মুসা (আ.) ছিলেন খেয়ালি নবী। অনুসন্ধিৎসা থেকে তিনি সৃষ্টিকর্তার সাথে নানা সময় মজার কথোপকথন করতেন। একবার মুসা (আ.) সৃষ্টিকর্তাকে বললেন, হে সৃষ্টিকর্তা তুমি যদি মুসা হতে আর আমি যদি সৃষ্টিকর্তা হতাম তাহলে তুমি আমার কাছে কী চাইতে? প্রত্যুত্তরে সৃষ্টিকর্তা প্রথমবার বলেন সুস্থতা, দ্বিতীয়বার বলেন সুস্থতা, তৃতীয়বারও বলেন সুস্থতা। আমি এর বিশ্লেষণ করি ঠিক এইভাবে' প্রথমত শারীরিক সুস্থতা, দ্বিতীয়ত মানসিক সুস্থতা ও তৃতীয়ত আত্মিক সুস্থতা। এই তিনটি সুস্থতা মানুষের মধ্যে যখন বিরাজমান তখন মানুষ ব্যক্তি, সমাজ ও জাতিগত জীবনে হয় উন্নত। সমাজ হয় পরিপূর্ণ ও সমৃদ্ধ। কারণ শারীরিক সুস্থতা থাকলে কাজ করার সক্ষমতা অর্জিত হয়, মানসিক সুস্থতা থাকলে একাগ্র চিত্তে কাজ করার সামর্থ্য অর্জিত হয়, আর আত্মিক সুস্থতা থাকলে কাজের মধ্যে সততা আর প্রশান্তির ছোঁয়া থাকে। পরিণামে আসে জাগতিক ও পারলৌকিক সফলতা।
বস্তুবাদী অর্থনীতির কারণে মানুষের ভোগের আকাক্সক্ষা এমনভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে যে সেখানে নেই কোনো নৈতিক বিষয়, নেই কোনো সততার বালাই, নেই কোনো ভক্তি-শ্রদ্ধা বা ভালোবাসার ছোঁয়া। আছে শুধু টাকার পেছনে ছোটার লিপ্সা। যে লিপ্সা মানুষকে শারীরিক, মানসিক ও আত্মিকভাবে অথর্ব করে দিচ্ছে। দুশ্চিন্তা, দুষ্কর্ম ও দুরাচারে মানুষের মন ও আত্মা যখন ম্রিয়মাণ থাকে তখন মন ও আত্মার খাদ্য হয় মাদক। সুস্থ দেহ-মন ও আত্মার জন্য দরকার শরীরবৃত্তীয় কাজগুলোর নিয়ন্ত্রণে নিয়োজিত হরমোনের ভারসাম্য। মানুষকে প্রফুল্ল ও কর্মক্ষম করতে দরকার অক্সিটোসিন সেরোটনিন ও ডোপামিন হরমোনের সঠিক মাত্রা। প্রয়োজনীয় হরমোন নিঃসরণে দরকার সকালে ঘুম থেকে ওঠা, খেলাধুলা, সৎচিন্তা ও সৎকর্ম। কিন্তু মানুষ সেগুলোকে প্রায় ভুলতেই বসেছে। জীবনযাপন ও কর্ম পদ্ধতির ধরন পরিবর্তনের ফলে মানুষ আরামপ্রিয় জীবে পরিণত হচ্ছে। আরাম মানুষকে যথেষ্ট দুর্বল করে দিচ্ছে। আজ আমরা ভুলতেই বসেছি যে, শারীরিক, মানসিক ও আত্মিক শক্তি ছাড়া পৃথিবীতে কোনো চ্যালেঞ্জই মোকাবিলা করা সম্ভব নয়। প্রায়ই দেখা যাচ্ছে, সামান্য মানসিক চাপেই তরুণ প্রজন্ম মাদকাসক্ত হচ্ছে অথবা আত্মহত্যার পথ বেছে নিচ্ছে। বাংলাদেশে যুবসমাজের জন্য মাদক এক ভয়াল রূপ ধারণ করেছে। এর বিস্তার রোধ করতে না পারলে দেশের টেকসই উন্নয়ন সম্ভব নয়।
জাতীয় পত্রিকার খবরে দেখা যায়, পার্শবর্তী দেশের সীমান্ত শহরগুলোতে মাদক তৈরির কারখানা রয়েছে। সেখানে তৈরি মাদক বাংলাদেশে প্রবেশ করছে। দ্বিপক্ষীয় বৈঠকে আমাদের দেশের আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর পক্ষ থেকে মাদক তৈরির কারখানাগুলোর অস্তিত্বের কথা জানালেও অপরপক্ষ তা উচ্ছেদের কোনো ব্যবস্থা নিচ্ছে না। তাহলে কি এটা আন্তর্জাতিক কোনো ষড়যন্ত্র! উদীয়মান অর্থনীতির দেশের জনগোষ্ঠীকে পঙ্গু করে দেশের অর্থনৈতিক ও সামাজিক উন্নয়নকে রোধ করা এমন ষড়যন্ত্রের অংশ নয় তো? শুধু দেশ দখলের জন্য সভ্য, পরাক্রমশালী, কর্মঠ জাতিগুলোকে ঔপনিবেশিক শক্তি মাদকাশক্তির মাধ্যমে কীভাবে দুর্বল করে রেখেছিল তার ইতিহাস আমাদের জানতে হবে। এ ক্ষেত্রে চীনের ‘আফিম যুদ্ধ’ আমাদের দেশের স্কুল-কলেজের পাঠ্যবইয়ে অন্তর্ভুক্ত করা যেতে পারে। যা নবপ্রজন্মের মনে মাদক ব্যবহারের ক্ষেত্রে নেতিবাচক ভাবনা তৈরি করবে। প্রকৃতপক্ষে মনোজগতের পরিবর্তনই কোনো সামাজিক সমস্যা নিরসনের সর্বোত্তম পন্থা। কৃষিভিত্তিক অর্থনীতির যুগে খুব ভোরে ওঠা কায়িক পরিশ্রম মানুকে সুস্থ ও সবল রেখেছিল। মানুষের মধ্যে হতাশা ছিল না। বর্তমান প্রেক্ষাপটে পরিবর্তিত জীবন পদ্ধতিতে কায়িক পরিশ্রম ও খেলাধুলা বৃদ্ধির মাধ্যমে মাদকের প্রতি আসক্তি কমতে পারে। উন্নত বিশ্বের স্কুল-কলেজ, অফিস-আদালত শুরু হয় খুব সকালে। সকালে উঠার অভ্যাস মানুষকে প্রফুল্ল রাখে। এ বিষয়ে হয়তোবা তারা গবেষণালব্ধ জ্ঞানের ওপর ভিত্তি করে সঠিক সিদ্ধান্ত নিয়েছে। পারিবারিক বন্ধনের দৃঢ়তা মাদকাসক্তি থেকে মানুষকে দূরে রাখে। পরিবারের ইংরেজি প্রতিশব্দ Family| Family-র প্রত্যেকটি বর্ণকে পৃথকভাবে বিস্তৃত করলে আমরা পাই Father and Mother ও love you. এই বিশ্লেষণটিতে প্রতীয়মান পারিবারিক জীবন পৃথিবীর যে কোনো আপদ-বিপদ থেকে মানুষকে নিরাপদ ও মানসিকভাবে সবল রাখে। মানসিকভাবে সবল ব্যক্তি কখনো মাদকাসক্ত হয় না। তারা পার্থিব ও পারলৌকিক যে কোনো কাজে সফলতা অর্জনের জন্য প্রেরণা ও উদ্দীপনা পায় তার সুস্থ পারিবারিক জীবন থেকে। সম্প্রতি পত্রিকার একটি খবর ‘বৈধ আত্মহত্যার যন্ত্র’। খবরে প্রকাশ, মানুষের মৃত্যু ঘটানোর এক যন্ত্রের আইনি স্বীকৃতি দিয়েছে সুইজারল্যান্ড। আমি অবাক বিস্ময়ে দেখি এদের হতাশার প্রাবল্য। আমার মতে, দুর্বল পারিবারিক বন্ধনের কারণেই এমন যন্ত্র পশ্চিমা সমাজ ব্যবস্থায় প্রয়োজন হয়ে পড়েছে।
আসলে মাদকের থাবায় নাস্তানাবুদ আমাদের একটি প্রজন্ম। শহর থেকে গ্রামাঞ্চল' সর্বত্রই নেশা এখন হাতের নাগালে পাওয়া যায়। এক যুগে এর বিস্তার আশঙ্কাজনকভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে বলে বিশেষজ্ঞরা মনে করেন। এই সময়ে বিভিন্ন সংস্থা অন্তত ১৫ হাজার কোটি টাকার মাদকদ্রব্য উদ্ধার করেছে। তবে এই পরিমাণ দেশে ছড়িয়ে পড়া মোটের তুলনায় কোনোভাবেই ২০-২৫ শতাংশের বেশি নয় বলে মনে করছেন এ নিয়ে কাজ করা ব্যক্তি ও সংগঠনগুলো।
তারা বলছেন, বর্তমানে সারাদেশে সেবনকারীরা প্রতিদিন গড়ে ২০ কোটি টাকার নেশা গ্রহণ করছে। বছরের হিসাবে এর পেছনে খরচ হয় আনুমানিক ৭ হাজার ৩০০ কোটি টাকা। এ ব্যবসায় জড়িত ২০০ গডফাদার ও বিক্রির নেটওয়ার্কে কাজ করে ১ লাখ ৬৫ হাজার জন। প্রতি বছরই আশঙ্কাজনকভাবে বাড়ছে এই সংখ্যা। মাদকদ্রব্য লেনদেনের মাধ্যমে হাজার হাজার কোটি টাকা পাচার হচ্ছে বিদেশে। নেশাজাতীয় দ্রব্যের বিস্তারের এই সর্বনাশা চিত্র যেভাবে আর্থিক ও শারীরিক ক্ষতি করছে, সেভাবে একটি প্রজন্মের চিন্তার জগতে বন্ধ্যত্ব সৃষ্টি করছে। দীর্ঘমেয়াদে এর ফল ভয়াবহ। বিভিন্ন পরিসংখ্যান থেকে জানা যায়, মাদকসেবীর সংখ্যা এখন ২ কোটি। এর মধ্যে দেড় কোটি নিয়মিত। ৫০ লাখের মতো অনিয়মিত। দেশে সেবনকারীরা গড়ে প্রতিদিন অন্তত ২০ কোটি টাকার মাদক সেবন করে। মাদকের মাধ্যমে শুধু টাকা পাচার হচ্ছে তা নয়। মাদক হচ্ছে অপরাধের জনক। ধর্ষণ, হত্যা, ছিনতাই, রাহাজানিসহ যত ধরনের অপরাধ হয়' সবকিছুর মূলেই এই মাদক। মাদকের অর্থের জোগানের বিষয়ে গবেষণা চালায় ঢাকা আহ্ছানিয়া মিশনের অ্যাডিকশন ম্যানেজমেন্ট অ্যান্ড ইন্টিগ্রেটেড কেয়ার (আমিক)। গবেষণা প্রতিবেদনে বলা হয়, মাদকাসক্ত ব্যক্তিদের মধ্যে ৭০ শতাংশই অভিভাবকের অর্থে মাদক কেনে। ৫৬ দশমিক এক শতাংশ ব্যয় করে নিজের অর্থ। পরিবারের সম্পদ বিক্রি করে ২০ দশমিক ৭ শতাংশ। অন্যের টাকা চুরি করে ১৫ দশমিক ৫ শতাংশ। আত্মীয়দের কাছ থেকে টাকা নিয়ে মাদক কেনে ১৪ দশমিক ২ শতাংশ ব্যক্তি। প্রতিবেদনের বিষয়ে ঢাকা আহ্ছানিয়া মিশনের হেলথ সেক্টরের পরিচালক ইকবাল মাসুদ গণমাধ্যমকে বলেন, এক ব্যক্তি একাধিক উৎস থেকেও মাদকের অর্থ সংগ্রহ করে থাকে। অর্থের জোগানে ভয়ংকর অপরাধেও জড়িয়ে পড়ে মাদকসেবীরা।
এ ব্যাপারে র্যাবের আইন ও গণমাধ্যম শাখার মতামত হলো, আমাদের সমাজে মাদকের চাহিদা আছে। আর চাহিদা থাকলে জোগান বৃদ্ধি পায়। আইনশৃঙ্খলা বাহিনী অভিযান চলালেও চাহিদার কারণে এর সরবরাহও বাজারে বাড়ছে। মাদক উদ্ধারে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর যে সাফল্য, সেটা গর্ব করার মতো। তারপরও মাদকমুক্ত সমাজ গঠন এখনো সম্ভব হয়নি। আমাদের অভিযান চলমান আছে। যেসব মাদক আসছে, এর বড় অংশই ধরা পড়ছে। মাদক নিয়ন্ত্রণে জিরো টলারেন্স নীতি নিয়ে বিভিন্ন অভিযান পরিচালিত হয়েছে। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর ক্রসফায়ারে পড়ে অনেকে মারাও গেছেন। তারপরও মাদকের বিস্তার কমছে না। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা বলছেন, মাদক নিয়ন্ত্রণ একটা মাল্টি অর্গানাইজেশনাল টাস্ক। বিভিন্নভাবে মাদক আসছে। এটা নিয়ে আরো বেশি কাজ করতে হবে। আরো মনোযোগী হয়ে কঠোর অ্যাকশনে গেলে সম্ভব। মাদকের প্রভাবে অপরাধেও জড়িয়ে পড়ছে। একটি প্রজন্ম ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে। এটা সমাজের জন্য বিষফোড়া। আগের তুলনায় গাঁজা, ইয়াবা, ফেনসিডিল সবই বেশি ধরা পড়ছে। মাদক রুখতে সবার সহযোগিতা ও সচেতনতার বিকল্প নেই।
সচেতনতা অবশ্যই দরকার। তবে রাষ্ট্র, সমাজ ও পারিবারিক আবহে দুর্নীতিমুক্ত জীবন প্রবাহ মাদক নিয়ন্ত্রণে সহায়ক। দুর্নীতির কারণে অঢেল টাকার মালিক হয়ে একটি গোষ্ঠী বিজাতীয় আনন্দের আতিশয্যে মাদকাসক্ত হচ্ছে। অন্যদল দুর্নীতির দুষ্টচক্রে নিষ্পেষিত হয়ে নিজের যোগ্য অবস্থান না পেয়ে হতাশা থেকে মাদকাসক্ত হচ্ছে। অনেক ক্ষেত্রে অসাধু দুর্নীতিপরায়ণ, সুযোগ সন্ধানী মানুষগুলো নিজেদের প্রভাব-প্রতিপত্তি ধরে রাখার জন্য ক্যাডার বাহিনী তৈরি করে। যার কেন্দ্রবিন্দুতে থাকে তরুণ প্রজন্ম। তরুণ প্রজন্ম অবৈধ টাকা হাতে পেয়ে মাদকাসক্ত হয়ে পড়ে। বর্তমান সমাজে এমন কর্মকাণ্ড কিছু মানুষ উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবেই করে। কারণ মাদকাসক্ত মানুষের স্বাভাবিক কোনো চিন্তা করার শক্তি থাকে না। তাদেরকে হীনস্বার্থ চরিতার্থে ব্যবহার করা খুবই সহজ হয়। নেশার টাকার জন্য তারা হুকুম তামিল করে চতুর্থ শিল্পবিপ্লবের আলোচিত স্বয়ংক্রিয় রোবটের মতো। কিশোর গ্যাং, এলাকাভিত্তিক বড়ভাই, ছোট ভাইয়ের যে সংস্কৃতি তা অসাধু, মতলববাজ দুষ্টচক্রের প্রয়োজনে সৃষ্ট হয়। মাদক নিয়ন্ত্রণে আইন অত্যন্ত কঠোর ও আইনের প্রয়োগ হতে হবে অতি দ্রæত। এখানে শুধু মাদক বহনকারীদেরকে ধরলে বা শাস্তি দিলে চলবে না। খুঁজে বের করতে হবে শেকড়ের শক্তি। শেকড়সুদ্ধ মাদক চক্রকে নির্মূল করতে পারলেই দূর হবে মাদকের আগ্রাসন। মনে রাখতে হবে ‘মাদকে মজলে মন, গলবে মগজ, হারাবে ধন, স্তব্ধ হবে উন্নয়ন’। ২০৪১ সালে উন্নত বাংলাদেশ, আর ২১০০ সালে সমৃদ্ধ ব-দ্বীপ গড়ার স্বপ্ন নিয়ে আমরা এগিয়ে চলেছি। দেশের উন্নয়নের সব কর্মকাণ্ডই জনগণকে ঘিরে। জনগণই যদি সুস্থ না থাকে তাহলে সমৃদ্ধ দেশ গড়ার স্বপ্ন সুদূরপরাহত।
লেখক : উপাচার্য, চাঁদপুর বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়।