logo
আপডেট : ২৯ জানুয়ারি, ২০২২ ১৩:১৯
দ্বার খুলছে পদ্মা সেতু
রাজন ভট্টাচার্য

দ্বার খুলছে পদ্মা সেতু

শত জল্পনা-কল্পনার অবসান ঘটিয়ে শেষ পর্যন্ত বহুল কাক্সিক্ষত পদ্মা সেতুর দ্বার খুলতে যাচ্ছে। সবকিছু ঠিকঠাক থাকলে আগামী ২৩ জুন সেতু উদ্বোধন করবেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। সরকারি বিভিন্ন সূত্রে কথা বলে এ তথ্য জানা গেছে। তবে ছয় দশমিক ১৫ কিলোমিটার দীর্ঘ যোগাযোগ খাতের সর্ববৃহৎ এ প্রকল্পটির সড়ক ও রেলপথ একসঙ্গে চালুু হচ্ছে না। প্রথমে সড়কপথ। এরপর পর্যায়ক্রমে চালু হবে রেলপথও।

প্রকল্পটি আন্তর্জাতিক সড়ক ও রেল নেটওয়ার্কের সঙ্গেও যুক্ত হবে। সেইসঙ্গে দেশের দক্ষিণাঞ্চলের ২৯ জেলার মানুষ সরাসরি উপকৃত হবে। এক দশমিক দুই শতাংশ হারে অবদান রাখবে জিডিপিতে। প্রকল্পের চারপাশ ঘিরে হবে শিল্পায়ন। সৃষ্টি হবে কর্মসংস্থানের সুযোগ। সব মিলিয়ে দেশের অর্থনীতি ও যোগাযোগ সেক্টরে বড় পরিবর্তন আনতে যাচ্ছে নিজস্ব অর্থায়নে নির্মিত এই সেতু। দেশের সবচেয়ে দীর্ঘ এই সেতুটির আন্তর্জাতিক অবস্থান হলো ১১তম। সেতুর প্রকৌশল বিভাগ সূত্রে জানা যায়, পদ্মা সেতু প্রকল্পের সর্বমোট বাজেট ৩০ হাজার ১৯৩ কোটি ৩৯ লাখ টাকা।


বর্তমান সরকারের তৃতীয় বর্ষপূর্তি উপলক্ষে গত সাত জানুয়ারি জাতির উদ্দেশ্যে দেওয়া ভাষণে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেন, ‘২০২২ সাল হবে বাংলাদেশের জন্য অবকাঠামো উন্নয়নের এই মাইলফলক বছর। আর কয়েক মাস পর জুন মাসেই আমরা উদ্বোধন করতে যাচ্ছি বহুল কাক্সিক্ষত পদ্মা সেতু। আশা করি এই সেতু জিডিপিতে এক দশমিক দুই ভাগ অবদান রাখবে।’
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার এমন বক্তব্যের পর থেকেই পদ্মা সেতুর উদ্বোধনের তারিখ নিয়ে নানা জল্পনা-কল্পনা চলছে। সড়ক পরিবহণ ও সেতুমন্ত্রী সম্প্রতি একাধিক অনুষ্ঠানে জানিয়েছেন, চলতি বছরের জুন মাসেই পদ্মা সেতুর আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন হবে। এ ছাড়া মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ থেকে একই রকম তথ্য জানানো হয়েছে।


গত কয়েক দিন ধরেই সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকে বহুল কাঙ্ক্ষিত পদ্মা সেতু আগামী ২৩ জুন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা উদ্বোধন করবেন এমন খবর ছড়িয়েছে। যা এখন সোস্যাল মিডিয়ায় রীতিমতো ভাইরাল।
তবে সেতু সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, উদ্বোধনের সুনির্দিষ্ট তারিখ এখনো প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় থেকে সেতু কর্তৃপক্ষকে আনুষ্ঠানিকভাবে জানানো হয়নি। জানতে চাইলে সেতু বিভাগের জনসংযোগ কর্মকর্তা ওয়ালিদ ফয়েজ জানান, ‘আমার কাছে এ রকম কোনো তথ্য নেই। তবে জুনের মধ্যে সেতু উদ্বোধন হবে এটা অনেকটাই নিশ্চিত। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী সময় দিলেই দ্রুত সময়ের মধ্যে উদ্বোধনের তারিখ চ‚ড়ান্ত হবে’। প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে কর্মরত আরেকজন নিজের ফেসবুক পেজে আগামী ২৩ জুন পদ্মা সেতু উদ্বোধনের কথা উল্লেখ করে স্ট্যাটাস দেন কয়েক দিন আগে।


জানতে চাইলে পদ্মা সেতুর নির্বাহী প্রকৌশলী দেওয়ান মোহাম্মদ আব্দুল কাদের বলেন, সেতু উদ্বোধনের তারিখ এখনো চ‚ড়ান্ত হয়নি। তবে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে সেতু উদ্বোধনের তারিখ নিয়ে অনেকের পোস্ট দেওয়ার বিষয়টি শুনেছি। তিনি বলেন, জুনের মধ্যেই আশা করি সেতু উদ্বোধন হবে।


গত ৩১ ডিসেম্বর আকস্মিক সেতু পরিদর্শন করেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। প্রধানমন্ত্রী সেতুতে কয়েক কিলোমিটার এলাকা ঘুরে দেখেছেন বোন শেখ রেহানাকে নিয়ে। এদিকে গত ডিসেম্বর পর্যন্ত পদ্মা সেতু প্রকল্পের সার্বিক অগ্রগতি ৮৯ দশমিক ৫০ শতাংশ। আর মূল সেতুর কাজের অগ্রগতি ৯৫ দশমিক ৭৫ শতাংশ। অর্থাৎ মূল সেতুর কাজের আর বাকি মাত্র সাড়ে ৪ শতাংশ। গত তিন জানুয়ারি পদ্মা সেতুর নির্বাহী প্রকৌশলী কাদের এসব তথ্য জানিয়েছিলেন। মূল সেতুর বড় কাজের প্রায় সবই শেষ হয়েছে। এখন পিচ ঢালাইসহ সৌন্দর্যবর্ধনের কাজ চলছে।


২০২২ সালের ৩০ জুনের মধ্যে পদ্মা সেতুকে যান চলাচলের জন্য খুলে দেওয়া বলে হবে জানিয়েছেন মন্ত্রিপরিষদ সচিব খন্দকার আনোয়ারুল ইসলাম। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সভাপতিত্বে গত ২২ নভেম্বর সচিবালয়ে মন্ত্রিসভার বৈঠক শেষে ব্রিফিংয়ে তিনি এ তথ্য জানান।


ঠিকাদারের সঙ্গে চুক্তি অনুসারে, এ বছরের জুনে পদ্মা সেতুর কাজ শেষ হলেও প্রকল্পের মেয়াদ ধরা হয়েছে আগামী বছর জুন পর্যন্ত। শেষ এক বছর রাখা হয়েছে ডিফেক্ট লায়াবিলিটি পিরিয়ড (ডিএলপি) হিসেবে। এই এক বছরে সেতুতে কোনো ত্রæটি দেখা দিলে তা ঠিকাদার নিজেদের টাকায় ঠিক করবে। অন্যদিকে ঠিকাদারের কিছু পাওনা থাকলে সেটা মেটাবে প্রকল্প কর্তৃপক্ষ।


পদ্মা সেতু কর্তৃপক্ষ সূত্র জানায়, ২০১৫ সালের ১২ ডিসেম্বর প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা মূল সেতুর নির্মাণকাজের উদ্বোধন করেন। প্রকল্পের কাজের অগ্রগতিসংক্রান্ত প্রতিবেদন অনুসারে, ৬ দশমিক ১৫ কিলোমিটার সেতুতে ২ হাজার ৯১৭টি রোড ওয়ে স্ল্যাব এবং ২ হাজার ৯৫৯টি রেলওয়ে স্ল্যব বসানো হয়েছে। বর্তমানে সেতুতে কার্পেটিং, ভায়াডাক্টে কার্পেটিং, ওয়াটারপ্রুফ মেমব্রেন (পানিনিরোধক), মূল সেতুর মুভমেন্ট জয়েন্ট, ভায়াডাক্টের মুভমেন্ট জয়েন্ট, ল্যাম্পপোস্ট, অ্যালুমিনিয়াম রেলিং, গ্যাসের পাইপলাইন, ৪০০ কেভিএ বিদ্যুৎ ও রেললাইনের কাজ চলমান।


সেতু নির্মাণের মোট বাজেট ৩০ হাজার ১৯৩ দশমিক ৩৯ কোটি টাকা। গত বছরের ৩১ ডিসেম্বর পর্যন্ত ব্যয় করা হয়েছে ২৬ হাজার ৬৫৮ দশমিক ৩১ কোটি টাকা।
প্রকল্প সংশ্লিষ্টরা বলছেন, পদ্মা সেতু দ্বিতলবিশিষ্ট। এর ওপর দিয়ে চলাচল করবে যানবাহন, নিচ দিয়ে চলবে রেল। সেতুটি চালু হলে দক্ষিণাঞ্চলসহ ২৯টি জেলার সঙ্গে যোগাযোগ সহজ হবে। দক্ষিণের মানুষ এখন সেতুটি চালুর অপেক্ষায়।


তবে ২০২৪ সালের জুন নাগাদ শেষ হচ্ছে না পদ্মা সেতুর রেল লিংক প্রকল্পের কাজ। সময় বাড়তে পারে আরো দেড় বছর। রেলে চড়ে পদ্মা সেতু পাড়ি দিতে দক্ষিণাঞ্চলের মানুষকে অপেক্ষা করতে হতে পারে ২০২৬ সাল পর্যন্ত। একই সঙ্গে বাড়তে পারে এ প্রকল্পের ব্যয়। শতভাগ কাজ সম্পন্ন করতে আরো এক হাজার ১৭৭ কোটি টাকা প্রয়োজন বলে পরিকল্পনা কমিশনকে জানিয়েছে বাংলাদেশ রেলওয়ে।


ঢাকা থেকে কেরানীগঞ্জ ও পদ্মা সেতু হয়ে যশোর পর্যন্ত ১৭২ কিলোমিটার রেলপথ নির্মাণে মোট ব্যয় ধরা ছিল ৩৯ হাজার ২৪৬ কোটি ৭৮ লাখ টাকা। প্রকল্পের কাজ শুরু হয় ২০১৬ সালের জানুয়ারি মাসে। ২০২৪ সালের জুলাই মাসে সব কাজ সম্পন্ন হওয়ার কথা থাকলেও সময়-ব্যয় বাড়ানোর প্রস্তাব করা হয়েছে। তবে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত এখনো হয়নি। সড়কপথের ৪০ফুট নিচ দিয়ে ১৬০ কিলোমিটার গতিতে ছুটে যাবে ট্রেন। ১১০ কিলোমিটার গতিতে চলবে পণ্যবাহী ট্রেন।


রেল ও সড়কপথ মিলিয়ে দ্বিতল এই সেতুটি দক্ষিণাঞ্চলের সব জেলা-উপজেলার সঙ্গে সড়ক ও রেল যোগাযোগকে আরো সমৃদ্ধ করবে। যুক্ত হবে এশিয়ান হাইওয়ের সঙ্গে। তাছাড়া পদ্মা সেতু বাংলাদেশের সঙ্গে আন্তর্জাতিক সড়ক যোগাযোগের অন্যতম অনুষঙ্গ। দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার মানুষ বেশি উপকৃত হলেও বিশ্বের সঙ্গে বাংলাদেশের সড়ক ও রেল যোগাযোগে নতুন মাত্রা যোগ করবে, বলছেন প্রকল্প সংশ্লষ্টরা। আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলোর বিশ্লেষণ বলছে, দেশের এক-তৃতীয়াংশ মানুষ এ দ্বারা উপকৃত হবে। এডিবি বলছে, বছরে জিডিপি প্রবৃদ্ধি বাড়বে এক দশমিক পাঁচ শতাংশ থেকে দুই ভাগ পর্যন্ত।


বহুল আলোচিত পদ্মা সেতু প্রকল্পটির যাত্রা শুরু হয় ২০০৭ সালে। সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকার ওই বছরের ২৮ আগস্ট ১০ হাজার ১৬১ কোটি টাকার প্রকল্প অনুমোদন করেছিল। পরে আওয়ামী লীগ সরকার এসে রেলপথ সংযুক্ত করে ২০১১ সালের ১১ জানুয়ারি প্রথম দফায় সেতুর ব্যয় সংশোধন করে। কাজ শেষ হওয়ার সম্ভাব্য তারিখ ধরা হয়েছিল ২০১৩ সাল। প্রকল্পের অর্থ ঋণ হিসেবে জোগান দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল পাঁচটি সংস্থা।


সংস্থাগুলো হলো এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক (এডিবি), বিশ্বব্যাংক, জাপান আন্তর্জাতিক সহযোগিতা সংস্থা (জাইকা), ইসলামী উন্নয়ন ব্যাংক ও আবুধাবি ডেভেলপমেন্ট গ্রুপ। এর মধ্যে বিশ্বব্যাংক ১২০ কোটি ডলার দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল। কিন্তু বিশ্বব্যাংক দুর্নীতির ষড়যন্ত্রের অভিযোগ তুলে ২০১২ সালের ২৯ জুন অর্থায়নের প্রতিশ্রুতি প্রত্যাহার করে নেয়। বিশ্বব্যাংকের অভিযোগ ছিল, কানাডিয়ান প্রতিষ্ঠান এসএনসি-লাভালিনকে পরামর্শক প্রতিষ্ঠান নিয়োগ করার জন্য পদ্মা সেতু-সংশ্লিষ্ট কিছু লোক তাদের কাছ থেকে ঘুষ নিতে চেয়েছিল। এ নিয়ে কানাডার আদালতে একটি মামলাও করা হয়। কাল্পনিক দুর্নীতির অভিযোগে ওই সময়ের সেতুসচিব মোশাররফ হোসেনকে গ্রেপ্তার করা হয়, মন্ত্রিত্ব ছাড়তে হয় যোগাযোগমন্ত্রী সৈয়দ আবুল হোসেনকে।


বিশ্বব্যাংক প্রতিশ্রুতি প্রত্যাহারের পর ২০১২ সালের ১০ জুলাই জেলা প্রশাসক (ডিসি) সম্মেলনে বক্তব্য দেওয়ার সময় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেন, পদ্মা সেতু নির্মাণে তার সরকার আর কোনো দেশ বা সংস্থার কাছে স্বেচ্ছায় সহায়তা চাইবে না।