বয়স যাই হোক, শিরদাঁড়া সোজা রাখাই আসল কথা। তার জাজ্বল্যমান প্রমাণ ভারতে তিন বঙ্গসন্তানের পদ্ম পুরস্কার প্রত্যাখ্যান। এই তিন বঙ্গসন্তান হলেন ভারতের মার্কসবাদী কমিউনিস্ট পার্টি সিপিএমের অন্যতম শীর্ষনেতা ও পশ্চিমবঙ্গের সাবেক মুখ্যমন্ত্রী বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য্য। ভারতের বিখ্যাত সংগীতশিল্পী সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায় এবং প্রখ্যাত তবলাবাদক অনিন্দ চট্টোপাধ্যায়। তারা ভারতের অত্যন্ত সম্মানজনক রাষ্ট্রীয় পুরস্কার পদ্মশ্রী ও পদ্মভূষণ প্রত্যাখ্যান করেছেন। এক বিবৃতিতে আশীতিপর বৃদ্ধ নেতা বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য্য বলেছেন, ‘পদ্মভূষণ পুরস্কার নিয়ে আমি কিছু জানি না। আমাকে এ নিয়ে কেউ কিছু বলেনি। যদি আমাকে পদ্মভূষণ পুরস্কার দিয়ে থাকে, তা হলে আমি তা প্রত্যাখ্যান করছি।’ খুব সংক্ষিপ্ত বিবৃতি। কিন্তু এই বিবৃতিই ভারতের বিবেকবান মানুষকে জাগিয়ে তুলেছে।
দিকনির্দেশনা দিয়েছে নীতিনিষ্ঠ আদর্শবান তরুণ প্রজন্মকে। তাই তো ফেসবুকে এক তরুণ লিখেছেন, বুদ্ধ বাবুকে পদ্মভূষণ পুরস্কার দেওয়া হয়েছে রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে। প্রত্যাখ্যানও রাজনৈতিক কারণে। আর এই রাজনৈতিক কারণ হলো ভারতের ধর্মভিত্তিক রাজনীতির ফাঁদকে তছনছ করে দেওয়া, যা বুদ্ধ বাবু সঠিক কাজ করেছেন। সত্যিই তো, বিজেপি সরকার কেন বুদ্ধ বাবুকে রাষ্ট্রীয় পুরস্কার দেবে? এই কারণে যে, তাঁকে ও তাঁর আদর্শকে রাজনৈতিক ফাঁদে ফেলতে। আর একটা কারণ অবশ্য আছে তা হলো, দলীয় সেবাদাসদের পুরস্কারে ভূষিত করাকে জায়েজ করতে। যাই হোক, বুদ্ধ বাবু বিজেপি সরকারের ফাঁদে পা দেননি। তিনি সরাসরি পুরস্কার প্রত্যাখ্যান করেছেন।
এ বিষয়ে তার স্ত্রী মীরা ভট্টাচার্য্য বলেছেন, উনার বয়স হয়েছে। কিন্তু শিরদাঁড়া সোজা আছে। সিদ্ধান্ত গ্রহণেও দৃঢ়তা আছে।
এক শ্রেণির মানুষ যখন সরকারের উচ্ছিষ্ট পেলেও চেটেপুটে খায়, তখন জীবন সায়াহ্নে দাঁড়িয়ে এ শোষকের মুখে চপেটাঘাত রীতিমতো বিস্ময়কর। কিন্তু না, এটা প্রথম নয়। তার আরো একইভাবে সাবেক মুখ্যমন্ত্রী জ্যোতি বসু, সাবেক মুখ্যমন্ত্রী ইএমএম নামব্রু দিরিপাদ ও কমিউনিস্ট বিপ্লবী সোমানাথ লাহিড়ী রাষ্ট্রীয় পুরস্কার প্রত্যাখ্যান করে দৃষ্টান্ত স্থাপন করে গেছেন। জ্যেতি বসুও প্রত্যাখ্যান করেছিলেন ভারতের সর্বোচ্চ রাষ্ট্রীয় পুরস্কার ভারতরত্ন। তিনি বলেছিলেন, বামপন্থি মানুষ কাজের বিনিময়ে পুরস্কার চান না। কমিউনিস্টরা পুরস্কারের জন্য লালায়িত হয় না। জ্যোতি বসুর দেখানো পথে হাঁটলেন বুদ্ধদেব। এখানেই হলো নীতি ও আদর্শের ঐক্য। এই ঐক্য আছে ও থাকবে।
এখানে উল্লেখ্য, জ্যেতি বসু ১৯৯৬ সালে ভরতের প্রধানমন্ত্রিত্বের প্রস্তাব ফিরিয়ে দিয়েছিলেন। রাজনীতিকরা যেখানে মন্ত্রী, এমপি হওয়ার জন্য যা ইচ্ছেতাই করে, সেখানে জ্যোতি বসু ভারতের মতো একটি বৃহৎ দেশের প্রধানমন্ত্রিত্বের প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করেছিলেন। তারপর গঙ্গা, যমুনা-ইরাবতী দিয়ে অনেক জল গড়িয়ে গেছে। ভারতের ধর্মনিরপেক্ষতা ধূলিসাৎ হয়ে সেখানে ধর্মীয় মৌলবাদের উত্থান হয়েছে। এমনকি ভারতের কেন্দ্রে ক্ষমতাসীন হয়েছে বিজেপির মতো একটি উগ্র ধর্মীয় মৌলবাদী দল। যার নেতারা আহমেদাবাদ দাঙ্গা ও বাবর মসজিদ ধ্বংসের সঙ্গে সরাসরি জড়িত বলে অভিযোগ আছে। এই অবস্থার মাঝে ভারতের বিপন্ন গণতণতন্ত্রকে উদ্ধারের তৎপরতা ও মুক্তবাজারের করালগ্রাস থেকে ভারতকে রক্ষার যে উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে তার প্রতি বামপন্থিদের রয়েছে দৃঢ় সমর্থন। সেই দৃঢ় সমর্থনের নীতিনিষ্ঠ নেতা হলেন বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য্য।
শত প্রলোভনে যে একজন প্রকৃত কমিউনিস্টকে টলাতে পারে না, তার জ্বলন্ত দৃষ্টান্ত ছিলেন জ্যোতি বসু ও ইএমএম নামব্রু দিরিপাদ। সেই দৃষ্টান্তে নতুন নাম যোগ হলো বুদ্ধ বাবুর। এ ক্ষেত্রে আরো একটা কথা না বললেই নয় তা হলো’ কোনো রাষ্ট্রীয় পুরস্কার গ্রহণ না করার আদর্শ একজন আদর্শবান কমিউনিস্টের শ্রেষ্ঠ পুরস্কার। বুদ্ধদেব সেই পুরস্কারই গ্রহণ করলেন। বাইর থেকে বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য্যকে বেশি শান্ত নরম-শরম মানুষ মনে হয়। কিন্তু তিনি অন্তরে এক কঠিন মানুষ। লক্ষ্যে অবিচল। তাই তো তিনি ভারতের পশ্চিমবঙ্গকে একটি উন্নত রাজ্যে পরিণত করতে নন্দীগ্রাম, সিঙ্গার প্রশ্নে আপস করেননি, তার বিরুদ্ধে অর্থাৎ তার সরকারের বিরুদ্ধে জঘন্য ষড়যন্ত্র করা হয়। তার সফেদ পানজাবিতে কালি লাগানোর চেষ্টা করা হয়। নন্দীগ্রাম হত্যাকাণ্ডে তাকে যুক্ত করে দেওয়া হয়। কিন্তু কোনো কিছুই চাপা থাকে না। সত্য একদিন না একদিন বেরিয়েই আসে। নন্দীগ্রামের সেই সত্য আজ বেরিয়ে এসেছে। নন্দীগ্রাম হত্যাকাণ্ডের কাহিনি এখন সবার জানা। বুদ্ধ বাবুকে কলঙ্কিত করার ষড়যন্ত্রে কী জঘন্যভাবে সেদিন নন্দীগ্রামের হত্যাকাণ্ড ঘটানো হয় তার পূর্ণ বিবরণ হত্যাকারীরা দিয়েছে শেষ পর্যন্ত। বুদ্ধ বাবুকে সালাম। লাল সালাম।
আমরা জানি, পদ্মভূষণ প্রত্যাখ্যান নিয়ে অনেক রটনা-ঘটনা ঘটবে। অনেক কাদা ছোড়াছুড়ি হবে। তার সঙ্গেই মাথা উঁচু করে বেঁচে থাকুক মতাদর্শের প্রতি আনুগত্য। বুদ্ধ এখনও বুদ্ধ। তিনি ঠিকই করছেন। কিন্তু তার ক্লিন ইমেজ ধ্বংসের চক্রান্ত চলেছে। রাজনীতিতে বিভেদ ও বিভ্রান্তি সৃষ্টির প্রচেষ্টা করেছে বিজেপির।
অনেকে প্রশ্ন করতে পারেন রাষ্ট্রীয় পুরস্কার রাষ্ট্র দ্বারা পরিচালিত হয়। তা হলে এই পুরস্কার নেওয়ায় সমস্যা কি? সমস্যা অনেক। তার বড় প্রমাণ অমর্ত্য সেনকেও ভারতরত্ন ফিরিয়ে দেওয়ার প্রস্তাব করেছে বিজেপি। মনে করতে হবে রাষ্ট্র সরকার দ্বারা পরিচালিত হয়। আর এই মুহূর্তে ভারতের সরকারে যারা আছেন, তারা হলেন মৌলবাদী ও সাম্প্রদায়িক। এমনকি এই করোনাকালেই সাম্প্রদায়িকতা থেকে বিরত হয়নি ভারত সরকার। তার বড় প্রমাণ ভরতের গুজরাট ও উত্তরপ্রদেশের হাসপাতালের বেডে রোগীর ধর্মপরিচয় খোঁজা হয়। এমন কথাও বলা হয় মুসলমানদের জন্য করোনা টেস্টেও কিট ব্যবহার করা ঠিক নয়। ওদের জায়গা হওয়া উচিত গোয়ালঘর। শুধু তাই নয়, করোনার বিস্তৃতির জন্য দায়ী করা হয় দিল্লির নিজামউদ্দিনের ধর্মীয় সমাবেশকে। অথচ করোনার বিস্তৃতির জন্য অনেক অনেক বেশি দায়ী ছিল কুম্ভ মেলা। যাই হোক. নীতি-আদর্শের সঙ্গে সঙ্গে ব্যক্তির মাত্রাও একটু থাকতে হয়। হিম্মত লাগে। সেই হিম্মত বুদ্ধদেবের মধ্যে আছে। আছে আরো দুই বঙ্গসন্তান সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায় ও অনিন্দ চট্টপাধ্যায়ের মধ্যে।
সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায় পদ্মশ্রী প্রত্যাখ্যান করে বলেনে, ‘এইভাবে কেউ পদ্মশ্রী দেয়? এরা জানে না আমি কে? ৯০ বছর বয়সে আমাকে কেন নিতে হবে পদ্মশ্রী। আর ফোন করলেই আমি চলে যাব? শিল্পীদের কোনো সম্মান নেই।’
এ বিষয়ে এক বঙ্গসন্তান সঞ্চয় সরকার তার ফেসবুকে বলছেন, এটাই বাংলা। এটাই বাঙালি। এটাই চেতনা। এটাই বাস্তবতা। সর্বোপরি এটাই জাতীয়তাবাদ, বাঙালি জাতীয়তাবাদ।
এক কাথায় পদ্ম পুরস্কার নিয়ে ভারতের ক্ষমতাসীন সরকারের বিভেদ-বিভ্রান্তি আর চক্রান্ত ষড়যন্ত্রের রাজনীতিতে জল ঢেলে দিলেন এ বঙ্গসন্তান। এই বঙ্গসন্তানদের জানাই সালাম। লাল সালাম।
লেখক : সিনিয়র সাংবাদিক