ঘুম কেড়েছে ওমিক্রন। ওমিক্রনের হানায় তটস্থ গোটা বিশ্ব। কোভিড-১৯ এর নয়া প্রজাতি কার্যত ভয়াবহ পরিস্থিতি তৈরি করেছে বাংলাদেশেও। খোদ রাজধানী ঢাকায় ওমিক্রনের ৩ প্রজাতির সন্ধান পেয়েছেন চিকিৎসকরা। যখন লিখছি সেদিন দেশে ২৪ ঘণ্টায় করোনায় ১৫ জনের মৃত্যু হয়েছে। দেশে এক সপ্তাহে শনাক্ত বেড়েছে ১৮০ শতাংশ, মৃত্যু ৮৮ শতাংশ। এই সময়ে নতুন করে শনাক্ত হয়েছেন ১৪ হাজার ৮২৮ জন। শনাক্তের হার ৩২ দশমিক ৩৭ শতাংশ। যা ২২ সপ্তাহ তথা ১৫৪ দিনের মধ্যে সর্বোচ্চ। শনাক্তের এই হারের চেয়ে বেশি ছিল সর্বশেষ গত বছরের ২২ জুলাই। সেদিন প্রতি ১০০টি নমুনা পরীক্ষায় ৩২ দশমিক ১৮টিতে কোভিড পজিটিভ আসে। বলার আর অপেক্ষা রাখে না যে, দেশে প্রাণঘাতী করোনাভাইরাসের নতুন ধরন ওমিক্রনের চোখ রাঙানিতে সংক্রমণ পরিস্থিতি বেড়েই চলেছে।
বিশ^ যখন করোনাভাইরাস মহামারির এক ‘গুরুতর সন্ধিক্ষণে’ এ অবস্থায় আমরা কতটা সতর্ক? বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার (ডব্লিউএইচও) মহাপরিচালক তেদ্রোস আধানম বলেছেন, ‘করোনাভাইরাসের তীব্রতা রুখতে সব দেশকে এক জোট হয়ে কাজ করতে হবে। তিনি এও বলেছেন, করোনাভাইরাসকে শেষ করতে যা যা প্রয়োজন তার সবই এখন আমাদের হাতে আছে। আমরা (বছরের পর বছর) এভাবে মহামারি টেনে নিয়ে চলতে পারি না। এভাবে আতঙ্কে আর অবহেলায় দিন চলতে পার না।’ এর আসল সমাধান সতর্কতা। প্রশ্ন হলো আমরা কতটা সতর্ক। মাস্ক ছাড়া যত্রতত্র ঘুরছে মানুষ। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ, অথচ আন্তর্জাতিক বাণিজ্যমেলা, মার্কেট, পর্যটনগুলোতে শিক্ষার্থী-অভিভাবকদের মিলনমেলা। নিয়মনীতির বড্ড অভাব আছে আমাদের। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ রেখে বাণিজ্যমেলা চালু রেখে হাজার হাজার মানুষের জটলা তৈরি করা কতটা সঠিক কাজ!
বাংলাদেশে ব্যাপক হারে ছড়িয়ে পড়েছে ওমিক্রন। তবে ওমিক্রন নিয়ে এখনো পর্যন্ত যে তথ্য মিলেছে তাতে ডেল্টার মতো হয়তো এর প্রভাব মারাত্মক নাও হতে পারে। এমনই মনে করছেন গবেষকদের একাংশ। তবে এখনই এ ব্যাপারে নিশ্চিতভাবে কিছু জানাতেও অস্বীকার করেছেন কেউ কেউ। তবে আক্রান্ত এবং মৃত্যু রোধ করা যাবে না। এর মধ্য থেকেই আমরা কেউ হয়তো হারিয়ে যাব। এ জন্য চাই সতর্কতা। বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকরা বলেন, ওমিক্রন কখন যাবে তা বলার সময় এখনো আসেনি। নিরাপদ থাকার উপায় টিকা গ্রহণ ও স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলা। যারা টিকা গ্রহণ করেনি তাদের মধ্যে আক্রান্ত ও মৃত্যুর ঝুঁকি বেশি। সব ধনী দেশগুলোর সম্মিলিতভাবে করোনাসহ সব সংক্রমক রোগের জন্য একটি টিকা আবিষ্কার করার তাগিদ দিয়ে বিশেষজ্ঞরা বলেন, এক্ষেত্রে বাণিজ্যিক মনোভাব পরিহার করে সব ধনী দেশগুলোকে এগিয়ে আসতে হবে।
ওমিক্রন এখন বাংলাদেশ নয়, সারাবিশ্বে এক আতঙ্কের নাম। এর সংক্রমণ অত্যন্ত তীব্র্র। বর্তমানে ইউরোপের বিভিন্ন দেশ, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও ভারত বাংলাদেশসহ সারাবিশ্বে ছড়িয়ে পড়ছে নতুন ধরনের এ কারোনাভাইরাস। আবারও দেশে দেশে আরোপ করা হচ্ছে বিধিনিষেধ ও লকডাউন। করোনার সংক্রমণ বৃদ্ধি পাওয়ার পরিপ্রেক্ষিতে আমাদের দেশেও নেওয়া হয়েছে নানা পদক্ষেপ। এ অবস্থায় করোনা নিয়ন্ত্রণে রাখার ওপরই সরকারের পক্ষ থেকে সর্বাধিক জোর দেওয়া হয়েছে। সেক্ষেত্রে স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলতে হবে সবাইকে। বর্তমানে জনসাধারণের মধ্যে এ ব্যাপারে বড় ধরনের শৈথিল্য লক্ষ করা যাচ্ছে। রাস্তায়, এমনকি ভিড়ের মধ্যেও খুব কমসংখ্যক মানুষের মুখেই মাস্ক দেখা যায়। এ শিথিলতা ভয়াবহ বিপদ ডেকে আনছে। মাস্ক পরা, জনসমাগম এড়িয়ে চলা, হাত স্যানিটাইজ করা ইত্যাদি কাজে মানুষকে বাধ্য করার চেয়েও বেশি জরুরি এসব ব্যাপারে জনসচেতনতা সৃষ্টি করা। দ্বিতীয়ত, যত বেশি সম্ভব মানুষকে টিকার আওতায় আনতে হবে। আশার কথা, দেশে এখন পর্যাপ্ত টিকা রয়েছে। সরকারের টিকা কার্যক্রমও অব্যাহত আছে। শুরু হয়েছে টিকার বুস্টার ডোজ দেওয়াও। শঙ্কা বাড়াচ্ছে ওমিক্রন। স্বাস্থ্যবিধি মানতেই হবে। করোনাভাইরাসের নয়া ভ্যারিয়েন্ট ওমিক্রন মোকাবিলা করে আমাদের এ পরিস্থিতি জয় করতে হবে। সব ভয়কেই দ‚রে সরিয়ে নির্ভয়ের, নিরাপদ বাংলাদেশ গড়তেই হবে।
কোভিড বিশেষজ্ঞরা বলছেন, করোনাভাইরাসের এই ভ্যারিয়েন্টটি অন্তত ৩২টি মিউটেশন (জিনগত গঠনের পরিবর্তন) ঘটিয়েছে, যার বৈজ্ঞানিক নাম বি.১.১.৫২৯। এই ভ্যারিয়েন্টটি সারা বিশ্বকে অশান্ত করে দিতে পারে। ওমিক্রন নিয়ে বিজ্ঞানীরা যে কারণে সবচেয়ে বেশি উদ্বিগ্ন তা হলো, এটি অত্যন্ত দ্রুত এবং অতি সহজে ছড়াতে পারে এবং মানবদেহের রোগ প্রতিরোধ ব্যবস্থাকে ভেদ করতে পারে। তাই সতর্ক থাকতে হবে। আমরা সতর্ক নই বললেই চলে। জনসমাগম সবখানেই হচ্ছে। নির্বাচনও হচ্ছে। হাটবাজার পুরোদমে জমছে। করোনা কোভিড আছে আমরা তা হয়তো ভুলেই গেছি। খুব স্বাভাবিক চলাফেরা করছি আমরা। আমাদের দেশের মানুষের মধ্যে স্বাস্থ্যবিধি অনুসরণের ক্ষেত্রে এমনিতেই শৈথিল্য আছে। মাস্কবিহীন চলাচল করছি আমরা। রাস্তাঘাটে চলাচলের সময় খেয়াল করলেই দেখা যায়, বেশির ভাগ মানুষ মাস্ক পরেনি। অনেকের মাস্ক থাকলেও তা গলায় ঝুলছে। এর বাইরে যেসব বিধি পালনীয় সেগুলো প্রতিপালনের তো প্রশ্নই ওঠে না। শৈথিল্য আছে স্বাস্থ্য খাতের পরিষেবা নিয়েও। মাস্ক খুলে চলার এখনো সময় হয়নি। দেশের মানুষের আসলে হুঁশ নেই। আগের চেয়েও বাজারে এখন বেশি মানুষ। এ অবস্থায় বাংলাদেশে করোনাভাইরাসের নতুন ভ্যারিয়েন্ট ওমিক্রন ব্যাপক আকারে ছড়িয়ে পড়ার উচ্চ ঝুঁকি রয়েছে বলে বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন। স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়, বাংলাদেশের ইনস্টিটিউট ও এপিডেমাইওলজি, রোগ নিয়ন্ত্রণ এবং গবেষণা প্রতিষ্ঠান (আইইডিসিআর) বলেছে, এই ভ্যারিয়েন্ট দক্ষিণ আফ্রিকার প্রায় প্রতিটি অঞ্চলে দ্রুত গতিতে ছড়িয়ে পড়ছে। বাংলাদেশকে এ ব্যাপারে অনেক বেশি সতর্ক হতে হবে।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা বলেছে, এই ভ্যারিয়েন্ট দক্ষিণ আফ্রিকার প্রায় প্রতিটি অঞ্চলে দ্রুত গতিতে ছড়িয়ে পড়ছে। সংস্থাটি জানায়, এই ভ্যারিয়েন্টের অসংখ্য রূপান্তর আছে। তার মধ্যে বেশকিছু আছে ‘উদ্বেগজনক’। আর এটিকে করোনার ভয়াবহতম ভ্যারিয়েন্ট বলছেন বিজ্ঞানীরা। কারণ, এখন পর্যন্ত আবিষ্কৃত বেশির ভাগ টিকা ওমিক্রনের ক্ষেত্রে কার্যকর নয়। তবে এটা কতটা সংক্রামক তার সঠিক তথ্য এখনো বিজ্ঞানীরা দিতে পারেননি। তা নির্ণয়ের কাজ করে যাচ্ছেন বিজ্ঞানীরা।
করোনাভাইরাস নিয়ে কোনো হেলাফেলা চলবে না। একেবারে স্বাভাবিক জীবনযাপনের সুযোগ নেই। করোনাভাইরাস মোকাবিলায় আমাদের যুদ্ধে নামতে হবে। পরিস্থিতি সামাল দিতে নিজের মনের সঙ্গে যুদ্ধ করতে হবে। ঘুরতে না যাওয়ার, অনুষ্ঠানাদি এড়িয়ে চলা, বেশি মানুষ এক জায়গায় না হওয়ার, আড্ডাবাজি বন্ধ করতে হবে। আসুন সবাই সতর্কতার যুদ্ধে নামি। এ যুদ্ধে আমাদের জিততেই হবে। যুদ্ধ জয়ের জন্য আমরা আতঙ্কগ্রস্ত হলে চলবে না। দিশেহারা হওয়ার কোনো প্রয়োজন নেই। সরকারের গৃহীত ব্যবস্থাগুলোর সঙ্গে সহযোগিতা করার পাশাপাশি ব্যক্তি, পরিবার ও সামাজিকভাবে কার্যকর প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা সর্বদা বজায় রাখতে হবে। নিজে সতর্ক থাকতে হবে অপরকে সতর্ক করতে হবে। ভাইরাস থেকে রক্ষার একটাই পথ সতর্কতা।
বিজ্ঞানীরা মনে করছেন, আগামী কিছুদিনের মধ্যে ইউরোপে যত করোনা ধরা পড়বে তার অর্ধেকই হবে ওমিক্রন। ইসিডিসি এদিন দাবি করেছে, আফ্রিকার বতসোয়ানায় ১১ নভেম্বর প্রথম ওমিক্রন পাওয়া গেছিল। এরপর তা দক্ষিণ আফ্রিকায় ছড়ায়। এরপর অন্য দেশে তা দ্রæত ছড়াচ্ছে। ওমিক্রন ছড়িয়ে পড়ার পরই ইউরোপ এবং অ্যামেরিকা নতুন করে যাতায়াতের ওপর নিষেধাজ্ঞা জারি করেছিল। দক্ষিণ আফ্রিকার সঙ্গে সব বিমান বন্ধ করে দেওয়া হয়। কিন্তু তারপরও ওমিক্রনের সংক্রমণ আটকানো যায়নি। পাশের দেশ ভারতেও ওমিক্রন ধরা পড়েছে। যা বাংলাদেশকে ভাবায় বৈকি! এ অবস্থায় বাংলাদেশে করোনার নতুন ধরন আফ্রিকান ভ্যারিয়েন্ট ওমিক্রন প্রতিরোধে ১৫টি নির্দেশনা দিয়েছে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর। এসব নির্দেশনা দেশের প্রতিটি নাগরিকের মেনে চলা উচিত।
ওমিক্রনের জন্য শতভাগ টিকাকরণ, যারা আগে টিকা দিয়েছেন তাদের বুস্টার ডোজের কথাও বলা হচ্ছে। তবে সব স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলার বিকল্প নেই। মাস্ক পরতে হবে। ঘনঘন হাত ধুতে হবে, নাকে মুখে হাত দেয়া যাবে না। ফের হোম অফিসের পরামর্শ দিয়েছেন অনেকে। করোনাকে সামনে নিয়ে স্বাস্থ্য খাতকে সচেতন করছে সরকার। তারা একদিকে হাসপাতাল, ক্লিনিক ও ডাক্তার অন্যদিকে জনগণকেও স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলার কথা বলছে। মাস্ক ব্যবহার না করলে সরকারি অফিসে সেবা মিলবে না কিংবা ঘরের বাইরে মাস্ক ব্যবহার বাধ্যতামূলক- সরকারের তরফ থেকে এই নির্দেশ জারি করা হয়েছে। সরকারি সে নির্দেশ আমাদের অক্ষরে অক্ষরে পালন করতে হবে। করোনাভাইরাসের নয়া ভ্যারিয়েন্ট ওমিক্রন মোকাবিলা করে আমাদের এ পরিস্থিতি জয় করতে হবে। সব ভয়কেই দূরে সরিয়ে নির্ভয়ের, নিরাপদ বাংলাদেশ গড়তেই হবে আমাদের।
লেখক: সাংবাদিক, কলামিস্ট ও সমাজ গবেষক