাম, উনি কিভাবে এটা নিচ্ছেন। তাঁর মুখের দিকে তাকিয়ে দেখলাম খুশির একটা ভাব চলে আসছে। ছবি দুটি বেশ খানিক সময় ধরে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখলেন। বললেন, গুড আইডিয়া। প্রধানমন্ত্রীর কথা শুনে মনে মনে বললাম বাঁচলাম আমি। ছবিটি নিয়ে প্রধানমন্ত্রীর অফিসের সাজ্জাদ সাহেবকে দিলেন। দেড় মাস পর একটি সরকারি নির্দেশ এলো সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের লাইব্রেরিতে বঙ্গবন্ধু কর্নার করতে হবে। এরপর চারদিকে খবর প্রচারিত হয়ে গেল। বিভিন্ন সংবাদপত্রে খবর প্রকাশিত হলো। বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান থেকে মানুষ দেখতে এলো কি করেছি, কেমন করে করেছি তা দেখার জন্য। যেসব পত্রিকা সরকারের বিপক্ষে লেখে তারাও বিষয়টি ফলাও করে নিউজ করল। এখন দেশে, বিদেশে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে, থানা পর্যায়ে বঙ্গবন্ধু কর্নার প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে। চর্চা করা হচ্ছে বঙ্গবন্ধুকে। ক’দিন আগে দেখলাম বিদেশের একটি বিশ^বিদ্যালয়েও বঙ্গবন্ধু চর্চা শুরু হয়েছে।
এ কাজের মধ্য দিয়ে আমি করপোরেট লেভেলে বঙ্গবন্ধুকে তুলে ধরার চেষ্টা করেছি। করপোরেট লেভেলে আজ যারা নবাগত তারা স্বাধীন দেশের স্থপতি সম্পর্কে জানলেও অর্থনীতির পরিমণ্ডলে বঙ্গবন্ধুর ‘মুক্তির সংগ্রাম’-এর ভাবনাকে তুলে ধরার চেষ্টা করেছি। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে শোষণমুক্ত সোনার বাংলাদেশ গড়ার যে প্রচেষ্টা অব্যাহত আছে তাই তুলে ধরার চেষ্টা বঙ্গবন্ধু কর্নারের মাধ্যমে।
(লেখাটি ভোরের আকাশকে দেওয়া সাক্ষাৎকারের অংশ বিশেষ। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদক
জাফর আহমদ)
লেখক: ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা, অগ্রণী ব্যাংক লিমিটেড